কাজিরবাজার ডেস্ক :
মোটরচালিত অটোরিক্সা, ইজিবাইক, নসিমন, করিমন, ভটভটি বন্ধ না করে এগুলো চলাচলের এলাকা নির্ধারণ করে দেবে সরকার। একইসঙ্গে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) এসব যানের সংখ্যা বেঁধে দেবে বা সিলিং নির্ধারণ করে দেবে। সেই অনুযায়ী নিবন্ধন দেবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এছাড়া এসব যানের ভাড়াও নির্ধারণ করে দেয়া হবে।
এজন্য থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা করছে সরকার। এরই মধ্যে খসড়া ‘থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা, ২০২১’ প্রণয়ন করে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিচ্ছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
যদিও সড়ক নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন অটোরিক্সা, ইজিবাইক, নসিমন, করিমন, ভটভটি বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকেও এগুলো বন্ধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।
গত ২০ জুন সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্সের সভার সিদ্ধান্ত তুলে ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, মোটরচালিত রিক্সা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পর্যায়ক্রমে আলোচনা করে ইজিবাইক, নসিমন, করিমন ও ভটভটিও বন্ধ করে দেওয়া হবে।
খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় শহরের মধ্যে অটোরিক্সা এবং শহরের বাইরে ও উপজেলায় নির্ধারিত রুটে অটোরিক্সা ও অটোটেম্পু চলাচলের রুট পারমিট দেওয়া যাবে। শুধুমাত্র উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের স্থানীয় রুটে রুট পারমিট নিয়ে ইজিবাইক নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু চলাচল করতে পারবে।
খসড়া নীতিমালার ভূমিকায় বলা হয়েছে, প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন মহাসড়ক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু সেই অর্থে সুষ্ঠু, নিরাপদ, আধুনিক গণপরিবহন এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রায়ই দেখা যায়, অনুমোদিত মোটরযানের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক অপ্রচলিত ঝুঁকিপূর্ণ থ্রি-হুইলারসহ ছোট আকারের সমজাতীয় মোটরযান ব্যাপকহারে অপরিকল্পিতভাবে সড়ক পরিবহন সেক্টরে সংযুক্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার ২০১৫ সাল থেকে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার অটোরিক্সা/অটোটেম্পু ও সকল শ্রেণির অযান্ত্রিক বাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯০টি, এর মধ্যে ভাড়ায় চালিত বাস ৪৯ হাজার ১৬টি (১ দশমিক ১ শতাংশ) এবং মিনিবাস ২৭ হাজার ৪৩৯টি (০ দশমিক ৫৬ শতাংশ)। অপরদিকে অটোরিক্সা ও অটোটেম্পু ৩ লাখ ১৯ হাজার ৫৬৯টি (৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ) যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। পাশাপাশি সারাদেশে নিবন্ধনহীন বহু সংখ্যক অননুমোদিত থ্রি-হইলার, ইজিবাইক, নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি নামে ছোট ছোট মোটরযান চলাচল করছে এবং এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ছোট আকারের এসব অনিবন্ধিত ও অননুমোদিত যানবাহন কারিগরিভাবে সড়ক নিরাপত্তার জন্য উপযোগী নয় উল্লেখ করে নীতিমালায় বলা হয়, এসব যানবাহনের নিরাপত্তা ইউনিট বিশেষ করে ব্রেক, স্টিয়ারিং, সাসপেনশন মানসম্মত নয়। তাছাড়া ভারসাম্যহীন এ ধরনের যানবাহনের স্থায়ীত্বও কম। অল্প নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসম্পন্ন ধীরগতির এসকল ছোট যানবাহন দ্রুতগতি সম্পন্ন মোটরযানের সঙ্গে একই মহাসড়কে চলাচলের সময় গতির পার্থক্য এবং নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
