ডা. রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ :
ইসলামী জীবন জিজ্ঞাসার পূর্ণতা ও স্থিতিশীলতার জন্য পীরের কাছে বাইয়াতের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরীসিম। বাইয়াত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আনুগত্যের শপথ। নেতৃত্ব মেনে নেয়া, অঙ্গীকার লেনদেন, চুক্তি ও ক্রয় বিক্রয় ইত্যাদি। বায়াত শুধুমাত্র একটি সুরত ইহার হাকিকত খোদার নৈকট্য লাভ করা, এছাড়া অন্য কিছুই নেই। শরিয়ত সমর্থিত সীমা ছাড়া বায়াতের উপর খুব বেশি আকিদা রাখাও ঠিক নয়। কারণ তাহাতে বেদাতের ভয়ও আশঙ্খা বেশি। হওত বা বেদায়াতও হইয়া যেতে পারে।
আর ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় বাইয়াত হল আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের জান ও মালকে ইসলামী জীবনযাত্রার দায়িত্বশীল ব্যক্তির বা হক্কানী পীরের আনুগত্যের শপথের মাধ্যমে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করার ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতির নাম। শরয়ী পদ্ধতি অনুযায়ী হক্কানী পীর বা শায়েখের নিকট বাইয়াত হওয়া শুধু জায়েজই নয় বরং উত্তমও বটে। যেমন- রাসূল (স.) এর হাতে বাইয়াত নেয়ার অর্থ হল আল্লাহ পাকের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা কেননা পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে বাইয়াত গ্রহণকারীর প্রশংসা করা হয়েছে। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বাইয়াত গ্রহণকারীর প্রশংসা করে বলেন, হে নবী! নিশ্চয় যারা আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে তারা মূলত আল্লাহর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে কেননা আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণকালে আল্লাহর কুদরতি হাত তাদের হাতের উপর ছিল।(সূরা ফাতহা-১০)। এমনিভাবে বাইয়াত গ্রহণকারীর উপর আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের উপর সন্তুষ্টি হয়েছেন যখন তারা আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করছিল (সূরা ফাতহা-১৮)। অনুরূপভাবে সহীহ বুখারী ও মুসলিমদের বহু হাদিসে উল্লেখ আছে যে, রাসূল (স.) সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর সাহাবাগণকে বাইয়াত করাতেন এবং রাসূল (স.) এর ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদীন সাহাবাগণকে এবং সাহাবাগণ পরবর্তী তাবেঈনদেরকে বাইয়াত করাতেন।
হযরত আববাদ ইবনে তামীম (রহ.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হাররার ঘটনার দিন যখন লোকজন আব্দুল্লাহ ইবনে হানজালা (রা.) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন তখন ইবনে জায়েদ (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন ইবনে হানজালা (রা.) লোকদের কিসের উপর বাইয়াত গ্রহণ করছেন তখন তাকে বলা হল দ্বীনের উপর অটল থেকে মৃত্যুবরণ করার উপর বাইয়াত গ্রহণ করছেন (বুখারী ৪১৬৭-১৯৫৯)। বাইয়াত গ্রহণকারীর সারা জীবন অঙ্গীকারের উপর অবিচল থাকা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে আল কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যখন অঙ্গীকার কর তখন আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ কর। তোমরা দৃঢ়তার সাথে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করোনা আর তোমরা নিজেদের জন্য আল্লাহকে জিম্মাদার স্থির করেছো তোমরা যা কর তা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক জানেন (সূরা নাহল- ৯১)।
এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূল (স.) শীতের এক সকাল বেলা বের হলেন। মুহাজির ও আনসারগণ তখন পরীখা খননের কাজে লিপ্ত ছিলেন তখন নবী (সা.) বললেন, হে আল্লাহ তুমি আনসার ও মুজাহিরদের ক্ষমা করে দাও। তখন তারা সাড়া দিয়ে জবাব দিলেন আমরাও সেই জামায়াত যারা আজীবন জিহাদ করার জন্য মুহাম্মদ স. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছি (সহীহ বুখারী ৯/৭২০১)। ইমামুল মুসলিমিনের (আমীরের শায়েখ বা হক্কানী পীরের কাছে) বাইয়াত পূর্ণ করা অঙ্গীকারের অন্যতম অংশ এ জন্য বাইয়াত গ্রহণকারীর উচিত অঙ্গিকার পূর্ণ করার ওপর অবিচল ও সুদৃঢ় থাকা। এর থেকৈ বিচ্ছিন্ন থাকা কিংবা বিদ্রোহ করার সুযোগ কারো নেই। বহু সহিহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, ইমানের উপর মৃত্যু হওয়ার জন্য আমিরের বা হক্কানী পীরের হাতে আনুগত্যের (আল্লাহ পাকের হুকুম ও রাসূল (স.) এর সুন্নতের উপর অবিচল থাকার) বাইয়াত হওয়ার শর্ত অন্যথায় জাহিলিয়াতের উপর তার মৃত্যু হবে। হযরত ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল স. থেকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আমীরের হাতে আনুগত্যের বাইয়াত হওয়া ব্যতিত মৃত্যুবরণ করল সে জাহিলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করল (মুসলিম তাবরানী ২২৫)।
অন্য এক হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন যে ব্যক্তি আমীরের ইতায়াত (আনুগত্য) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বের হয়ে মৃত্যুবরণ করল সে অবশ্যই জাহিলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করল (সহিহ মুসলিম ৪৮৯২)।
রাসূল (স.) এর জীবদ্দশায় তার দর্শন লাভেই মানুষ এহসানের স্তরে পৌঁছে যেত পূর্ববতী এবং পরবর্তী ওলি আউলিয়াদের গ্রন্থাবলীতে ব্যাপক হারে এ কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। রাসূল (স.) এর জিয়ারত ও সাক্ষাত লাভই ইহসানের দরজা পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু নবী (স.) এর ইন্তেকালের পরে যতই সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে ততই নূরানী পরিবেশ থেকে দূরত্ব বেড়েই চলছে এবং মানুষের অন্তরের মাঝে ততই জুলমত ও আধার ঝেকে বসছে। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (স.) যেদিন মদিনা মুনাওরায় তাশরীফ এনেছিলেন সেদিন মদিনার প্রতিটি বস্তু আলোচিত হয়ে গিয়েছিল এবং যেদিন রাসূল (স.) ইন্তেকাল করে দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করেন সেদিন প্রতিটা বস্তু আধারে ছেয়ে যায়। আমরা হুজুর (স.) এর ইন্তেকালের পর পবিত্র কবরে মাটি দেয়ার পর হাত ও ঝাড়িনী তখন আমরাই আমাদের অন্তরের নুরানীয়াতের মাঝে পরিবর্তন লক্ষ করি। অর্থাৎ আমাদের অন্তরে সেই পরিশুদ্ধতা ও নুরানীয়াত বিদ্যমান ছিল না। যা হুজুর (স.) এর সাক্ষাতে অনুভূত হতো- (মিশকাত শরীফ পৃষ্ঠা ৫৪৭)।
আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী ও রাসূল (সা.) গণের দরজা বন্ধ হলেও কেয়ামত পর্যন্ত ওলি আউলিয়াদের দরজা খোলা থাকবে এবং ওলিদের কাছ থেকে মানুষ আল্লাহ পাকের সন্ধান লাভ করবে যার কারনে সাধারণ মানুষের জন্য ওলি আওলিয়াদের মহব্বত গ্রহণ করা জরুরী।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) এরশাদ করেছেন, বনী ইসরাইলের নবীগণ তাদের উম্মতগণকে শাসন করতেন এবং যখন কোন নবী ইন্তেকাল করতেন তখন আরেকজন তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোন নবী আসবে না তবে অনেক খলিফা হবে সাহাবারা আরজ করলেন ইয়া রাসূল (সা.) আপনি আমাদের কি নির্দেশ করছেন। তিনি বললেন তোমরা ধারাবাহিকভাবে তাদের বাইয়াতের হক আদায় করবে তোমাদের উপর তাদের যে হক রয়েছে তা আদায় করবে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ওই সব বিষয়ে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন যার দায়িত্ব তাদের উপর অর্পন করা হয়েছিল (সহীহ বুখারী ৩৪৫৫, মুসলিম ১৮৪২)।
হযরত বশীর ইবনে খাসাসীয়া (রা.) বলেন, আমি বাইয়াত হওয়ার জন্য রাসূল (সা.) এর খেদমতে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, হুজুর আপনি আমার কাছ থেকে কি কি বিষয়ে বাইয়াত নিবেন। রাসূল (সা.) স্বীয় হস্তদ্বয় মোবারক বাড়িয়ে দিয়ে বললেন তুমি এ কথার স্বাক্ষ্য প্রদান কর যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার বান্দা ও রাসূল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথা সময় আদায় করবে, যাকাত প্রদান করবে, রমজানের রোজা রাখবে, হজ¦ করবে আর আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। তিনি বললেন ইয়া রাসূল সা. সবগুলো বিষয় পালন করার সামর্থ্য আমার আছে তবে দুটি বিষয়ে পালন করার সামর্থ্য আমার কাছে নেই। একটি হলো যাকাত কারণ আমার নিকট মাত্র ১০টি উট আছে এগুলো দ্বারা আমার পরিবারের দুধ ও সোয়ারীর কাজ চলে। আর জিহাদ করার শক্তিও আমার নেই, কারন আমি দুর্বল সাহসের অধিকারী আমার আশংকা হয় যে, জিহাদে অংশগ্রহণ করার পর মৃত্যুর ভয়ে পলায়ন করে কিনা। এমন হলে তো আল্লাহর কোপানলে পতিত হবো। তার একথা শুনে রাসূল (সা.) স্বীয় হাত মোবারক গুটিয়ে নিয়ে বললেন ওহে বশির যাকাত ও জিহাদ ছাড়া তুমি কীভাবে জান্নাতে যাবে ! তখন আমি আরজ করলাম আচ্ছা আপনার হাত বাড়িয়ে দিন আমি বাইয়াত গ্রহণ করব তখন হুজুর (সা.) এর হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি উপরোক্ত সকল বিষয়ে উপর বাইয়ত গ্রহণ করি।
পবিত্র কোরআন এবং সহিহ হাদীস সমূহ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, রাসূল (সা.) খোলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তী অন্যান্য সাহাবা ও তাবেদীনগণ মোট তিন পদ্ধতিতে বাইয়াত করাতেন। ১। হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত করাতে, ২। কথার মাধ্যমে বাইয়াত গ্রহণ, ৩। চিঠি পত্রের মাধ্যমে বাইয়াত গ্রহণ।
