কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশীদের জন্য আবারও উন্মুক্ত হলো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। দেশটির মন্ত্রিসভা এখন থেকে সব পেশার শ্রমিক নেয়ার অনুমোদন দেয়ায় বাংলাদেশীদের জন্য উন্মুুক্ত হলো শ্রমবাজার। শুক্রবার এক বিবৃতিতে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানান জানান, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পরপরই বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ কার্যকর করা হবে। গৃহকর্মী, বাগান, কৃষি, উৎপাদন, পরিষেবা, খনি ও খনন এবং নির্মাণ খাতে বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ দেবে মালয়েশিয়া। বিদেশী কর্মীদের জন্য স্থায়ী অপারেটিং পদ্ধতি পরিমার্জন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সহযোগিতা করবে। এছাড়া ১ জানুয়ারি থেকে ১ জুলাই ২০২২ সাল পর্যন্ত বহুস্তরের লেভি বাস্তবায়ন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির মন্ত্রিসভা।
মালয়েশিয়া প্রবাসী গণমাধ্যমকর্মী নাজনীন সুলতানা জানান, এবার সবার আগে যাচ্ছে নিরাপত্তা কর্মী। চলমান করোনা মহামারীর মধ্যেই বাংলাদেশী নিরাপত্তারক্ষী বা গার্ডের নিয়োগ দিতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়ে গেছে সম্প্রতি। এতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ সেনা কল্যাণ সংস্থা ও মালয়েশিয়ার সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রি এ্যাসোসিয়েশন পি আই কে এম এর প্রতিনিধিরা। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সালে এমওইউ সই হলেও বাংলাদেশী নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ করা যায়নি। মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে এটি আটকে যায়। এখন নতুন এমওইউ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দেশটিতে নতুন দুয়ার উন্মুক্ত হলো।
এ দু’দেশের মধ্যে অভিবাসী কর্মী সংক্রান্ত একটি সমঝোতা চুক্তি হওয়ায় এবার আর অতীতের মতো কোন ধরনের সিন্ডিকেট হবে না। কর্মী পাঠানোর সুযোগ পাবেন সবাই। তবে প্রথম দফায় যাবে প্রায় ৪০ হাজার নিরাপত্তা কর্মী। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হয়ে যাবার পর পরই দেখা দেয় করোনা মহামারী। নইলে এতদিনে চালু হয়ে যেত এই বিশাল শ্রমবাজারটি। এবার ডাটাবেজ ভিত্তিতে কর্মী পাঠানোর সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা কর্মী ও কৃষি খাতে প্রথম দফায় শ্রমিক যাবে। তারপর বাকি কোঠায়।
জানা গেছে, নিরাপত্তা রক্ষীর অভাব মেটাতে বাংলাদেশের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সের কর্মী নিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে মালয়েশিয়া। প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার কারণে এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক লাইসেন্স থাকা বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তবে নিয়োগের পদ্ধতি, সুবিধা ও শুরুর সময় এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে পি আই কে এম সভাপতি রামলি ইউসুফ মালয়েশিয়া কিনি কে বলেন, তিন মাসের প্রশিক্ষণের কারণে বাংলাদেশীরাই গার্ডের নিয়োগে সেরা হয়েছে। সে কারণেই তিনটি দেশের মধ্যে কেবল বাংলাদেশের নাম সুপারিশ করেছেন তারা। বিষয়টি দ্রুত অনুমোদন দিতে স্বররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেও অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আরও জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় নেপালী রক্ষীদের দশ বছর পর্যন্ত কাজের অনুমতি দেয়া হয়। এতে নতুন করে অভিবাসী শ্রমিক আসার নিষেধাজ্ঞা থাকায় চল্লিশ হাজার থেকে ১০-১৫ হাজারে নেমে এসেছে। আরও অনেকে দেশে ফেরত যেতে চাইছে। এসব শূন্য পদে বাংলাদেশী নিরাপত্তারক্ষী আনা হবে। মালয়েশিয়া এবং অন্যান্য দেশের ভবিষ্যত নিরাপত্তারক্ষী প্রেরণের লক্ষ্যে চিহ্নিতকরণ এবং প্রশিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে। ২০১৮ সালের প্রথম স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার নবায়ন করা হয়েছে। এর আগে ২৫ নবেম্বর নিরাপত্তা পরিসেবা শিল্প ও বেসরকারী সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের পর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জয়নুদ্দিন বলেছেন নিরাপত্তা খাতে নতুন সোর্স কান্ট্রি বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে মন্ত্রণালয় বিষয়টি উত্থাপন করবে। ভবিষ্যতে যাতে কোন সমস্যা না হয় তা নিশ্চিত করতে স্টক হোল্ডারদের সঙ্গে আরও আলোচনা করবে। এটি অবশ্যই বাংলাদেশীদের জন্য ভালো খবর। খুব শীঘ্রই এ প্রক্রিয়া শুরু হবে।
উল্লেখ্য প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে বছর তিনেক আগে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার। এর আগে ২০১৬ সালে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র দেয়ার কাজ পায় সিনারফ্ল্যাক্স নামের একটি মালয় কোম্পানি। বাংলাদেশের এক হাজার ৩০০ রিক্রুটিং এজেন্সি থাকলেও মাত্র ১০টি এজেন্সির সিন্ডিকেট শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ পায়- যা টপ টেন নামে পরিচিত। এ সিন্ডিকেটের সদস্য হচ্ছে- আমিন ট্যুর এ্যান্ড ট্রাভেলস, ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড, ক্যারিয়ার ওভারসিস রিসোর্স, আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, শানজারি ইন্টান্যাশনাল, রাব্বি ইন্টান্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসেজ এ্যাসোসিয়েটস, আল ইসলাম ওভারসিস এবং প্রান্তিক ট্রাভেল এ্যান্ড ট্যুরিজম। এসব এজেন্সির কয়েকটি ছিল ওই সময়ের মালয়েশিয়ার কয়েকজন মন্ত্রী, এমপির পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। তখন জিটুজি প্লাস এর আওতায় ২০১৭ সালের মার্চে কর্মী পাঠানো শুরু হয়। পাঁচবছরে ১৫ লাখ কর্মী পাঠানোর ঘোষণা থাকলেও দুই বছরে পৌনে তিন লাখ বাংলাদেশী এ পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় যান। কর্মীপ্রতি অভিবাসন ব্যয় সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার নির্ধারণ করা হলেও একজন কর্মীও তিন লাখ টাকার কমে যেতে পারেননি। দুর্নীতির জন্য এই পদ্ধতি দু’দেশেই সমালোচিত হয়। ২০১৮ সালে মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় ফেরার পর তদন্তে জানা যায়-জিটুজি প্লাসে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। দুই দেশের সিন্ডিকেট এই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ কারণে জিটুজি প্লাসে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া।
এদিকে এবারও সাধারণ এজেন্সি মালিকদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, ২০১৬ সালের মতো হাতেগোনা কয়েকটি এজেন্সিকে নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটই কর্মী পাঠানোর কাজ পেতে যাচ্ছে। কিন্তু মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে গত এক যুগের অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতিবারই কর্মীরা প্রতারণা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে মালয়েশিয়া। দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১২ সালে সরকারী ব্যবস্থাপনায় (জিটুজি) কর্মী নিতে রাজি হয়। কিন্তু এ পদ্ধতি সফল না হওয়ায় ২০১৬ সালে বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যুক্ত করে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে দুই দেশ সমঝোতা স্মারক সই করে।