কাজিরবাজার ডেস্ক :
রীতিমতো রুদ্ধশ্বাসের প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে সংঘটিত সেই চাঞ্চল্যকর এবং দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া ৬ জনকে যাবজ্জীবন ও প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে এবং ৭ জনকে আদালত খালাস প্রদান করেছেন। এই মামলার এক নম্বর আসামি ছিলেন পরিদর্শক লিয়াকত আলী এবং দুই নম্বর আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। সোমবার ২টা ৩৫ মিনিট থেকে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোঃ ইসমাইল হোসেন পিনপতন নীরবতার মধ্যে তার আদালত কক্ষে রায় পড়া শুরু করেন। তিনি তিনশ’ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান প্রায় দু’ঘণ্টা। ২৯ কার্যদিবস শেষে ঘটনার দেড় বছরের মাথায় এই মামলার রায় প্রদান করা হলো। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ৩৮ বছরের ইতিহাসে দ্রুততম সময়ে চাঞ্চল্যকর একটি হত্যা মামলার রায় প্রদানের ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মামলায় ৮৩ সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ঘটনা কোন মামলার ক্ষেত্রে নজির নেই। এছাড়া স্বল্প সময়ে চার্জ গঠন, শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনও হয়েছে এই আদালতে।
যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত ৬ জন হলেন বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, টেকনাফ থানার কনস্টেবল রুবেল শর্মা, এএসআই সাগর দেব, পুলিশের সাজানো মামলার সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোঃ আয়াজ (৩ জনই পুলিশের সোর্স)। পক্ষান্তরে খালাস পেয়েছেন শামলাপুর চেকপোস্টের এপিবিএন সদস্য মোঃ শাহজাহান, মোঃ রাজিব ও মোঃ আবদুল্লাহ এবং কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ মামুন ও মোঃ লিটন মিয়া ।
এ সময় আদালত কক্ষ ছিল বাদী-বিবাদী ও সরকার পক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে ঠাসা। রায় প্রদান উপলক্ষে সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে আদালত প্রাঙ্গণে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে হাজার হাজার উৎসুক জনতার ছিল ভিড়। সকাল থেকে হয়েছে, খন্ড খন্ড মিছিল। এছাড়া প্রদীপসহ আসামিদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে অনেককে অবস্থান করতে দেখা যায়। আদালত অভ্যন্তরে সিনহার মা নাসিমা আক্তার ও বড় বোন (মামলার বাদী) শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস উপস্থিত ছিলেন।
রায় ঘোষণার পর সরকার পক্ষে পিপি ফরিদুল আলম তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মামলার বাদী সিনহার বড় বোন শারমিন ফেরদৌস শাহরিয়া তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, রায়ে তার প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। যে দু’জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে তা ছিল তিনি ও তার পরিবারের কাক্সিক্ষত। এছাড়া যারা বেকসুর খালাস পেয়েছেন এ ঘটনায় কিছু না কিছু সম্পৃক্ততা ছিল। তাদেরও শাস্তির আওতায় আনলে ভাল হতো। তিনি বলেন, আদালত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এ রায় প্রদান করেছেন। তিনি আদালতসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বলেছেন, যাদের খালাস দেয়া হয়েছে তাদের বিষয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার বিষয়টি পরবর্তীতে তার আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
পক্ষান্তরে, আসামি সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের পক্ষে তার আইনজীবী প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, তারা ন্যায়বিচার পাননি। উচ্চ আদালতে যাবেন। প্রদীপের আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত জানান, আমরা ন্যায়বিচার চেয়েছিলাম, পাইনি। রাষ্ট্রপক্ষ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। কিন্তু তারা সেটা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। দন্ডিতদের সঙ্গে প্রদীপের কোন যোগাযোগ ছিল না। ন্যায়বিচার না পাওয়াতে আমরা আপীল করব।