‘বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সিংহভাগই ছোট ছোট মোটরযানের যাত্রী। সার্বিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ছোট মোটরযানের মহাসড়কে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সাশ্রয়ী পরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত এসব মোটরযানকে কারিগরিভাবে ত্রুটিমুক্ত করে অনুমোদিত ডিজাইন অনুসরণপূর্বক নির্মাণ করা হলে নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেকাংশে কমবে বলে আশা করা যায়।
এই প্রেক্ষাপটে মহাসড়কে অপ্রচলিত ঝুঁকিপূর্ণ ছোট যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং এর কারিগরি মান উন্নয়নের মাধ্যমে স্থান বিশেষে চলাচলের বিষয়ে সুপারিশমালা প্রণয়নে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ, পরিবহন সেক্টরের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি নিয়ে ২০১৯ সালের ২৩ জুন ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত ১০ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপর এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের জন্য বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে গঠিত কমিটি সুপারিশমালার খসড়া করে। মূলত সুপারিশগুলোর ভিত্তিতে এ নীতিমালার খসড়া করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা।
নীতিমালা অনুযায়ী থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযান বলতে অটোরিক্সা (চালকসহ সর্বোচ্চ চার আসনবিশিষ্ট থ্রি-হুইলার), অটোটেম্পু (চালকসহ সর্বোচ্চ সাত আসনবিশিষ্ট থ্রি-হুইলার), ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক, পাখি), স্থানীয়ভাবে তৈরি করা থ্রি-হুইলার (নছিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু) ইত্যাদিকে বোঝাবে।
অটোরিক্সা, অটোটেম্পু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ
খসড়ায় বলা হয়েছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ছাড়া অন্যান্য নির্দিষ্ট এলাকা বা রুটে রুট পারমিট নিয়ে অটোরিক্সা, অটোটেম্পু চলাচল করতে পারবে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় শহরের অভ্যন্তরে অটোরিক্সা এবং শহরের বাইরে ও উপজেলায় নির্ধারিত রুটে অটোরিকশা ও অটোটেম্পু চলাচলের রুট পারমিট দেওয়া যাবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) নির্ধারিত সিলিং অনুযায়ী বিআরটিএ অটোরিক্সা ও অটোটেম্পু রেজিস্ট্রেশন দেবে।
যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) সিলিং নির্ধারণ করবে। এই সিলিং অনুযায়ী অটোরিক্সা ও অটোটেম্পু বিক্রয় করতে হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মাধ্যমে অটোরিক্সা ও অটোটেম্পুর এই নির্ধারিত সংখ্যা সীমা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানাবে।
বিআরটিএ সিলিং অনুযায়ী সংখ্যা হালনাগাদ রাখবে এবং সে অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অটোরিক্সা ও অটোটেম্পু আমদানির অনুমোদন দেবে।
রুট পারমিট পাওয়া অটোরিক্সা, অটোটেম্পু ও এ জাতীয় যানবাহন কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেওয়া ভাড়ায় চলাচল করবে।
অটোরিক্সা ও অটোটেম্পু চলাচলের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিদ্যমান পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী নিঃসরণ মানমাত্রা অনুসরণ করবে।
কন্ট্রাক্ট ক্যারিজ হিসেবে চলাচলের ক্ষেত্রে অটোরিক্সার চালক স্বল্প দূরত্বসহ সরকার নির্ধারিত এলাকার মধ্যে যে কোনো দূরত্বে যেতে বাধ্য থাকবে এবং কোনো রকম অস্বীকৃতি জানাতে পারবে না। তবে অটোটেম্পু রুট পারমিটে উল্লেখিত রুটে স্টেইজ ক্যারিজ হিসেবে এবং অটোরিক্সা দেশের সকল মহানগর এলাকা ছাড়া রুট পারমিটে উল্লেখিত রুটে স্টেইজ ক্যারিজ হিসেবে চলাচল করতে পারবে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকৃত অটোরিক্সার ক্ষেত্রে সিএনজি বা পেট্রোলচালিত ৪-স্ট্রোক থ্রি-হুইলার সার্ভিস নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, পাখি ইত্যাদি মোটরযান ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ
