কাজিরবাজার ডেস্ক :
স্থানীয় সরকার নির্বাচন যে উদ্দেশ্যে আইন করে দলীয় প্রতীকে করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বরং দলীয় প্রতীক, কোন্দল ও সহিংসতায় ভোটের উৎসব ম্লান হয়ে গেছে। হয়ে যাওয়া তিন ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেই উৎসবহীন ভোটের চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। ২৬ ডিসেম্বর, ৫ জানুয়ারি ও ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ ধাপের নির্বাচন সামনে রেখেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদিকে এবারের ইউপি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দলীয় প্রতীক ছাড়া স্থানীয় নির্বাচনের দাবি জোরদার হচ্ছে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার পাঁচ বছর আগে আইন করে ইউপিসহ সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার ব্যবস্থা করেছিল- তা সফলতা বয়ে আনার পরিবর্তে সরকারের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। চলমান ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও কোন্দল-গ্রুপিং ও প্রাণহানির কারণে সরকারের সকল অর্জন প্রশ্নের মুখোমুখি। ইতোমধ্যেই তিন ধাপের নির্বাচনে শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে অধিকাংশই সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থক। এ পরিস্থিতিতে সরকার দলীয় অনেক নেতাকর্মী দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের বিষয়টি সামনে এনেছেন। খোদ আইনমন্ত্রীও তার নিজের নির্বাচনী এলাকায় দলীয় প্রতীক ছাড়া ইউপি নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছেন।
ইউপি হচ্ছে স্থানীয় সরকারের একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচন। তাই এ নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রতিটি গ্রামপর্যায়ে এমনকি পাড়া-মহল্লার মানুষ বেশি ততপর থাকে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য সবাই চায় তাদের পছন্দের মানুষটি যেন ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আর এতেই বিপত্তি ঘটে। বিশেষ করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় এবং বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন দলগতভাবে বর্জন করায় সরকারী দল আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা যারা পাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
এদিকে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় অনেক ভাল প্রার্থী এখন আর নির্বাচন করতে চান না। আর বিভিন্নভাবে লবিং ও অর্থ খরচ করতে না পারায় অনেক সময় তৃণমূলের ভাল প্রার্থীরা দল থেকে মনোনয়ন পায় না। তাই তারা হতাশ হয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এর ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বেড়ে যায়। এ পর্যন্ত পাঁচ ধাপের ইউপি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ১ হাজার ৫৭৬ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান ৩৫৪ জন, সাধারণ ওয়ার্ড সদস্য ৮৫৮ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য ৩৬৪ জন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের মধ্যে সিংহভাগই সরকারী দল সমর্থক।
২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন ২১৭ জন। তার আগের নির্বাচনগুলোতে এ সংখ্যা আরও অনেক কম। আর এবার পাঁচ ধাপেই নির্বাচিত হয়েছেন ৩৫৪ জন চেয়ারম্যান। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় পঞ্চম ধাপের ৭১৪টি ইউপির নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগেই ৫২ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য ৩২ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ডের ১০৯ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় চতুর্থ ধাপে ৮৪২টি ইউপি নির্বাচনে ভোটের আগেই চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪৮ জন নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য ১১২ জন এবং সাধারণ সদস্য ১৩৫ জন নির্বাচিত হয়েছেন। ২৮ নবেম্বর অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপের এক হাজার সাত ইউপির মধ্যে ১০০টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া সাধারণ সদস্য পদে ৩৩৭ জন এবং সংরক্ষিত নারী সদস্য ১৩২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১১ নবেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৩টি ইউপির মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৮১ জন, সংরক্ষিত নারী সদস্য ৭৬ জন এবং সাধারণ সদস্য ২০৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর আগে ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর দুই দফায় প্রথম ধাপের নির্বাচন হয়। ২০ জুন অনুষ্ঠিত ২০৪টি ইউপির মধ্যে ২৮ জন চেয়ারম্যান নারী সদস্য পাঁচজন এবং সাধারণ সদস্য পদে ২৯ জন নির্বাচিত হন। আর ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ১৬১ ইউপির মধ্যে ৪৫ জন চেয়ারম্যান, নারী সদস্য সাতজন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৪৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ষষ্ঠ ধাপে ২১৯টি ইউপিতে নির্বাচন ৩১ জানুয়ারি হবে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় পার হলে জানা যাবে এ নির্বাচনে কতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন।
