মো: শামসুল ইসলাম সাদিক
‘ঈদ’ মুসলিম জাতির জাতীয় উৎসব। বিশ্বের মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। রমজানের পর ঈদ আসে মুসলমানের মাঝে আনন্দ ও উৎসবের বার্তা নিয়ে। ঈদুল ফিতরের দিন প্রতিটি মুসলমান নারী-পুরুষের জীবনে অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। ঈদুল ফিতর প্রতিবছর এক অনন্য-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানের শেষে শাওয়ালের এক ফালি উদিত চাঁদ নিয়ে আসে খুশির বার্তা। সিয়াম পালনের দ্বারা রোজাদার যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, ইসলামের যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দানশীলতা, উদারতা, ক্ষমা, মহানুভবতা, সাম্যবাদিতা ও মনুষ্যত্বের গুণাবলী দ্বারা বিকশিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণœ রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর আগমন হয়। এ দিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্যময়তা দ্বারা পরিপূর্ণ। সুদীর্ঘ এক মাস রোজার পর মুসলমানের ঘরে নিয়ে আসে ঈদ আনন্দ। এদিন নতুন জামা-কাপড় পরিধান করা, ঈদগাহে নামাজ পড়া ও কোলাকুলি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফিরনি-সেমাই খাওয়া প্রভৃতি ঈদের দিনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
‘ঈদ’ আরবি শব্দ এটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত, আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বার বার আসা, খুশি, আনন্দ ইত্যাদি। ‘ফিতর’ আরবি শব্দ এর অর্থ ভঙ্গ করা, ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করা, বিদীর্ণ করা। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখা পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে রোজা ভেঙ্গে যে আনন্দ উৎসব পালন করা হয় তাকে ‘ঈদুল ফিতর’ বলে। কারো কারো মতে ‘ফিতর’ শব্দ ফিতরা থেকে এসেছে। ধনী ব্যক্তিরা গরীবদেরকে ফিতরা দিয়ে তাদেরকে ঈদের আনন্দে শরীক করেন বলে এই দিনকে ‘ঈদুল ফিতর’ বলে, কারো কারো মতে-দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর রোজাদারগণ ঈদগাহে নামাজের জন্য এলে আল্লাহ রোজাদারগণকে একবাক্যে ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই ক্ষমা প্রাপ্তিটাই হচ্ছে মহানন্দের ও বড় প্রাপ্তি। যেহেতু রোজাদারগণ ঈদুল ফিতরের দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা পেয়ে থাকেন। আর এটাই তাদের বড় পুরস্কার, শাওয়ালের পহেলা তারিখে রোজাদারগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘পুরস্কার’ লাভ করেন বলে এই দিনকে ‘ঈদ’ বলা হয়েছে। পুরস্কার পেয়ে রোজাদারগণ আনন্দিত হন তাই আনন্দের দিনকে ‘ঈদ’ বলা হয়েছে। ঈদুল ফিতর মুসলমানদের আনন্দের দিন,এ দিন ধনী-গরিব সব মানুষের মহামিলনের বার্তা বহন করে। এক কাতারে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে নামাজ পড়ার সুযোগ এনে দেয়। ঈদের খুশির অন্যতম হচ্ছে ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ। ঈদ এক নির্মল আনন্দে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দ পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং আনন্দ সমান ভাগাভাগি করেন। রমজানের রোজার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা দান করে ঈদ। ঈদুল ফিতর আনন্দ-উৎসব এমনই এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত করে, যা মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথপরিক্রমায় চলতে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন- ‘প্রতিটি জাতিরই আনন্দ-উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এই ঈদ’ (বুখারি ও মুসলিম)।
ঈদুল ফিতরের দিন রোজাদারের সম্মানজনক মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণিত, হযরত আউস আনসারী (রা:) বলেন, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন-ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সকল ফেরেস্তা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, হে মুমিনগণ! তোমরা প্রতিপালকের দিকে এগিয়ে এস। উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সওয়াব প্রাপ্তির জন্য এগিয়ে এস। তোমাদের রাত্রিবেলার নামাজের নির্দেশ দেয়া হলে তোমরা সে নির্দেশ পালন করেছে। তোমাদের দিনের বেলা রোজা রাখতে বলা হলে তোমরা সে নির্দেশও পালন করেছ। এক মাস রোজা রেখেছ। গরীব-দুঃখীদের পানাহারের মাধ্যমে নিজ প্রতিপালককে তোমরা পানাহার