কাজিরবাজার ডেস্ক :
ষষ্ঠ ধাপে ২১৮ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ ভোটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ২১৬টি ইউপিতে ভোট হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। আর দুই ইউপিতে ভোট হয় ব্যালট পেপারে। সোমবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ করা হয়। সকাল থেকেই তীব্র শীত উপেক্ষা করে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। দিন যত বাড়ে ভোটার উপস্থিতিও ততই বাড়ে। ইভিএমে ভোট নেয়ার ক্ষেত্রে কোন কোন কেন্দ্রে জটিলতা দেখা দেয়। এছাড়া অধিকাংশ কেন্দ্রেই ইভিএমের কারণে ভোট গ্রহণে ধীরগতি এবং আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় বয়স্কদের মধ্যে কেউ কেউ ভোট দিতে পারেননি। আর ভোট দিতে গিয়ে অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানেননি, মুখে মাস্ক ছাড়াই কেন্দ্রে প্রবেশ করেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের মেয়াদের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করে উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য আগে থেকেই ভোট কেন্দ্রগুলোকে কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখে। তাই শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করে। তবুও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু এলাকায় পরস্পরবিরোধী প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়াসহ ছোটখাট কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে। এর সঙ্গে জড়িত থাকায় পুলিশ আটক করে বেশ ক’জনকে।
২২ জেলায় ৪২ উপজেলার ২১৮টি ইউপি নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৪১ লাখ ৮২ হাজার ২৬৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২১ লাখ ১৪ হাজার ৭২০ ও নারী ভোটার ২০ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৭ জন। এছাড়া ছয়জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ছিল। ভোটারদের ভোটদানের সুবিধার্থে ২ হাজার ১৮৬টি কেন্দ্রে ১৩ হাজার ৩০৫টি কক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়। তবে ২১৮ ইউপির মধ্যে ২১৬টিতে ইভিএমে ভোট হওয়ায় আগের ৫ ধাপের তুলনায় এবার কম ভোট পড়েছে। এবার বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১১ হাজার ৬০৪ প্রার্থী। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১ হাজার ১৯৯ জন। সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ২ হাজার ৫৫৯ এবং সাধারণ সদস্য পদে ৭ হাজার ৮৪৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ৫ম ধাপের নির্বাচনের দিন সহিংস ঘটনায় ৬ জন নিহত এবং বেশ ক’জন আহত হন। এ কারণে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৬ষ্ঠ ধাপের নির্বাচনের একদিন আগে রবিবার থেকেই প্রতিটি নির্বাচনী এলাকাকে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে আনে। ভোটগ্রহণকালে প্রতিটি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ জন করে সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। সব ইউপিতে পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে একটি করে মোবাইল ফোর্স টিম এবং প্রতি ৩টি ইউপিতে ১টি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স টিম মোতায়েন করা হয়েছিল। আর প্রতিটি উপজেলায় র্যাবের ২টি মোবাইল টিম ও একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স টিম, বিজিবির ২টি মোবাইল ফোর্স টিম ও ১টি স্ট্রাইকিং ফোর্স টিম দায়িত্ব পালন করেছে।
ভোটের আগেই ষষ্ঠ ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ১৪৪ প্রার্থী। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১২ জন, সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ৩২ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ১০০ জন। এর আগে সারাদেশে ৫ ধাপে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গতবছর ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর দুই পর্বে প্রথম ধাপের ৩৬৯টি ইউপিতে এবং ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর পর ২৮ নবেম্বর তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ৭ ইউপিতে ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপে ৮৪০টি ইউপিতে এবং এ বছর ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপে ৭০৭ ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তম ধাপে ১৩৮ ইউপিতে নির্বাচন হবে ৭ ফেব্রুয়ারি এবং আরও ৮টি ইউপিতে নির্বাচন হবে ১০ ফেব্রুয়ারি। বর্তমানে দেশে চার হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এর