অবশ্য দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাসহ অন্য কমিশনাররা ইউপি নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। আর তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের পর সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এবারের ইউপি নির্বাচনে হতাশাজনক পরিস্থিতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অধিকাংশ ইউপিতেই দলীয় প্রতীক না পেয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েও অনেক জায়গায় ভোটে জিতে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ায় সরকারী দল আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। তাই দেশব্যাপী চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে বিরূপ পরিস্থির শিকার হতে হচ্ছে। আর এ কারণেই আইন সংশোধনের পাঁচ বছরের মাথায় আবার আগের মতো প্রতীক ছাড়া ইউপি নির্বাচনের দাবি জোরদার হচ্ছে।
ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো আগে থেকেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছে। আর তিন ধাপের ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও জানমালের ক্ষয়-ক্ষতির পর এখন সরকারী দলের কোন কোন নেতাও বলছেন, ইউপি নির্বাচনকে দলীয় প্রতীকমুক্ত করার বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। সবার আগে ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র মনোনয়নের সুযোগ চেয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের কাছে চিঠি লিখেছিলেন নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী। এরপর নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ সেলিম ওসমানও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখার দাবি জানিয়েছেন। পরবর্তীতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও তার নিজ নির্বাচনী এলাকায় দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের কথা বলেছেন। এতেই মনে হচ্ছে, দেরিতে হলেও সরকারী দলের নেতাদের বোধোদয় হয়েছে।
আইনমন্ত্রী ছাড়াও রাষ্ট্রপতির এলাকা কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলার ২৪ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। পঞ্চম ধাপে ৫ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার সাত ইউনিয়নে এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার আট ইউনিয়নে ভোট হবে। অন্য একটি উপজেলার নয় ইউপি নির্বাচন পরে হবে। একই মত এসেছে প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জেও। এই জেলা সদরের ২১টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৫টির নির্বাচন ২৬ ডিসেম্বর। এর আগে কাশিয়ানী উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়েছে দলীয় প্রতীক ছাড়া।
আগের তিন ধাপের ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার কারণে ১০০ মানুষ মারা যান। এর মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মী। দলের চরম দুর্দিনে এ সব নেতাকর্মীরাই তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন। তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন কেউ মারা না গেলেও ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা শুরুর পর থেকে পরবর্তী কয়েকদিনে ২০ জন মারা যান। এ ছাড়া পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করেও এ পর্যন্ত কয়েকজন মারা গেছেন।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে নির্বাচন করতে পারছেন না। কেউ কেউ দলের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলেও অন্যরা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। আবার কোন কোন ইউপিতে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী হন আওয়ামী লীগ থেকেই। আর এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোন কোন এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীরা ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন।
তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে কখনও কখনও দলের জন্য অপেক্ষাকৃত কম নিবেদিত এবং দুর্বল প্রার্থী কেন্দ্র থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে আসেন। তখন এলাকার সক্রিয় নেতাকর্মীরা তার পক্ষে কাজ না করে অপেক্ষাকৃত দলের জন্য বেশি নিবেদিত ও জনপ্রিয় প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেন। তবে নৌকা প্রতীক পাওয়া প্রার্থী বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে বিদ্রোহী প্রার্থীকে দমিয়ে রেখে নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করেন। আর এ কারণেই স্থানীয়ভাবে দলের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণের চেষ্টা করে। এ কারণে এলাকায় এলাকায় সংঘাত-সহিংসতা সৃষ্টি হয়। আর নির্বাচনে উৎসবের আমেজ ম্লান হয়।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হওয়ায় অনেক সময় সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী বিজয়ী না হয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যান। