লঞ্চ চলাচলও বন্ধ, জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়লো

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে গণপরিবহন বন্ধ থাকার দ্বিতীয় দিনের পরিস্থিতি ছিল আরও নাজুক। এদিন লঞ্চ চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। শনিবার জনদুর্ভোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও জরুরী সেবা সংস্থার কর্মীরাও। সকাল থেকেই তাদের সড়কের মোড়ে মোড়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। পরিবহন মালিকদের বাস-মিনিবাস, ট্রাকসহ পণ্যবাহী গাড়ি শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে সারাদেশে বন্ধ রয়েছে। তবে বাস বন্ধ থাকলেও চালু রয়েছে সরকারী পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাস। ধর্মঘটের অরাজকতার শিকার অনেককেই বাধ্য হয়ে চলতে হয়েছে রেল ও আকাশপথে। এতে হঠাৎ চাপ বাড়ে আকাশ ও রেলপথে। ঢাকার বাইরের পরিস্থিতিও একই। তবে চট্টগ্রামের পরিবহন চলাচলের ঘোষণা দেয়া হয়েছে বিকেলে। শনিবার ধর্মঘটে যুক্ত থাকা পরিবহন নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেও কোন সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আজ রবিবারও ধর্মঘট চলবে বলে জানিয়েছেন দেশের সবচেয়ে বড় সংগঠন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বলেছেন, আজ রবিবারের বৈঠকে একটা ফয়সালা হতে পারে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে ভাড়াও বাড়াতে হবে।
সড়ক সমিতির মতোই অঘোষিত ‘ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ট্রাক শ্রমিক-মালিক ফেডারেশন। শনিবার দুপুরে ধানমণ্ডিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে ফেডারেশনের নেতারা এসব কথা জানান। সাক্ষাত শেষে ট্রাক শ্রমিক-মালিক ফেডারেশনের অতিরিক্ত মহাসচিব আবদুল মোতালেব বলেন, হয় বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করতে হবে, নয়তো ভাড়া বাড়াতে হবে। দুটির একটি না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। শনিবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পরিবহন মালিকদের আরও একটি বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা স্থগিত করা হয়।
এটা অবৈধ : হঠাৎ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই এ ধরনের ধর্মঘটকে অবৈধ বলেছেন শ্রম অধিদফতর ও বিভিন্ন পরিবহন সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, এভাবে কৌশলে গাড়ি বন্ধ রাখা বা অবৈধ ধর্মঘট অন্যায়। তা কোনভাবেই আইনসম্মত নয়। গাড়ি বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে পরিবহন খাতের শীর্ষ বিভিন্ন নেতার সায় রয়েছে। এটা জনস্বার্থবিরোধী। এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ধর্মঘট পরিস্থিতি তৈরির পেছনের পরিবহন নেতাদের সম্মতি রয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ মনে করছেন। দেশে সাধারণ মানুষদের জিম্মি করে পরিবহন মালিকরা মুনাফা লুটের জন্যই গাড়ি বন্ধ রেখেছেন। সারাদেশের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ সড়কপথে প্রায় বিচ্ছিন্ন। শ্রম অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ধর্মঘট ডাকতে হলে শ্রমিকদের ক্ষেত্রে দাবিনামা যেমন সংশ্লিষ্ট অধিদফতরকে অবহিত করতে হয় তেমনি মালিকপক্ষকেও ধর্মঘট ডাকার আগে তা শ্রম অধিদফতরকে জানাতে হয়। আইন অনুযায়ী, পরিবহন মালিকদের দাবিনামা জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা জানাতে হবে শ্রম অধিদফতর ছাড়াও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ঢাকা মহানগর পুলিশ ও বিভিন্ন জেলা পুলিশ কার্যালয়ে। বিআরটিএ থেকেই গাড়ির রুট পারমিট অনুমোদন করা হয়। এজন্য রয়েছে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি)। এ কমিটিতে পুলিশ প্রশাসনের প্রতিনিধিও থাকেন। এবার সড়কে কৌশলে পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মঘট ডাকার ক্ষেত্রে এসব সংস্থাকে দাবিনামা জানানো হয়নি। শ্রম অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেছেন, নিবন্ধিত কোন সংগঠন ধর্মঘট আহ্বান করলে শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে, তা শ্রম অধিদফতরকে অবহিত করতে হয়। সংক্ষুব্ধদের দাবিনামাসহ ত্রিপক্ষীয় একটি বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় সুরাহা না হলে ধর্মঘট আহ্বান করা যায় বিভিন্ন শর্ত মেনে।
এ বিষয়ে বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান বলেন, বিআরটিএ থেকে অনুমোদন দেয়া বাস মালিকদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি ব্যবস্থা নিতে পারে। আগাম নোটিস না দিয়ে ধর্মঘট আহ্বান অন্যায়। তা করা হলে আরটিসি রুট পারমিট বাতিল করতে পারে। আমাদের দেশে তা করা হয় না বলে যে কোন সময় কৌশলে গাড়ি বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করা হয়।
জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, এখন আমি কিছু মন্তব্য করতে চাই না। এ বিষয়ে আজ রবিবার এগারোটায় পরিবহন নেতাদের সঙ্গে বৈঠক আছে। তবে যাই বলেন আইনের উর্ধে কেউই নয়। সবাইকে সড়ক পরিবহন আইন মানতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, শ্রম অধিদফতরে নিবন্ধিত সংগঠনগুলোর নিজ নিজ গঠনতন্ত্র থাকে। গঠনতন্ত্রে ধর্মঘট আহ্বানের নিয়মটি শ্রম আইনের আলোকে করা হয়েছে। ধর্মঘট আহ্বানের ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিয়ন বা ফেডারেশনকে সাধারণ সভা আহ্বান করতে হয়। সাধারণ সভায় উপস্থিত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ধর্মঘটের পক্ষে ভোট প্রদান করলে ১৫ কর্মদিবসের আল্টিমেটাম দিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে দাবিনামা পেশ করতে হয়। পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে না নিলে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন ধর্মঘট আহ্বান করতে পারে। এখন দেশের জনগণকে জিম্মি করে যে অঘোষিত ধর্মঘট পালন করা হচ্ছে তা শ্রম আইনের পরিপন্থী। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আগাম ঘোষণা ছাড়া সারাদেশে গাড়ি চলাচল বন্ধ করেছিলেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। ধর্মঘটের আগে আইন অনুসরণ করা হয়নি। মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের আদালত। ওই সাজার প্রতিবাদে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পরিবহন ধর্মঘট শুরু করেছিলেন পরিবহন খাতের শ্রমিকরা। হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে হাইকোর্টে ২০১৭ সালের ১ মার্চ রিট আবেদন করা হয়েছিল। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার, ধর্মঘট প্রত্যাহার না করলে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল এবং মালিকদের গাড়ি জব্দ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। পরে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।