কাজিরবাজার ডেস্ক :
নির্ধারিত সময়েই সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন শেষ হয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষণা দিয়েছিল তাদের মেয়াদকাল অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই এ নির্বাচন শেষ করবে। ইতোমধ্যেই ৭ ধাপে ৪ হাজার ১১১টি ইউপির নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠুভাবেই শেষ হয়েছে। আগে স্থগিত হওয়া আরও ক’টি ইউপির নির্বাচন আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই হবে। আর আদালতে মামলাসহ বিভিন্ন কারণে আরও কিছু ইউপির নির্বাচন নিয়ে জটিলতা থাকায় পরে হবে। এবারের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি ও কেন্দ্র দখলের ঘটনা কম হলেও বিচ্ছিন্ন সহিংসতায় প্রাণহানি বেশি হয়েছে। প্রথম দিকে সহিংসতা বেশি হলেও শেষ দিকে কম হয়েছে। আর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া দলীয় অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।
এবারের ইউপি নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর আধিক্য। এ নির্বাচনে সারাদেশে নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মধ্যে সিংহভাগই নির্বাচিত হয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশ দল মনোনীত এবং বাকি ৪৫ শতাংশ দলের বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এবারের নির্বাচনের আরেক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি। ৪ হাজার ১১১ ইউপির মধ্যে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ৩৬৮ জন। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন সহস্রাধিক।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিসহ প্রায় ২০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। তবে বিএনপিসহ তাদের সমমনা কিছু দল প্রকাশ্যে অংশ নেয়নি। দলের পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির ক’জন স্থানীয় নেতা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া মেম্বারদের মধ্যেও তৃণমূল বিএনপির অনেক নেতাকর্মী নির্বাচিত হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
আগের ইউপি নির্বাচনগুলোর মতো এবারের ৭ ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটে জালিয়াতি ও কেন্দ্র দখলের ঘটনা কম ঘটলেও ১০১ জনের প্রাণহানি উৎসবমুখর নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে। নির্বাচনের দিন এবং আগে পরে মিলিয়ে ৭ ধাপে এই ১০১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে প্রাণহানি হয়েছে ৫ জনের। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ৩০ জন, তৃতীয় ধাপে ২৬ জন, ৪র্থ ধাপে ১০ জন, ৫ম ধাপে ২৩ জন, ৬ষ্ঠ ধাপে ২ জন এবং ৭ম ধাপে ৫ জন। এর মধ্যে ৬ষ্ঠ ধাপে ভোটের দিন কোন প্রাণহানি ঘটেনি। আর এবারের ৭ ধাপের নির্বাচনে গড়ে প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পড়লেও যেসব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হয়েছে সেখানে গড়ে ৫৮ ভাগ ভোট পড়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা ও আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় অনেকে ইভিএমে ভোট দিতে পারেননি।
এদিকে ৭ ধাপের ইউপি নির্বাচনে ১০১ জনের প্রাণহানি হলেও নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয় সহিংসতার দায় ইসির নয়। ৭ ধাপের নির্বাচন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, নির্বাচনী সহিংসতায় স্থানীয়দের মধ্যে মারামারিতে প্রাণহানি ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন থেকে স্থানীয় প্রশাসনের চাহিদামতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকল সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। তাই এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে স্থানীয় প্রশাসন। তবে সার্বিকভাবে নির্বাচন ভাল হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হয়েছেন।
অশোক কুমার বলেন, নির্বাচন কমিশন জীবনহানি আশা করে না। কিন্তু এরপরও অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। এক্ষেত্রে কমিশনের ব্যর্থতা নেই। কারণ সহিংস ঘটনাগুলো স্থানীয়ভাবে সংঘটিত হয়। সরাসরি কমিশনের কোন দায় নেই। আমরা স্থানীয় প্রশাসনের চাহিদা মোতাবেক অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করে থাকি। তবে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে ভোটে অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অনিয়মে জড়িত ইসির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আগেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অনেকে সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় আছেন। অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এগুলোর তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হবে।
ইউপি নির্বাচনের প্রথম ৫ ধাপে সহিংসতা কিছুটা বেশি হলেও শেষ দিকে এসে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করায় সহিংসতা কমেছে। আর সকল ধাপের নির্বাচনেই ভোট জালিয়াতি ও কেন্দ্র দখলের ঘটনা কম ঘটেছে। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন শেষ দিকে এসে সুষ্ঠু নির্বাচনের উদাহরণ সৃষ্টি করে। এর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনও নজিরবিহীন সুষ্ঠু হয়েছে। এতে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। এছাড়া দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে সে বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণে ইউপি নির্বাচনে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের মূল প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের সহিংসতা। তাই যারা মারা গেছেন বেশির ভাগই সরকারী দলের লোকজন।