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ সঠিক জনপ্রতিনিধি না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। কখনও কখনও অধিকতর সৎ, শিক্ষিত, মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থী দলীয় প্রতীক না পেয়ে নির্বাচন থেকেই সরে দাঁড়ান। আবার দলের কোন পদে নেই, কিন্তু দলের সমর্থক এলাকার অনেক জনপ্রিয় লোক ইচ্ছে করলেও দলীয় প্রতীক না পাওয়ায় নির্বাচন করতে পারেন না। এর ফলে অনেক ভাল মানুষ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি হওয়া থেকে বঞ্চিত হন। তাই স্থানীয় সরকার দুর্বল হয়। এ সব কিছু বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগের একটি অংশ প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বার্তা দেন। এই বার্তা এখন দল ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনের পর ২৫ অক্টোবর সরকারী দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে মতামত নেয়া হয়। নেতাদের কাছে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি জানতে চান, এভাবে নির্বাচন করায় দলের কী লাভ বা কী ক্ষতি হচ্ছে। আর কেনইবা ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এত সহিংসতা হচ্ছে। তখন বেশ ক’জন নেতা সারাদেশে ইউপি নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরে প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের প্রস্তাব দেন।
সূত্র মতে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেশে প্রায় ৫ হাজার ইউনিয়ন পরিষদে আবার প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের কথা ভাবছে সরকার। এ নিয়ে ফাইলওয়ার্কও করা হচ্ছে। তবে প্রতীক ছাড়া নির্বাচন পদ্ধতি চালু করতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে বিধায় তা শীঘ্রই করা সম্ভব হচ্ছে না। এবার বাকি ইউপি নির্বাচনও দলীয় প্রতীকেই হবে। তবে পরবর্তীতে আইন সংশোধন করে ইউপিসহ সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীক ছাড়া করার ব্যবস্থা করা হবে।
দেশের নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউপি নির্বাচনে কাউকে দলীয় প্রতীক না দিয়ে নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হলে অপেক্ষাকৃত ভাল প্রার্থী বিজয়ী হবেন। আর তখন প্রশাসনের লোকেরাও সব প্রার্থীর দিকে সমান নজর রাখবেন। কিন্তু এখন যেই প্রার্থী সরকারী দলের প্রতীক পান, তার প্রতি প্রশাসনের সুনজর থাকে। এর ফলে এই প্রার্থী অপেক্ষাকৃত বেশি প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন। আর এই প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই সংঘাত-সহিংসতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনী আইন সংশোধনের মাধ্যমে ইউপি নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করার বিধান করা হয়। সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো তখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিরোধিতা করেছিল। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতাও এমনটি চাননি। তবে দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত হওয়ায় এ বিষয়ে তখন আওয়ামী লীগের কেউ বিরোধিতা করেননি। কিন্তু এখন এ নিয়ে দলের অনেক নেতাকর্মীই মুখ খুলছেন। কারণ, নির্বাচনে একজনকে দলীয় প্রতীক নৌকা দিলে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে যাচ্ছেন। ফলে প্রতিটি এলাকায় নিজেদের মধ্যে বিভেদ-বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রথম ধাপে সারাদেশের ৩৭১টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগ ইউপিতে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হলেও কয়েকজন ওই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীও বিজয়ী হন। অবশ্য কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও বিজয়ী হয়েছেন। ১১ নবেম্বর দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত হয় ৮৩৬টি ইউপির নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল এক হাজার। তৃতীয় ধাপে নির্বাচন হয় এক হাজার সাতটি ইউপিতে। এতে অর্ধেকের কাছাকাছি বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়। এসব বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে কারও কারও জন্য কাজ করেরছেন স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরাও। এ কারণে এই বিদ্রোহী প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের পাত্তা দেয়নি। তবে অধিকাংশ স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রীরা কাজ করেছেন দলীয় প্রার্থীর পক্ষে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, আইন সংশোধন করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কার্যকর করা হবে। সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের সকল আইন পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করতে সংশোধন করা হচ্ছে। আইন সংশোধন হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি শক্তিশালী, কার্যকর ও সক্ষম হবে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর কোথাও কোন দুর্বলতা থাকলে সেগুলো খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি আরও জানান, সারাবিশ্বে গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যত বেশি শক্তিশালী করা যাবে দেশের উন্নয়ন তত বেশি ত্বরান্বিত হবে। তাই জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।