এর আগে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সকাল ১০টায় এ রায় ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু আদালত কার্যক্রম শুরু হলে বাদী, বিবাদী এবং সাংবাদিকসহ উৎসুক সকল পক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয় বেলা ২টার পর এ রায় ঘোষণা করা হবে। সে অনুযায়ী ২টার কিছুক্ষণ আগে ১৫ আসামিকে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নিয়ে এসে আদালতে তোলা হয়। এরপর জেলা ও দায়রা জজ এজলাসে ওঠেন বেলা আড়াইটায়। তিনি রায় পাঠ শুরু করেন ২টা ৩৫ মিনিট থেকে। ৩০০ পৃষ্ঠার এ রায়ের চুম্বক অংশ পাঠ করেন আদালত। তিনি সাড়ে ৪টায় রায় ঘোষণা শেষ করেন। রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এটি একটি ঠান্ডা মাথার পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাকান্ড। শুনানিকালে এ মামলার সাক্ষ্য, যুক্তিতর্ক, জবানবন্দী সবই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ওসি প্রদীপের মাদকসহ অবৈধ বাণিজ্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড-সহ বিভিন্ন অপকর্মের তথ্য জেনে গিয়েছিলেন সিনহা। তাই সিনহাকে টেকনাফ ছাড়া করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়ে হত্যার পথ বেছে নেন প্রদীপ। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিনহা যতক্ষণ মরেননি ততক্ষণ তাকে নির্যাতন করেছেন পরিদর্শক লিয়াকত। এ ঘটনায় যাদের যোগসাজশ সন্দেহাতীতভাবে সাজার আওতায় আনা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সিনহা হত্যা মামলায় গত ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় দফায় ৮৩ সাক্ষীর মধ্যে বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস ও তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ৬৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। বরখাস্ত টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় গত ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আদালতে লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য দেন। এরপর আদালত ৯ জানুয়ারি থেকে চারদিন এ মামলার যুক্তিতর্কের দিন ধার্য করেন। যুক্তিতর্ক শেষে ৩১ জানুয়ারি মামলার রায়ের দিন ধার্য করেন। সোমবার রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় ১৫ আসামির মধ্যে লিয়াকত ও প্রদীপ দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ৬ জন ডুকরে কেঁদেছেন। আর খালাসপ্রাপ্ত ৭ জন ছিলেন নির্বিকার। আদালত প্রাঙ্গণের বাইরে রায় ঘোষণার পর চলেছে উল্লাস। দন্ডিতদের আত্মীয়স্বজনদের মনোবেদনা নিয়ে ফিরে যেতে দেখা যায়। এর আগে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসুক জনতা আদালত প্রাঙ্গণে এনে ভিড় জমান। এদের সকলের মুখে সিনহা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশা ব্যক্ত করে নানা মতামত দিতে শোনা যায়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের মামলার কার্যক্রম পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন পিপি ফরিদুল আলম, বাদী পক্ষে মোঃ জাহাঙ্গীর, মোঃ মোস্তফা, জিয়া উদ্দিন, মোজাফফর আহমদ, মাহবুবুল হক। অন্য আসামিদের পক্ষে ছিলেন যথাক্রমে এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, চন্দন দাশ, সমীর দাশগুপ্ত, মহিউদ্দিন খান, মোঃ শাহীন, আবুল কাশেম ও মোঃ জাকারিয়া।
ফ্লাশব্যাক : টেকনাফের বাহারছড়া এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খান প্রাণ হারান। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদ-উল আযহার আগের দিন (শুক্রবার) রাত আনুমান সাড়ে ৯টায় টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে বাহারছড়া চেকপোস্টে সিনহাকে খুন করা হয়। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ নিজে তার প্রাইভেটকার চালিয়ে পর্যটন স্পট হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে আসছিলেন। পথে প্রথমে বিজিবি চেকপোস্টে তার গাড়ি তল্লাশির জন্য থামানো হয়। গাড়ি থামানোর পর সিনহা তার নিজের পরিচয় দেন। তল্লাশিতে নিয়োজিতরা তার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে সালাম দিয়ে ছেড়ে দেন। এরপর অনতি দূরে বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের চেকপোস্টে পৌঁছলে সিনহার গাড়িকে থামাতে সিগন্যাল দেয় পুলিশ। কিন্তু ধীরগতিতে সিনহা গাড়ি চালিয়ে এগোচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশ ড্রাম ফেলে তার গতিরোধ করে। এরপর গাড়ি থামিয়ে মেজর সিনহা নিজের পরিচয় দেন। এ সময় বাহারছড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী মেজর সিনহাকে গাড়ি থেকে নামার আদেশ দেন। পুলিশের আদেশ পেয়ে সিনহার গাড়িতে থাকা সঙ্গী সিফাত নিজের দু’হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন। এরপর সিনহা গাড়ি থেকে পা নামিয়ে পুরোপুরিভাবে নামার আগেই উপস্থিত ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী পর পর ৪টি গুলি করেন সিনহাকে। সিনহা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। খবর পেয়ে কিছুক্ষণ পর টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘটনাস্থলে হাজির হন এবং তার শরীরে কয়েক দফা লাথি মারেন। একপর্যায়ে সিনহার বুকের ওপর পা রেখে চেপে ধরেন প্রদীপ। যে কারণে তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়। আরও পরে সিনহার নিথর দেহ একটি ভ্যানযোগে কক্সবাজার হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সিনহাকে পানি পান করতে দেয়নি খুনীরা : মেজর সিনহার বুকে গুলি চালানোর পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এ সময় ‘পানি-পানি’ বলে আকুতি জানান সিনহা। কিন্তু পানি দিতে কেউ এগিয়ে আসেনি।
লাশ বহন : পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদকে একটি মিনি ট্রাকে (ময়লা পরিবহনের ডাম্পার) করে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সিনহা যেভাবে আসেন ঘটনাস্থলে : ছবি ধারণ শেষে পাহাড় থেকে নেমে মেজর (অব.) সিনহা তার ফটোগ্রাফার সিফাতকে নিয়ে নিজস্ব প্রাইভেটকারে ওঠেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে পৌঁছান শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে। সেখানে আগে থেকেই প্রতিরোধে প্রস্তুত ছিলেন পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের সদস্যরা। বিজিবির প্রথম চেকপোস্ট পেরিয়ে এপিবিএন চেকপোস্টে সিনহাকে গুলি করে হত্যা করেন বরখাস্তকৃত পরিদর্শক লিয়াকত।
ঘটনা প্রচার হওয়ার পরক্ষণে : সিনহাকে গুলি করার পরপরই রাত পৌনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্থানীয় জনগণ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠকর্মী আইয়ুব আলী। তখন গুলিবিদ্ধ সেনা কর্মকর্তাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান তারা। আইয়ুব আলী ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করতে চাইলে লিয়াকত ওই মাঠকর্মীর পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় দেয়ার পর মাঠকর্মীর হাত থেকে মুঠোফোন সেট ও তার পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয় পুলিশ। রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে আনা হয় ওই মিনিট্রাক। ট্রাকে ওঠানোর কিছুক্ষণ আগেও মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন এবং নড়াচড়া করছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য রয়েছে। ওসি প্রদীপ এসে বুটের চাপায় নিস্তেজ করে দেয় সিনহাকে। এরপর নিহত সিনহাকে নিয়ে ট্রাকটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর। তখন হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরমধ্যে লিয়াকত ও ওসি প্রদীপ পৃথকভাবে জেলা এসপির সঙ্গে মোবাইল ফোনে ঘটনার প্রসঙ্গ জানান। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তখন ভাইরাল হয়েছিল।
খুনীদের বাঁচানোর অপকৌশল : ঘটনার পর পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছিলেন, শামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেয়। এই সময় চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন তার পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি মারা যায়। এসপি আরও জানিয়েছিলেন, এই ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। ২ জনকে আটক করা হয়েছে। পিস্তলটি জব্দ করেছে পুলিশ। এছাড়া গাড়ি ও রিসোর্টে তল্লাশি করে ৫০টি ইয়াবা, কিছু গাঁজা এবং দুটি বিদেশী মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে।
নিহত সিনহার বোন মামলা করলে পরবর্তীতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। মেজর সিনহা হত্যা ঘটনায় সরকার চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিকে তদন্তের জন্য সময় দেয়া হয় ৭দিন। তবে কমিটির সদস্যরা পর্যায়ক্রমে তিনবার সময় নেন। গঠিত কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করার পর তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের তখন জানান যে, দুঃখজনক ঘটনাটির একটি নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ তদন্ত করা হয়েছে। ঘটনার পর শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৬ সদস্যকে জেলা পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়।