সপ্তম ধাপের মধ্যে প্রতিটি ধাপে ইউপি ভোটের দিন পরিবেশ শান্ত রাখতে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করে নির্বাচন কমিশন। ভোটগ্রহণকালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মনিটরিং সেলের কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে পরিচালিত হয়। এ সেলের কার্যক্রমের মধ্যে ছিল-১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে অবগত করা। ২. সেলে অন্তর্ভুক্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধির মাধ্যমে নির্বাচন উপলক্ষে মোতায়েন করা আইনশৃঙ্খলা সদস্যদের অবস্থা ও সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানানো। ৩. সংস্থার নিজস্ব যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কমিশনের নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করা। ৪. ভোটকেন্দ্র বা নির্বাচনী এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করা। ৫. বিভিন্ন নির্বাচনী মালামাল পরিবহন, বিতরণ এবং ভোটগ্রহণ কাজে নিরাপত্তা বিধানের জন্য মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করে রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসারদের সহায়তা দেয়া।
আগের ৫ ধাপের অভিজ্ঞতার আলোকে ইউপি নির্বাচনে ৬ষ্ঠ ধাপ থেকে তিন স্তরের নিরাপত্তা জোরদার করে নির্বাচন কমিশন। এ কারণে ৬ষ্ঠ ধাপের ভোটের দিন বড় কোন সহিংসতা ঘটেনি। আর ৭ম ধাপেও চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার একটি ইউনিয়ন ছাড়া আর কোথাও তেমন সহিংস ঘটনা ঘটেনি। তারপরও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে বলেই অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
গত বছর ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর দুই পর্বে প্রথম ধাপের ৩৬৯টি ইউপিতে এবং ১১ নবেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২৮ নবেম্বর তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ৭ ইউপিতে ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপে ৮৪০টি ইউপিতে এবং এ বছর ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপে ৭০৭, ৬ষ্ঠ ধাপে ২১৯ ও ৭ম ধাপে ১৩৬ ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে দেশে চার হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ১১১ ইউপির নির্বাচন ৭ ধাপে শেষ হয়। অল্প কিছু ইউপির নির্বাচন আগামী কয়েকদিনের মধ্যে হবে। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিদায় নেবে। তারপর নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে বাকি ইউপির নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ইতোমধ্যে ৯ বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে প্রথম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয়, ১৯৮৩ সালে তৃতীয়, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ, ১৯৯২ সালে ৫ম, ১৯৯৭ সালে ৬ষ্ঠ, ২০০৩ সালে ৭ম ও ২০১১ সালে ৮ম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নবম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দলীয় প্রতীকে। আর এবার দ্বিতীয়বারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার কারণে বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংস ঘটনা ছাড়া মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ৭ ধাপের ইউপি ভোট হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে নারী ও নতুন ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে বয়স্ক ভোটারদের মধ্যে কারো কারো আঙ্গুলের ছাপ বারবার চেষ্টার পরও না মেলার কারণে তারা ইভিএমে ভোট দিতে পারেননি। এছাড়া কেউ কেউ সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে না নিয়ে যাওয়ায় ভোটকেন্দ্রে কিছুটা বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন।
অভিজ্ঞ মহলের মতে স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ পর্যায়ের অর্থাৎ একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচন হওয়ায় ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরেই সহিংসতার ঘটনা ঘটে থাকে। সবাই চায় তার পছন্দের লোকটি স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি হোক। আর এই চাওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সবাই অতিরিক্ত সিরিয়াস হয়ে যান। তাই নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর বিজয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। আর এ কারণেই সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন। তবে এবারের নির্বাচনে সংখ্যার দিক দিয়ে সহিংসতা বেশি না হলেও প্রাণহানির ঘটনা বেশি হওয়ায় বেশি আলোচনায় আসে। তবে ভোট জালিয়াতি ও কেন্দ্র দখলের ঘটনা অতীতের যে কোন ইউপি নির্বাচনের চেয়ে এবার কম হয়েছে।
প্রসঙ্গত, কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই কমিশনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সমালোচনা অব্যাহত রাখে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই কমিশনের বিরুদ্ধে সমালোচনার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সর্বশেষ ৫ ধাপের ইউপি নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ থাকায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল ব্যাপক সমালোচনা করে। এ কারণে এই কমিশন ছিল কিছুটা বেকায়দায়। তাই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ একেবারে শেষ প্রান্তে এসে প্রথমে নাসিক নির্বাচন ও পরে ইউপির ৬ষ্ঠ ও ৭ম ধাপের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপরতা জোরদার করার নির্দেশ দেয়। এতে অনেকাংশে সফল হলেও শেষ ধাপে সাতকানিয়ায় ২ জনের প্রাণহানি শেষ দিকের সফলতাকে কিছুটা ম্লান করেছে।