কাজিরবাজার ডেস্ক :
অবশেষে অতিমারী করোনায় প্রথম মৃত্যুহীন দিন দেখল বাংলাদেশ। গত বছরের ৩ এপ্রিল থেকে ৫৯৬ দিন পর করোনায় মৃত্যুশূন্য দিনে প্রবেশ করেছে দেশ। ফলে এতে করোনায় মৃতের মোট সংখ্যা ২৭ হাজার ৯৪৬ জনে অপরিবর্তিত থাকল। মৃত্যুশূন্য দিনে আসার আগে দেশকে পার করতে হয়েছে কঠিন পথ। লকডাউন ও কঠোর বিধিনিষেধে মানুষকে গৃহবন্দী জীবনও বেছে নিতে হয়েছিল। সরকারের সময়োচিত সিদ্ধান্ত ও টিকাদান কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়নের কারণেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
শনিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) করোনায় কারও মৃত্যু হয়নি। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম ৩ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ওই বছরের ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। এরপর কোন দিন এক-দুজনের, আবার কোন কোন দিন কারও মৃত্যু হয়নি পরের দুই সপ্তাহে।
সর্বশেষ গত বছরের ৩ এপ্রিল করোনায় কারও মৃত্যু হয়নি। পরদিন মৃত্যু হয় দুজনের। এরপর থেকে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে চলতি বছরের মাঝামাঝিতে। মূলত করোনার ডেল্টা ধরনের কারণেই শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে। ২৪ এপ্রিল প্রথমবারের মতো একশ’ ছাড়ায় মৃত্যুর সংখ্যা। পরবর্তীতে ৪ জুলাই মৃত্যু দেড়শ ছাড়ায়। প্রথমবারের মতো এই সংখ্যা দুইশ ছাড়ায় ৭ জুলাই।
ডেল্টার সংক্রমণে চলতি বছরের ১০ আগস্ট করোনা আক্রান্ত হয়ে একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এর আগে গত ৫ আগস্টও রেকর্ড ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। গত ২৮ জুলাই একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।
গত আগস্টের প্রথমদিকে থেকে দেশে করোনার গণটিকাদান শুরু হওয়ার পর সংক্রমণ ও মৃত্যু কমতে থাকে। এর মধ্যে একদিনে মৃত্যু একজনেও নেমেছিল। তবে প্রথম কারও মৃত্যু হয়নি গত ২৪ ঘণ্টায়। সরকারের টিকাদান কর্মসূচী এখনও চলমান রয়েছে। আগামীতে টিকাদান কর্মসূচী আরও জোরদার করতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে স্কুল-কলেজে টিকাদান কর্মসূচী শুরু হয়েছে। আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
গত বছরের মার্চ মাসে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর বছরটিতে প্রথম ঢেউ ভালভাবেই সামাল দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম দিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন জায়গায় নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টাতে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে। ডেল্টা মোকাবেলায় এপ্রিল মাস থেকে সরকার টানা লকডাউন কর্মসূচী ঘোষণা করে। সেইসঙ্গে জোরদার করা হয় টিকাদান কর্মসূচী। অর্থনীতির গতি ঠিক রাখতে তৈরি পোশাক কারখানা চালুসহ রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়। ডেল্টাতে দেশে করোনা শনাক্তের হার বাড়তে বাড়তে ৩৩ শতাংশের ওপর পৌঁছায়। শনাক্তের সঙ্গে মৃত্যুর হারও এক এক করে বাড়তে বাড়তে ১শ’ ছাড়িয়ে যায়। ১শ’ থেকে ২শ’ পেরিয়ে আড়াইশ ছাড়িয়ে যায় মৃত্যুর সংখ্যা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের শনিবারের প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৭৮ জনের। এ নিয়ে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮৮৯ জনে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় কেউ মারা যাননি। এখন পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ২৭ হাজার ৯৪৬ জন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ১৯০ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬ জন। আর গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৮৯১টি। এ্যান্টিজেন টেস্টসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৫ হাজার ১০৭টি। এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৭ লাখ ৬ হাজার ৬৬২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১ দশমিক ১৮ শতাংশ। এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় প্রতি ১০০ জনে সুস্থ হয়েছে ৯৭ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং মারা গেছেন ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা মুসতাক হোসেন বলেন, টিকাকরণ কর্মসূচীর পরিধি বাড়ানো এবং জনগণের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় করোনা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর কারণেই দীর্ঘদিন পর মৃত্যুহীন দিন দেখল বাংলাদেশ। এছাড়া করোনায় নতুন শনাক্তের হার ১ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী, নতুন রোগী শনাক্তের হার ১ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয় গত ঈদুল ফিতরের পরপরই। ভারত সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে রোগী দ্রুত বাড়তে থাকে। পরে তা আশপাশের জেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এক মাসের ব্যবধানে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা, মৃত্যু ও শনাক্তের হার কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সংক্রমণ রোধে ৫ এপ্রিল থেকে সারাদেশে লকডাউন কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। পরে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ায় গত ২২ জুন থেকে ঢাকাকে সারাদেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেই প্রচেষ্টায় ঢাকার আশপাশের চারটি জেলাসহ মোট সাতটি জেলায় জরুরী সেবা ছাড়া সব ধরনের চলাচল ও কার্যক্রম ৩০ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে এরপরও করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ২৮ জুন থেকে সারাদেশে সব গণপরিবহন ও মার্কেট-শপিংমল বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে নানা বিধি-নিষেধের মধ্যে চলার পর ১১ আগস্ট থেকে আস্তে আস্তে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার শুরু হয়। টিকাদান কর্মসূচীর ব্যাপ্তি ও সঠিক পরিকল্পনার কারণেই ডেল্টা ধরনকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে সরকার।