হত্যা মামলা দায়ের : এ ঘটনার পর পুলিশ মেজর সিনহা, সহযোগী সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ যে রেস্ট হাউসে থাকতেন সেখানে অভিযান চালায়। অভিযানে অস্ত্র, মাদকসহ বেআইনী জিনিস পাওয়া গেছে অভিযোগ এনে টেকনাফ ও রামু থানায় ৩টি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে কক্সবাজারসহ সর্বত্র তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ নির্মম হত্যাকান্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চলে।
ঘটনার পাঁচ দিন পর ঢাকা থেকে কক্সবাজার গিয়ে সিনহার বড় কোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস ৫ আগস্ট জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। পুলিশের করা ৩টিসহ মোট চার মামলার তদন্তের দায়িত্ব আদালতের নির্দেশে দেয়া হয় র্যাবকে। ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ খাইরুল ইসলাম। অপর ৩টি মামলা তদন্তে সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
কক্সবাজারে কেন এসেছিলেন মেজর সিনহা : ঢাকার স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ থেকে ‘জাস্ট গো’ নামক একটি কোম্পানির পক্ষে ইউটিউব চ্যানেলে দেয়ার জন্য প্রামাণ্য তথ্যচিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে কক্সবাজারে আসেন মেজর সিনহা। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজন ছাত্রছাত্রীসহ একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ট্রাভেল ভিডিও তৈরি করতে ২০২০ সালের ৩ জুলাই কক্সবাজারে অবস্থান করেন তারা। পর্যটন স্পট হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্ট ভাড়া নিয়ে রাত যাপন করতেন। ৫ জুলাই কক্সবাজার পৌরসভার মাধ্যমে কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ হতে করোনার নমুনা টেস্টও করান ওই চারজন। টেস্টে তাদের রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ আসে। প্রায় একমাস (২৮ দিন) যাবত পর্যটন নগরীর বিভিন্ন স্থানে শূটিং করেন তারা।
ঘটনার আগে কোথায় ছিলেন সিনহা : মেজর সিনহা যেদিন রাতে হত্যার শিকার হবেন, ওইদিন শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতসহ মেজর (অব.) সিনহা ছিলেন মাথাভাঙ্গা তথা মারিশবুনিয়া এলাকার পাহাড়ে। সেখানে পাহাড়ী ঝর্ণাও রয়েছে। ঝর্ণার আশপাশের চিত্র ধারণ করাটাই ছিল তার উদ্দেশ্য। ওই পাহাড়ী ঝর্ণার ছবি প্রামাণ্য চিত্র ধারণ করে রাত ৮টার দিকে ফিরে আসছিলেন তারা। সন্ধ্যা ও রাতে শূটিং শেষ করে অন্ধকার হওয়ায় মোবাইল ও টর্চলাইটের আলো জ্বালিয়ে রাত আটটায় পাহাড় থেকে নামছিলেন সিনহা ও তার সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাত।
মাইকিং ও পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন : অভিযোগ অনুযায়ী ওসি প্রদীপের নির্দেশ মতে স্থানীয় কতিপয় দালাল ‘ডাকাত-ডাকাত’ বলে চিৎকার করে। পরে মাথাভাঙ্গার বাসিন্দা নেজাম উদ্দিন নামে এক যুবক মারিশবুনিয়া মসজিদের মাইকে পাহাড়ে ডাকাত পড়েছে বলে প্রচার করে। ওসি প্রদীপের উদ্দেশ্য ছিল ডাকাত হিসেবে গণপিটুনি দিয়েই স্থানীয়রা মেজর সিনহাকে খুন করবে। এতে পার পেয়ে যাবে গোপন নীলনক্সা। যখন মেজর সিনহা ভিন্ন পথে পাহাড় থেকে নামছিলেন, তখন কালবিলম্ব না করে কমিউনিটি পুলিশিং সদস্য নুরুল আমিন মুঠোফোনে পাহাড়ে টর্চলাইট জ্বালিয়ে কয়েকজন ডাকাত হাঁটাহাঁটি করছে বলে মিথ্যা সংবাদ দেয় বাহারছড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকতকে।
মাইকে প্রচার শুনে চলে আসেন সিনহা : মাইকে বলা হয়, আপনারা স্থানীয় হয়ে থাকলে পাহাড় থেকে নেমে আসেন। এই বাক্য শুনে মেজর সিনহা তার সঙ্গীসহ নেমে আসেন মাথাভাঙ্গা পাহাড় থেকে। মাইকিং শুনে পথে জড়ো হওয়া স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সিনহা কথা বলেন এবং নিজের পরিচয় দেন। পরিচয় জেনে স্থানীয়রা নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যান। মেজর (অব.) সিনহা ও তার সঙ্গী সিফাত হেঁটে মেরিন ড্রাইভে রাখা তার গাড়িতে গিয়ে উঠেন। এ খবর মুহূর্তে পৌঁছানো হয় ওসি প্রদীপের কাছে।