মধ্যে অল্প কিছু ইউপি ছাড়া বাকি সব ইউপির নির্বাচনই ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হয়ে যাবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিদায় নেবে। তারপর নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে বাকি ইউপির নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ইতোমধ্যে ৯ বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে প্রথম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয়, ১৯৮৩ তৃতীয়, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ, ১৯৯২ সালে ৫ম, ১৯৯৭ সালে ৬ষ্ঠ, ২০০৩ সালে ৭ম ও ২০১১ সালে ৮ম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নবম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দলীয় প্রতীকে। আর এবার দ্বিতীয়বারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বৈঠক শেষে ইসি সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার ৬ষ্ঠ ধাপের ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল ৩ জানুয়ারি। ৬ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র বাছাই করা হয়। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপীল ৭ থেকে ৯ জানুয়ারি এবং আপীল নিষ্পত্তি করা হয় ১০ থেকে ১২ জানুয়ারি। আর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিল ১৩ জানুয়ারি এবং প্রতীক বরাদ্দ করা হয় ১৪ জানুয়ারি।
শীতের কারণে ভোটের হার কম- ইসি সচিব : ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে ইসি সচিব মোঃ হুমায়ুন কবীর খোন্দকার জানান, দেশে প্রচন্ড শীত পড়ার কারণে ষষ্ঠ ধাপে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়ার হার কম। তবে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু এবং সুন্দর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি আরও জানান, ইভিএমে ভোটগ্রহণে ধীরগতি ছিল। এতে ভোট কম পড়েছে। ৫৫ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে।
ইসি সচিব বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কোন অপ্রীতিকর খবর পাওয়া যায়নি। কোন কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়নি। তিনি বলেন, ইভিএমে ভোট নেয়ার আগে আমরা মক ভোট নেই। প্রত্যাশা থাকে ভোটাররা আসবেন। কিন্তু তারা অনেকেই আসেন না। আমাদের সম্মানিত মা-বাবা যারা থাকেন, তারা ভোট দিতে এলে বোঝাতে সময় লেগে যায়। ফলে বাইরে দীর্ঘ লাইন হয়। এই কারণে অনেক মা হয়ত ভোট না দিয়েই ফেরত চলে যান।
ইসি সচিব বলেন, এনআইডি ও আঙ্গুলের ছাপ না মিললে কোনভাবেই ইভিএমে ভোট দেয়া যায় না। এই কারণে মাঠ কর্মকর্তাদের ইভিএমের প্রতি ঝোঁক কম। কারণ কাগুজে ব্যালটে ভোট দেয়ার প্রক্রিয়া সহজ।
আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে পারেননি ৩ মেম্বার প্রার্থী : মুরাদনগর উপজেলার টনকী ইউনিয়নের সোনারামপুর কেন্দ্রে ৪ মেম্বার প্রার্থীর মধ্যে ৩ জনই নিজের ভোট দিতে পারেননি। আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে পারেননি তারা। ইভিএমের কারণে তারা ভোট দিতে পারেননি বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন। ভোট দিতে না পারা ৩ মেম্বার প্রার্থীরা হলেন- জসিম উদ্দিন জজ মিয়া (আপেল), আমির হোসেন (তালা) ও মোঃ সোহেল (মোরগ)। জসিম উদ্দিন (জজমিয়া) জানান, আমি ৫ বার চেষ্টা করছি। কিন্তু আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে পারিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৪ ইউপিতে ভোট : নবীনগর ও কসবা উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটগ্রহণকালে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে কসবার বায়েক ইউনিয়নের অষ্টজঙ্গল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ৪ প্রার্থীর এজেন্টকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গোপালপুরে উৎসবমুখর ভোট : গোপালপুরের ৫ ইউনিয়নে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তীব্র শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকেই ভোটাররা নিজ নিজ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরে তারা খুশি।
কুড়িগ্রামে ৮ ইউনিয়নে শান্তিপূর্ণ ভোট : চিলমারী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে উৎসবমুখর পরিবেশে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়েছে। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটারের উপস্থিতি ছিল বেশি। তবে দুর্গম চরাঞ্চলে এবারই প্রথম ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ হওয়ায় ভোট গ্রহণে ছিল ধীরগতি।