পাখিদের বাঁচতে দিন

14

কাজী সুফিয়া আখ্তার :
প্রাচীনকাল থেকেই শিশুরা অতি শৈশবে মা-দাদি-নানি-কাকির কোলে বসে কথা বলার আগেই নদী-পাখি-ব্যাঙ-ফুল-ফল নিয়ে রচিত ছড়া শুনতে শুনতে বড় হয়। ঘুমায়। একদিন তাদের মুখে বোল ফোটে। তারাও ছড়া কাটে। ‘আয় রে আয় টিয়ে/নায়ে ভরা দিয়ে/না’ নিয়ে গেল চিলে…।’ আর তারাও নিজের অজান্তে পরিচিত হয়ে ওঠে আমাদের চারপাশে থাকা পাখিদের সঙ্গে। তাদের খাবারের জন্য যেমন উঠোনে খুদকুঁড়ো ছিটায়, ছড়ায়, তেমনি দাদির সঙ্গে উঠোনের রোদে শুকোতে দেওয়া ধানে চড়ুই, শালিক ও কাক তাড়ায়। শৈশবে মায়ের ডাকের আগে আমাদের ভাই-বোনদের ঘুম ভাঙত পাখির কিচিরমিচির শব্দে, ভিন্ন ভিন্ন পাখির কণ্ঠনিঃসৃত সুমধুর ডাকে। আমরা তাদের কলকাকলি খুব উপভোগ করতাম। তবে দোয়েল সবচেয়ে আগে, কিছুটা অন্ধকার থাকতে জানান দিত রাত পোহানের। আমাদের মূল বসতঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি অসাধারণ সুন্দর বড় ডালপালা ঝাপটানো পুরনো আমগাছ ছিল। তার পাশেই ছিল বাঁশঝাড়, জড়াজড়ি করে একটি গাবগাছ, সটান উঠে যাওয়া সুপারি গাছ। অনেক পাখির বাসা ছিল এখানে। দীর্ঘ বছর অসংখ্য পাখি আমগাছের ডালে পাতার ছায়ায় নিয়মিত দিন ও রাত যাপন করত। এটাই ছিল তাদের স্থায়ী আবাসস্থল। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার আশ্রয়স্থল। শীতের সময় পাখির সংখ্যা বেড়ে যেত। জায়গা নিয়ে ঝগড়াও হতো। আমার বেশ মনে আছে, বাঁশঝাড়ের মাথায় চারটি বকও সন্ধ্যার পরে এসে আশ্রয় নিত। চড়ুই আমাদের ঘরেই বাসা করে থাকত টিনের চালের কোনায়। দালানবাড়ির ভেন্টিলেটরে। এখনকার তৈরি বাড়িতে ভেন্টিলেটর থাকে না। চড়ুইও বাসা বাঁধতে পারে না মানুষের ঘরের মধ্যে। সকাল হলেই উঠোনজুড়ে কাক, এক পা, দুই পা করে জোড় শালিকের হাঁটা দেখে মন ভালো হয়ে যেত। টুনটুনিও থাকত বৈকি। ও তো উঠোনের কোণে মায়ের বেগুনক্ষেতের বড় পাতার নিচে বাসা বাঁধত। আমরা বেগুনক্ষেতে বেশি সময় লুকোচুরি খেলতে থাকলে মা সাবধান করে দিতেন, এই টুনটুনির বাসা ভাঙবে না। বহু বছর পরে গত বছর ধানমণ্ডির ৯/এ রোডের নাহার আপার পাঁচতলার ফ্ল্যাট বাড়ির সিঁড়িতে রাখা টবে লাগানো বেগুনগাছের পাতার আড়ালে একসময়ের খ্যাতনামা অভিনেত্রী রিনি রেজা দেখালেন টুনটুনির বাসা। রিনি বলেছিলেন, ‘আসো, দেখো, তোমার ভালো লাগবে।’ সত্যি ভালো লেগেছিল। হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পেলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন।
শৈশব থেকেই আমার প্রিয় পাখি। ছোটবেলায়, গ্রামের কৃষকরা যখন ভাদ্র মাসে জমিতে লাঙল দিয়ে চাষ দিত, তাদের পেছনে পেছনে চড়ুই, শালিক উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াত। মাটির নিচ থেকে উঠে আসা পোকামাকড়, কেঁচো দেখতে পেলেই ঠোঁটে তুলে নিয়ে দে উড়াল। এই দৃশ্যের জন্য এখনো চোখ তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। শিকারি পাখি চিল, পেঁচা, ইগল, বাজপাখি বরাবরই কৃষকের ধান নষ্টকারী ইঁদুর খেয়ে কৃষকের উপকার করে। ধানের ক্ষতি করে এমন পতঙ্গভুক পাখি হলো চড়ুই, কাদাখোঁচা, হুদহুদ, খঞ্জনা, শালিক, গাঙশালিক, ঝুঁটিশালিক. গুইশালিক, নীলকণ্ঠ, ফিঙে, সুইচোরা ও আবাবিল। ফিঙে শুধু পতঙ্গ খায় না, বিষাক্ত পোকামাকড়ের শুককীট খেয়ে কৃষকের উপকার করে। শস্যক্ষেতে পোকা মারার রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহারের ফলে আমাদের যেমন জল-মাটির ক্ষতি হয়েছে, তেমনি পাখিও অনেক বেঘোরে মৃত্যুবরণ করেছে।