১ম পদ্ধতি: হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ: এ পদ্ধতির বাইয়াত হযরত সাহাবায়ে কেরাম হযরত মুহাম্মদ (স.) এর হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত হতেন। পবিত্র কোরআনে বাইয়াতের এ পদ্ধতি প্রশংসা করে বলা হয়েছে- আর যারা আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে তারা মূলত আল্লাহর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে- সূরা ফাতাহ-১০। পাগড়ী বা রুমাল স্পর্শের মাধ্যমে বাইয়াত করা: বর্তমানে আমাদের দেশে হক্কানী পীর মাশায়েখগণ লম্বা পাগড়ি বা রুমাল ছেড়ে দিয়ে পরস্পরের শরীর স্পর্শের মাধ্যমে যে পদ্ধতিতে বাইয়াত করে থাকেন সেটা মুলত হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত হওয়ার অন্তর্ভুক্ত। কেননা যেসব মাহফিলে হাজার কিংবা লক্ষ লক্ষ লোক উপস্থিত হয় সেখানে এক সাথে সকলের হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত করা সম্ভব হয়না। অতএব, বর্তমানে হক্কানী পীর মাশায়েখগণ পাগড়ি বা রুমালের মাধ্যমে বাইয়াত করে থাকেন। এছাড়া এই সময় প্রথমে পীর বা শায়েখের নিকটবর্তী লোকেরা হাতের উপর হাত রাখেন তার পর পেছনের লোকের একজন আরেকজনের শরীর স্পর্শ করে বাইয়াত বা শপথ গ্রহণ করেন। অতএব এ পদ্ধতির বাইয়াত নিঃসন্দেহে হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত হওয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে।
২য় পদ্ধতি : শুধুমাত্র কথার মাধ্যমে বাইয়াত করা। সাধারণ মহিলা বা অসুস্থ রোগীদেরকে রাসূল (সা.) পর্দার আড়ালে থেকে বাইয়াত করে নিতেন। তিনি কখনও মহিলাদের হাত কিংবা পর্দা লক্ষণ করে সরাসরি বাইয়াত করতেন না। অতএব বর্তমানে যদি তথাকথিত কোন পীর মহিলাদের হাত স্পর্শ করে কিংবা পর্দা লংঘন করে সরাসরি বাইয়াত গ্রহণ করে তাহলে বুঝতে হবে সে আসলে পীর বা আলেম নয় বরং পীররূপী শয়তান। এরূপ আলেম বা পীরের কাছে বাইয়াত হওয়া এং তার সাথে সম্পর্ক রাখা সম্পূর্ণ হারাম। রাসূল (সা.) শুধুমাত্র কথার মাধ্যমে মহিলাদের বাইয়াত করাতেন। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, কোন মোমিন নারী রাসূল (সা.) এর কাছে হিজরত করে এলে (শর্ত সাপেক্ষে) নবী (সা.) তাকে বলতেন আমি কথার মাধ্যমে তোমাকে বাইয়াত করে নিলাম আল্লাহর কসম বাইয়াত গ্রহণকালে কোন নারীর হাত রাসূল (সা.) এর হাতকে স্পর্শ করেননি। নারীদের তিনি শুধু এ কথার দ্বারাই বাইয়াত করতেন যে, আমি তোমাকে এ কথার উপর বাইয়াত করলাম। বুখারী ৪৮৯১, ২৭১৩।
৩য় পদ্ধতি : চিঠিপত্রের মাধ্যমে বাইয়াত করা ছহিহ হাদিসে উল্লেখ আছে যে, নবী করীম (সা.) এবং হযরত সাহাবাগন কখনো কখনো দূরে অবস্থানরত লোকদেরকে চিঠি পত্রের মাধ্যমে বাইয়াত করে নিতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, লোকেরা যখন আব্দুল মালিকের নিকট বাইয়াত হলো তখন আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তার কাছে পত্র লিখলেন যে, আমি মহান আল্লাহ ও তার রাসূলের আদর্শ অনুযায়ী আল্লাহর বান্দা আমিরুল মুমিনিন আব্দুল মালিকের কথা যথাসাধ্য শোনা ও তার আনুগত্য করার অঙ্গিকার করছি এবং আমার সন্তানরাও অনুরূপ অঙ্গিকার করছে (সহীহ বুখারী ৭২৩৫)।
নবী রাসূলগণ দুনিয়াতে আগমণ করার পর যেমনিভাবে তাদের আনুগত্য ও মহব্বত গ্রহণ করা উম্মতের জন্য জরুরী ছিল তেমনিভাবে নবী রাসূলগণের স্থলাভিষিক্ত খলিফাগণ, হক্কানী পীর মাশায়েখগণের মহব্বত গ্রহণ করাও সাধারণ মানুষের জন্য জরুরী। কেননা দুনিয়াতে একমাত্র হক্কানী আলেম ও পীর মাশায়েখগনই হলেন নবী রাসূলগণের ওয়ারীশ রুহানী সন্তান।