বিজিবি চেকপোস্টে মেজর সিনহা : পথে বিজিবি চেকপোস্টে থামানো হয় তার প্রাইভেট গাড়িটি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর বলে পরিচয় জেনেই বিজিবি সদস্যরা ছেড়ে দেন তার প্রাইভেটকার। এরপর অন্তত পাঁচ কিলোমিটার পর শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে এসে খালি ড্রাম ও কাঠের টুকরোর ব্যারিকেডে আটকা পড়ে সিনহার কারটি। উল্লেখ্য, বাহারছড়া পুলিশ চেকপোস্ট থেকে মাথাভাঙ্গা পাহাড়ী ঝর্ণার দূরত্ব প্রায় ১০/১২ কি.মি.।
মর্গের প্রাথমিক তথ্য : পুলিশের এজাহারে পরিদর্শক লিয়াকতের রিভলবার থেকে চারটি গুলি ছোড়ার কথা উল্লেখ থাকলেও কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গ সূত্র জানিয়েছিল, তিনটি গুলির একটি সিনহার বুকে ও দুটি গলার নিচে বিদ্ধ হয়।
৩টি মামলা রুজু : জব্দ তালিকায় একটি বিদেশী পিস্তল ও ৯ রাউন্ড গুলি ও মাদক উদ্ধার দেখিয়ে সিনহা ও তার সফরসঙ্গীদের বিরুদ্ধে ২টি মামলা রুজু করেছিল পুলিশ। পরে সিনহার সঙ্গী সিফাতকে ঘটনাস্থল থেকে এবং শূটিং টিমের সদস্য শিপ্রা দেবনাথকে নীলিমা রিসোর্ট থেকে গ্রেফতার করা হয়। মামলার বাদী হন টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল। মামলায় আসামি করা হয় নিহত মেজর সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে। এছাড়াও মেজর (অব.) সিনহা মোঃ রাশেদ খান ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আরও একটি মামলা রেকর্ড করা হয় টেকনাফ থানায়। এতে উদ্ধার দেখানো হয় ৫০ পিস ইয়াবা, দুটি মদের বোতল ও ২৫০ গ্রাম গাঁজা। সরকারী কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র তাক করা ও মৃত্যু ঘটানো এসব অপরাধ আনা হয়েছিল রেকর্ডকৃত মামলায়। এসব মামলায় কারাভোগও করেন শিপ্রা ও সিফাত।
হোটেল ম্যানেজারের যে বক্তব্য ছিল : কক্সবাজার- টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের পাশে অবস্থিত নীলিমা রিসোর্টের ম্যানেজার মোঃ সোলাইমান ওই সময় বক্তব্য দেন যে, রিসোর্টটি দুই মাসের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন মেজর (অব.) সিনহা মোঃ রাশেদ খান। তারা সংখ্যায় একজন বিদেশীসহ চারজন হলেও আলাদা আলাদা কক্ষে থাকতেন। রিসোর্টে দুজনকে রেখে ৩১ জুলাই বিকেলে মেজর সিনহা ও সিফাত প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফে শূটিং করতে যান। রাত দুইটার দিকে রিসোর্টের একজন কর্মচারী মুঠোফোনে জানায় যে, রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে কিছু মদের বোতল ও গাঁজা উদ্ধার দেখিয়েছে।
ঢাকায় লাশ দাফন : ১ আগষ্ট সকালে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহ স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদের মৃতদেহ কক্সবাজার থেকে ২ আগষ্ট ঢাকায় নেয়া হয়। মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাযার পূর্বে সেনানিবাসের একটি চৌকস সেনাদল সামরিক মর্যাদা প্রদান করে সিনহাকে।
সিনহার পরিচয় ও ঠিকানা : সিনহা মোঃ রাশেদ খান ১৯৮৪ সালের ২৬ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম আদনান। ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করার পর সিনহা মোঃ রাশেদ ৫০তম বিএমএ লংকোর্সের একজন কর্মকর্তা হিসেবে ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর মাত্র ২০ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ যশোরের বীর হেমায়েত সড়কের বাসিন্দা। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এরশাদ খানের সন্তান। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত এসএসএফ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) এ একজন বাছাইকৃত চৌকস সেনা অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অবিবাহিত সিনহা ওরফে আদনান ২০১৮ সালে মেজর পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন।
সিনহার পিতা ছিলেন কক্সবাজারের উখিয়ার ইউএনও : নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানের পিতা এরশাদ খান কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৭-৮৮ সালে তিনি উখিয়ায় ইউএনওর দায়িত্বে ছিলেন। যশোরের বীর হেমায়েত সড়কের বাসিন্দা এরশাদ খান ছিলেন ১৯৭১ এর রণাঙ্গনের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এরশাদ খান সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থাকাবস্থায় অবসরে যান।