একেক জায়গায় একই পাখির ভিন্ন ভিন্ন নাম। যে ‘বেনেবউ’ সে-ই ‘বউ কথা কও’ পাখি। আবার কোথাও ‘ইষ্টিকুটুম’ বলেও পরিচিত। কত আকৃতি-প্রকৃতি ও বিচিত্র স্বভাবের পাখি ছিল। দোয়েল-কোয়েল-শ্যামা-ফিঙে-ময়না-টিয়া-টুনটুনি-বাজপাখি-চিল-গাঙচিল-শকুন-কবুতর-পাপিয়া-বাবুই-বনটিয়া-বেনেবউ, চড়ুই-কাকাতুয়া-মাছরাঙা-খঞ্জনা-সাত ভায়রা-বউ কথা কও-হলদে পাখি-ময়ূর-ধনেশ-বুলবুলি-ঘুঘু-ফুলঝুরি-মদনটাক-তিতির সবচেয়ে পরিচিত কাকসহ আরো কত নাম না জানা পাখি। একসময় এই বাংলাদেশে আনুমানিক ৬৫০ প্রজাতির পাখির দেখা মিলত। এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ ছিল পরিব্রাজক পাখি। বাদবাকি সবই ছিল আবাসিক, আমাদের দেশের পাখি। কোথায় তারা হারিয়ে গেল মানুষের আগ্রাসী লোভের খেসারত দিতে। সকাল-সন্ধ্যায় পাখির ডাকে জেগে ওঠা বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের, গ্রাম ও শহরের সবার কাক, চড়ুই, শালিক, বুলবুলি, টুনটুনি, দোয়েল, শ্যামা চেনা পাখি। অন্য পাখিদের চেনার উপায় ক্রমেই লোপ পেয়ে যাচ্ছে। কোকিলের মিষ্টি সুর বসন্তে শোনা হলেও পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই কোকিলকণ্ঠীকে সচরাচর দেখা যায় না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখন আগের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি আসে না। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এসে কে বন্দুকের গুলি খেয়ে মরতে চায়। সাথি হারাতে চায়। যদিও বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা, গাছে গাছে হাঁড়ি বেঁধে দিয়ে পাখিদের বাসা বাঁধা ও ডিম পাড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক পাখিবান্ধব গ্রাম হয়েছে। এই ঢাকা শহরেও পাখিবান্ধব বাড়ি আছে। শীত আসছে। শীতকাল এলেই মনে ভয় জাগে। এবার শীতে আবাসিক, পরিযায়ী কত পাখি বাঁচতে এসে মারা পড়বে।
শীতকাল অনেকেরই প্রিয় ঋতু। ঘুরে বেড়ানো এবং সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সময়। শীতকাল এলেই বাংলাদেশের মানুষের পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। কারো কারো সাদা চালের হাতে গড়া রুটির সঙ্গে হাঁসের মাংস ভুনা অথবা পাখির মাংস খুব প্রিয়। এই সময়ে গ্রামাঞ্চল ও শহরতলিতে খাল-বিল-জলাশয়-পুকুরে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। মাথার ওপরে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় নানা রঙের, নানা আকারের, নানা ডাকের পাখি। এই সময়ে বনে-জঙ্গলে, হাওর-বিল অঞ্চলের জলাশয়ে প্রচুর পাখি এখনো দেখা যায়। এসব অঞ্চলের জেলাগুলোতে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সরাইল, খুলনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ জেলাসহ অন্যান্য জেলার হোটেলগুলোতে পাখির মাংস পাওয়া যায়। এই সময়ে পাখি নানা সীমান্তপথে পাচারও হয়। শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। আমাদের পাখি শিকারিরা তাদের গুলি করে মেরে খাবার টেবিলে উপাদেয় খাদ্যে পরিণত