শুধুমাত্র উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের স্থানীয় রুটে রুট পারমিট নিয়ে ইজিবাইক চলাচল করতে পারবে, তবে এ রুটের কোনো অংশ মহাসড়ক বা আঞ্চলিক মহাসড়কের অংশ হতে পারবে না। রুট নির্ধারণের ক্ষেত্রে উপজেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটির মতামতের ভিত্তিতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি রুট পারমিট দেবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি নির্ধারিত সিলিং অনুযায়ী বিআরটিএ ইজিবাইকের রেজিস্ট্রেশন দেবে।
বর্তমানে চলাচলরত ইজিবাইক সিটি করপোরেশন, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের প্রধান সড়কে চলতে পারবে না, তবে ছোট রাস্তা বা গলিতে নীতিমালা জারির তারিখ থেকে দুই বছর পর্যন্ত চলাচল করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। দুই বছর পর ইজিবাইক প্রত্যাহার করতে হবে এবং কোনো রিপ্লেসমেন্ট প্রদান করা হবে না।
ইজিবাইক রেজিস্ট্রেশন ও সিলিং নির্ধারণের আগে এ ধরনের বাহনের সর্বজন গ্রাহ্য এবং যাত্রী সুরক্ষার ব্যবস্থা সংবলিত অনুমোদিত ডিজাইন বা ড্রইং নির্ধারণ করতে হবে। যা যে কোনো পাবলিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশ সাপেক্ষে বিআরটিএ’র মাধ্যমে টাইপ অনুমোদিত হতে হবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) সিলিং নির্ধারণ করবে এবং এই সিলিং অনুযায়ী ইজিবাইক, পাখি ইত্যাদি প্রস্তুত বা বিক্রি করতে হবে। বিআরটিএ’র অনুমোদন নিয়ে সিলিং অনুযায়ী ইজিবাইক, পাখি ইত্যাদি প্রস্তুত ও বিপণন করতে হবে এবং বিআরটিএ এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান বার্ষিক ভিত্তিতে সরকারকে জানাতে হবে।
রুট পারমিট পাওয়া ইজিবাইক নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল করবে। ইজিবাইক বা এ জাতীয় যানে অবশ্যই মানসম্পন্ন ব্যাটারি ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদিত ব্যাটারি চার্জিং নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
শুধুমাত্র উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের স্থানীয় রুটে রুট পারমিট গ্রহণ সাপেক্ষে নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ও এ জাতীয় বাহন চলাচল করতে পারবে। তবে এই রুটের কোনো অংশ মহাসড়ক বা আঞ্চলিক মহাসড়কের অংশ হতে পারবে না। উপজেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটির মতামতের ভিত্তিতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি রুট নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী রুট পারমিট দেবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) নির্ধারিত সিলিং অনুযায়ী বিআরটিএ নছিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি বাহনের রেজিস্ট্রেশন দেবে বলে খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা শহরে নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদির চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে সংশ্লিষ্ট যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) বাস, মিনিবাস চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদির রেজিস্ট্রেশন ও সিলিং নির্ধারণের আগে এ ধরনের বাহনের সর্বজন গ্রাহ্য এবং যাত্রী সুরক্ষার ব্যবস্থা সংবলিত অনুমোদিত ডিজাইন বা ড্রইং নির্ধারণ করতে হবে, যে কোনো সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশে বিআরটিএ’র মাধ্যমে টাইপ অনুমোদিত হতে হবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) সিলিং নির্ধারণ করবে এবং সিলিং অনুযায়ী নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি বাহন প্রস্তুত বা বিক্রয় করতে হবে। রুট পারমিট পাওয়া নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল করবে।
থ্রি-হুইলার মোটরযানের জন্য যাত্রী ও গণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) নির্ধারিত সংশ্লিষ্ট এলাকার জন্য নির্দিষ্ট রং নির্ধারণ করবে এবং আরটিসি বিষয়টি তদারকি করবে। চালককে নেভি-ব্লু রংয়ের পোশাক/ইউনিফর্ম পরিধান করতে হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।