করিয়েছ। এখন নামাজ পড়ার মাধ্যমে প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ কর, ঈদের নামাজ পর ফেরেস্তাগণের একজন ঘোষণা দেন, শোন নামাজ আদায়কারীরা, তোমাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, সকল গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও। আর শোন, এই দিনটি হচ্ছে পুরস্কার প্রদানের দিন। আকাশে এই দিনের (ঈদুল ফিতরের দিন) নামকরণ করা হয়েছে ‘পুরস্কারের দিন’ (তাবরাণী)। আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মদিনায় রাসুল (সা:) হিজরত করে আসার পর দেখলেন, মদিনাবাসী দ’ুদিন খুব আনন্দ উৎসব করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, নাইরোজ এবং মেহেরজান এ দ’ুদিনে তোমরা কী কর? তারা বলল, আমরা জাহিলিয়্যাতের যুগে এদুটো দিন খেলাধুলা, প্রাচীন ঐতিহ্য লালন ও আমোদ ফূর্তি করতাম। রাসুল (সা:)-ইরশাদ করলেন- আল্লাহ তোমাদের এ দুটো দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন প্রদান করেছেন। ঈদুল ফিতরের দিন ও ঈদুল আযহারর দিন (সনানু আবু দাউদ)। হযরত মু‘আয ইবন জাবাল (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:)-ইরশাদ করলেন- যে ব্যক্তি পাঁচটি রাত (ইবাদতের মাধ্যমে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখ রাত, জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখ রাত, ঈদুল আযহার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত এবং ১৫ শাবানের রাত। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব)।
ঈদের করণীয় ১. ফজরের সালাত আদায় করা : ২. মিসওয়াক করা। ৩. রোজা না রাখা: এ দিন রোজা রাখা হারাম। ৪. গোসল করা : ঈদের দিন গোসল করা সুন্নাত। ৫. সকালবেলা কিছু খাওয়া : ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া সুন্নাত। ৬. সুগন্ধি ব্যবহার করা : আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত। ৭. সুন্দর পোশাক পরিধান করা : এ দিনটিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর পোশাক পরিধান কর । ৮. সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা : যে ব্যক্তি সাদাকাতুল ফিতর ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করে, তা কবুল করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পরে আদায় করবে, তা সাধারণ সাদাকাহ হিসেবে পরিগণিত হবে। ৯. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া : পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। ১০. ঈদের জামাতে যাওয়া-আসার পথ ভিন্ন হওয়া :এটি সুন্নাত। এতে দীর্ঘ হাটা এবং বেশি মানুষের সাথে মিশার উপকারিতা রয়েছে। ১১. তাকবীর বলা : তাকবীর বলে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, অল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, অলিল্লাহিল হামদ। ১২. ঈদে কুশল বিনিময় : পারস্পরিক ঈদে কুশল বিনিময় করা সুন্নাত। সাহাবায়ে কেরাম এই দিনে একে অপরকে বলতেন তাকাব্বালুল্লাহা মিন্না ওয়া মিনকুম। ১৩. ঈদের সালাত আদায় করা। ১৪. খুতবাহ শুনা ও দুআ করা : এটি পালন করা ওয়াজিব। ১৫. কবর জিয়ারত করা : কেননা এটি তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ঈদের বর্জনীয় ১. জামাতের সাথে ফরজ সালাত আদায়ে অলসতা ২. ঈদের দিন সিয়াম পালন করা ৩. বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন করা ৪. নারী-পুরুষ একে অপরের বেশ ধারণ করা ৫. নারীদের খোলামেলা অবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হওয়া ৬. গান-বাজনা করা ৭. অযথা কাজে সময় নষ্ট করা ৮. অপচয় ও অপব্যয় করা ৯. আতশবাজি করা ১০. ঈদের সালাত আদায় না করে কেবল আনন্দ-ফূর্তি করা । ঈদ আমাদের আনন্দ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উৎসব। আমাদের সকলকে ঈদের তাৎপর্য বুঝতে হবে। ঈদ বলতে আমরা আনন্দ ছাড়া আর কিছুই বুঝিনা। তবে সেই আনন্দের নামে আমাদের সমাজে যে অশ্লীলতা, জৌলুস, অপব্যয়, নগ্নতা ও বেহাল্লাপনা তা মেনে নেয়া যায়না। মুসলমানের ঈদ-উৎসবে নেই কোনো নগ্নতা, খেল-তামাশা ও কোনো বেহাল্লাপনা। মুসলমানদের ঈদ উদযাপন হবে ইবাদত, রিয়াজত তাদের ইতিহাসের ও ঐতিহ্যের আলোকে। শরীয়ত সম্মতভাবে আমাদের সকলকে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে হবে। আসুন আমরা সকলেই সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যের মাধ্যমে ঈদকে সবার জন্য আনন্দময় করে তুলি।
লেখক: শিক্ষার্থী, এম. সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ- সিলেট।