করে। কখনো পাচার করে দেয় পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে। তাদের আর স্বদেশে ফিরে যাওয়া হয় না। আমাদের পাখিরাও প্রায়ই তাদের নিজেদের খাদ্য জোগাতে, ছানাদের খাদ্য জোগাতে বাসা থেকে বের হয়ে পাখি শিকারিদের জন্য আর ছানাদের কাছে ফিরে যেতে পারে না। তা ছাড়া বাসার পাশে শালিক সুপারি বা পেয়ারা কাছে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোটায়। বিড়ালের আগ্রাসী থাবা থেকে তাদের বাঁচানো বড় কষ্টকর। ছানারা উড়তে না শেখা পর্যন্ত মা পাখি, বাবা পাখি মিলেই পাহারা দেয়। তবু কখনো কখনো শেষ রক্ষা হয় না। খাবার আনতে বাসার বাইরে গেলে অনেক সময়ই নিষ্ঠুর অঘটন ঘটে যায়। এটা প্রাকৃতিক। অনিচ্ছায় মেনে নিতে হয়। কিন্তু মানুষ যখন শখের বশে পাখি মারে, তখন মেনে নেওয়া যায় না।
বনের প্রাণী, বনের পাখি রক্ষায় আইন আছে। তবু সুন্দরবনে পাখি কমে যাচ্ছে। আগের মতো গাছের মাথায় বড় বড় বকের সারি বাতাসে দুলতে দেখা যায় না।
আসুন, আমরা পাখিদের বাঁচতে দিই। গুলতি দিয়ে, বন্দুক দিয়ে পাখি না মারি। পাখি পাচার না করি। পাখির মাংস না খাই। বনে-জঙ্গলে-জলাশয়ে পাখি অনিন্দ্যসুন্দর পদাবলি রচনা করে। কবি-সাহিত্যিকরা মুগ্ধ হয়েছেন। শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। চিত্রগ্রাহকরা ভীষণ কষ্ট স্বীকার করে তাদের ছবি তুলে তৃপ্তি লাভ করেন। পাখি নিয়ে সব কালে অজস্র ছড়া, কবিতা রচিত হয়েছে। ‘পাখি সব করে রব’-এর অপার্থিব সৌন্দর্যে, সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে আসুন আমরাও বাঁচি, বাঁচার প্রয়াস নিই।
লেখক : গবেষক ও নারী নেত্রী।

কাজী সুফিয়া আখ্তার
প্রাচীনকাল থেকেই শিশুরা অতি শৈশবে মা-দাদি-নানি-কাকির কোলে বসে কথা বলার আগেই নদী-পাখি-ব্যাঙ-ফুল-ফল নিয়ে রচিত ছড়া শুনতে শুনতে বড় হয়। ঘুমায়। একদিন তাদের মুখে বোল ফোটে। তারাও ছড়া কাটে। ‘আয় রে আয় টিয়ে/নায়ে ভরা দিয়ে/না’ নিয়ে গেল চিলে…।’ আর তারাও নিজের অজান্তে পরিচিত হয়ে ওঠে আমাদের চারপাশে থাকা পাখিদের সঙ্গে। তাদের খাবারের জন্য যেমন উঠোনে খুদকুঁড়ো ছিটায়, ছড়ায়, তেমনি দাদির সঙ্গে উঠোনের রোদে শুকোতে দেওয়া ধানে চড়ুই, শালিক ও কাক তাড়ায়। শৈশবে মায়ের ডাকের আগে আমাদের ভাই-বোনদের ঘুম ভাঙত পাখির কিচিরমিচির শব্দে, ভিন্ন ভিন্ন পাখির কণ্ঠনিঃসৃত সুমধুর ডাকে। আমরা তাদের কলকাকলি খুব উপভোগ করতাম। তবে দোয়েল সবচেয়ে আগে, কিছুটা অন্ধকার থাকতে জানান দিত রাত পোহানের। আমাদের মূল বসতঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি অসাধারণ সুন্দর বড় ডালপালা ঝাপটানো পুরনো আমগাছ ছিল। তার পাশেই ছিল বাঁশঝাড়, জড়াজড়ি করে একটি গাবগাছ, সটান উঠে যাওয়া সুপারি গাছ। অনেক পাখির বাসা ছিল এখানে। দীর্ঘ বছর অসংখ্য পাখি আমগাছের ডালে পাতার ছায়ায় নিয়মিত দিন ও রাত যাপন করত। এটাই ছিল তাদের স্থায়ী আবাসস্থল। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার আশ্রয়স্থল। শীতের সময় পাখির সংখ্যা বেড়ে যেত। জায়গা নিয়ে ঝগড়াও হতো। আমার বেশ মনে আছে, বাঁশঝাড়ের মাথায় চারটি বকও সন্ধ্যার পরে এসে আশ্রয় নিত। চড়ুই আমাদের ঘরেই বাসা করে থাকত টিনের চালের কোনায়। দালানবাড়ির ভেন্টিলেটরে। এখনকার তৈরি বাড়িতে ভেন্টিলেটর থাকে না। চড়ুইও বাসা বাঁধতে পারে না মানুষের ঘরের মধ্যে। সকাল হলেই উঠোনজুড়ে কাক, এক পা, দুই পা করে জোড় শালিকের হাঁটা দেখে মন ভালো হয়ে যেত। টুনটুনিও থাকত বৈকি। ও তো উঠোনের কোণে মায়ের বেগুনক্ষেতের বড় পাতার নিচে বাসা বাঁধত। আমরা বেগুনক্ষেতে বেশি সময় লুকোচুরি খেলতে থাকলে মা সাবধান করে দিতেন, এই টুনটুনির বাসা ভাঙবে না। বহু বছর পরে গত বছর ধানমণ্ডির ৯/এ রোডের নাহার আপার পাঁচতলার ফ্ল্যাট বাড়ির সিঁড়িতে রাখা টবে লাগানো বেগুনগাছের পাতার আড়ালে একসময়ের খ্যাতনামা অভিনেত্রী রিনি রেজা দেখালেন টুনটুনির বাসা। রিনি বলেছিলেন, ‘আসো, দেখো, তোমার ভালো লাগবে।’ সত্যি ভালো লেগেছিল। হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পেলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন।
শৈশব থেকেই আমার প্রিয় পাখি। ছোটবেলায়, গ্রামের কৃষকরা যখন ভাদ্র মাসে জমিতে লাঙল দিয়ে চাষ দিত, তাদের পেছনে পেছনে চড়ুই, শালিক উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াত। মাটির নিচ থেকে উঠে আসা পোকামাকড়, কেঁচো দেখতে পেলেই ঠোঁটে তুলে নিয়ে দে উড়াল। এই দৃশ্যের জন্য এখনো চোখ তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। শিকারি পাখি চিল, পেঁচা, ইগল, বাজপাখি বরাবরই কৃষকের ধান নষ্টকারী ইঁদুর খেয়ে কৃষকের উপকার করে। ধানের ক্ষতি করে এমন পতঙ্গভুক পাখি হলো চড়ুই, কাদাখোঁচা, হুদহুদ, খঞ্জনা, শালিক, গাঙশালিক, ঝুঁটিশালিক. গুইশালিক, নীলকণ্ঠ, ফিঙে, সুইচোরা ও আবাবিল। ফিঙে শুধু পতঙ্গ খায় না, বিষাক্ত পোকামাকড়ের শুককীট খেয়ে কৃষকের উপকার করে। শস্যক্ষেতে পোকা মারার রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহারের ফলে আমাদের যেমন জল-মাটির ক্ষতি হয়েছে, তেমনি পাখিও অনেক বেঘোরে মৃত্যুবরণ করেছে।
একেক জায়গায় একই পাখির ভিন্ন ভিন্ন নাম। যে ‘বেনেবউ’ সে-ই ‘বউ কথা কও’ পাখি। আবার কোথাও ‘ইষ্টিকুটুম’ বলেও পরিচিত। কত আকৃতি-প্রকৃতি ও বিচিত্র স্বভাবের পাখি ছিল। দোয়েল-কোয়েল-শ্যামা-ফিঙে-ময়না-টিয়া-টুনটুনি-বাজপাখি-চিল-গাঙচিল-শকুন-কবুতর-পাপিয়া-বাবুই-বনটিয়া-বেনেবউ, চড়ুই-কাকাতুয়া-মাছরাঙা-খঞ্জনা-সাত ভায়রা-বউ কথা কও-হলদে পাখি-ময়ূর-ধনেশ-বুলবুলি-ঘুঘু-ফুলঝুরি-মদনটাক-তিতির সবচেয়ে পরিচিত কাকসহ আরো কত নাম না জানা পাখি। একসময় এই বাংলাদেশে আনুমানিক ৬৫০ প্রজাতির পাখির দেখা মিলত। এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ ছিল পরিব্রাজক পাখি। বাদবাকি সবই ছিল আবাসিক, আমাদের দেশের পাখি। কোথায় তারা হারিয়ে গেল মানুষের আগ্রাসী লোভের খেসারত দিতে। সকাল-সন্ধ্যায় পাখির ডাকে জেগে ওঠা বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের, গ্রাম ও শহরের সবার কাক, চড়ুই, শালিক, বুলবুলি, টুনটুনি, দোয়েল, শ্যামা চেনা পাখি। অন্য পাখিদের চেনার উপায় ক্রমেই লোপ পেয়ে যাচ্ছে। কোকিলের মিষ্টি সুর বসন্তে শোনা হলেও পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই কোকিলকণ্ঠীকে সচরাচর দেখা যায় না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখন আগের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি আসে না। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এসে কে বন্দুকের গুলি খেয়ে মরতে চায়। সাথি হারাতে চায়। যদিও বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা, গাছে গাছে হাঁড়ি বেঁধে দিয়ে পাখিদের বাসা বাঁধা ও ডিম পাড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক পাখিবান্ধব গ্রাম হয়েছে। এই ঢাকা শহরেও পাখিবান্ধব বাড়ি আছে। শীত আসছে। শীতকাল এলেই মনে ভয় জাগে। এবার শীতে আবাসিক, পরিযায়ী কত পাখি বাঁচতে এসে মারা পড়বে।