পীরের কাছে বাইয়াত হওয়ার আগে কামেল এবং খাটি পীর চিনে নিতে হবে এবং তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যে সকল গুণাবলী থাকা আবশ্যক তার মধ্যে অন্যতম হলো: কুরআন হাদীসের ইলম থাকা, মুত্তাকী ও নেককার হওয়া, সুন্নতের অধিকারী হওয়া, কোন কামেল পীরের সংস্পর্শে থেকে বাতেনী ইলম হাসিল করা, আলেমগণের সমর্থন ও আস্থা থাকা, ছোহবত প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া, উত্তরোত্তর তার পীরের মুরিদের অবস্থার উন্নতি ও সংশোধন হওয়া।
পীর একটি ফার্সি শব্দ। পীরের আরবী শব্দ হল মুর্শিদ (পথ প্রদর্শক শায়েখ) যেমন নামাজের আরবী শব্দ সালাত। মানুষ সালাতকেই নামাজ হিসেবে চিনে জানে ও আদায় করে। রোজা এর আরবী শব্দ হল সাওম। মানুষ সওমকেই রোজা হিসেবে চিনে জানে ও আদায় করে। বেহেশত, দোযখ এর আরবী শব্দ হল জান্নাত, জাহান্নাম।
নামাজ রোজা ও বেহেশত দোযখ এসকল শব্দগুলো কোরআন হাদীসে উল্লেখ নেই। নবী সা. সালাত, সাওম, জান্নাত, জাহান্নাম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কিন্তু কখনও নামাজ রোজা বেহেস্ত দোযখ উচ্চারণও করেননি। পীর শব্দটিও তেমনি নামাজ রোজার মত কোরআন হাদীসে না থাকলেও এর আরবী শব্দটি কোরআন হাদীসে উল্লেখ রয়েছে।
যেমন- কোরআনে এরশাদ রয়েছে- হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথী হও (সূরা তওবাহ- ১১৯)। আল্লাহ পাক এখানে সাদেকীন অর্থাৎ সত্যবাদী আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে থাকতে বলেছেন। অন্য এরশাদ রয়েছে আল্লাহ যাকে হেদায়াত দিবেন তাকে মুর্শিদের ব্যবস্থা করে দিবেন। যেমন আল্লাহ পাক যাকে সৎ পথ দেখান সে সৎপথ প্রাপ্ত হন এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন আপনি কখনই তার কোন পথ-প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না (সূরা কাহাফ-১৭)। এখানে সাদেকীন, সত্যবাদী ও মুর্শিদ পথ প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে এই সাদেকীন সত্যবাদী, মুর্শিদ ও পথ প্রদর্শকগণ হলেন পীর মাশায়েখগণ।
এ জন্যই পীর ওলিদের সাথে শত্রুতা রাখা আল্লাহর সাথে যুদ্ধের শামিল বলা হয়েছে। যেমন- আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সা. এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন ওলির সাথে শত্রুতা রাখবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি (সহিহ বুখারী ৬৫০২)। অনেকে পীর বা ওলীদের সম্পর্কে না জেনে শুনে খারাপ মন্তব্য করে এমনকি শত্রুতাও করে থাকে অথচ আলোচ্য হাদিসে (এটি হাদিসে কুদসী) স্বয়ং আল্লাহ পাক ওলিদের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করতে নিষেধ করেছেন। যেমন পীরের (পরহেজগার), মুত্তাকিন, ওলিদের পরিচয় দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, যেনে রেখ আল্লাহর বন্ধুদের (আওলিয়া) কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তাম্বিতও হবে না। তারা এমন লোক যারা ইমান এনেছে এবং পরহেজগারী অবলম্বন করেছে। তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে পার্থীব জীবনে এবং আখিরাতের আল্লাহর বানী সমূহের কোন পরিবর্তন নেই এটাই বিরাট সফলতা (সূরা ইউনুস ৬২, ৫৩৬৪)।