শীতকাল অনেকেরই প্রিয় ঋতু। ঘুরে বেড়ানো এবং সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সময়। শীতকাল এলেই বাংলাদেশের মানুষের পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। কারো কারো সাদা চালের হাতে গড়া রুটির সঙ্গে হাঁসের মাংস ভুনা অথবা পাখির মাংস খুব প্রিয়। এই সময়ে গ্রামাঞ্চল ও শহরতলিতে খাল-বিল-জলাশয়-পুকুরে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। মাথার ওপরে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় নানা রঙের, নানা আকারের, নানা ডাকের পাখি। এই সময়ে বনে-জঙ্গলে, হাওর-বিল অঞ্চলের জলাশয়ে প্রচুর পাখি এখনো দেখা যায়। এসব অঞ্চলের জেলাগুলোতে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সরাইল, খুলনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ জেলাসহ অন্যান্য জেলার হোটেলগুলোতে পাখির মাংস পাওয়া যায়। এই সময়ে পাখি নানা সীমান্তপথে পাচারও হয়। শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। আমাদের পাখি শিকারিরা তাদের গুলি করে মেরে খাবার টেবিলে উপাদেয় খাদ্যে পরিণত করে। কখনো পাচার করে দেয় পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে। তাদের আর স্বদেশে ফিরে যাওয়া হয় না। আমাদের পাখিরাও প্রায়ই তাদের নিজেদের খাদ্য জোগাতে, ছানাদের খাদ্য জোগাতে বাসা থেকে বের হয়ে পাখি শিকারিদের জন্য আর ছানাদের কাছে ফিরে যেতে পারে না। তা ছাড়া বাসার পাশে শালিক সুপারি বা পেয়ারা কাছে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোটায়। বিড়ালের আগ্রাসী থাবা থেকে তাদের বাঁচানো বড় কষ্টকর। ছানারা উড়তে না শেখা পর্যন্ত মা পাখি, বাবা পাখি মিলেই পাহারা দেয়। তবু কখনো কখনো শেষ রক্ষা হয় না। খাবার আনতে বাসার বাইরে গেলে অনেক সময়ই নিষ্ঠুর অঘটন ঘটে যায়। এটা প্রাকৃতিক। অনিচ্ছায় মেনে নিতে হয়। কিন্তু মানুষ যখন শখের বশে পাখি মারে, তখন মেনে নেওয়া যায় না।
বনের প্রাণী, বনের পাখি রক্ষায় আইন আছে। তবু সুন্দরবনে পাখি কমে যাচ্ছে। আগের মতো গাছের মাথায় বড় বড় বকের সারি বাতাসে দুলতে দেখা যায় না।
আসুন, আমরা পাখিদের বাঁচতে দিই। গুলতি দিয়ে, বন্দুক দিয়ে পাখি না মারি। পাখি পাচার না করি। পাখির মাংস না খাই। বনে-জঙ্গলে-জলাশয়ে পাখি অনিন্দ্যসুন্দর পদাবলি রচনা করে। কবি-সাহিত্যিকরা মুগ্ধ হয়েছেন। শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। চিত্রগ্রাহকরা ভীষণ কষ্ট স্বীকার করে তাদের ছবি তুলে তৃপ্তি লাভ করেন। পাখি নিয়ে সব কালে অজস্র ছড়া, কবিতা রচিত হয়েছে। ‘পাখি সব করে রব’-এর অপার্থিব সৌন্দর্যে, সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে আসুন আমরাও বাঁচি, বাঁচার প্রয়াস নিই।
লেখক : গবেষক ও নারী নেত্রী।