কাজিরবাজার ডেস্ক :
পরিচিত এক ছেলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্রীর। ছাত্রীর পরিবার তার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগে এবং বিয়েতে সম্মতি দিতে বলে মেয়েকে। ছাত্রী বারবার তার প্রেমিককে এমনটি জানিয়ে আসছিলেন। প্রেমিককে বিয়ে করার কথা বলেও সুফল পাননি। একপর্যায়ে পরিবারের সম্মতিতেই অন্যত্র বিয়ে করেন ওই ছাত্রী। কিন্তু বিপত্তি বাধে বিয়ের কদিন যেতে না যেতেই। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে তোলা ছবি দিয়ে ওই ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেল করতে থাকেন সাবেক প্রেমিক। সংসার ভাঙার উপক্রম দেখে ওই ছাত্রী অভিযোগ করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার বিভাগে। কিন্তু এর আগেই শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে ভুল বুঝতে শুরু করেন।
সম্পর্কের খাতিরে ঘুরতে গিয়ে একান্ত সময় কাটানোর ছবি কিংবা ভিডিওর মাধ্যমে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেলের শিকার হচ্ছেন অনেকে। কারও কারও ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। আত্মসম্মান রক্ষার্থে অনেকে আত্মহত্ম্যাও করছেন। দিনদিন সাইবার অপরাধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেও তা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশের সাইবার বিভাগ।
পুলিশের সাইবার ইউনিটের দেয়া তথ্য মতে, প্রতিমাসে কমপক্ষে ৩ হাজার সাইবার অপরাধের অভিযোগ মিলছে। মামলা হলে জড়িতরা আটকও হচ্ছে। তবে বিচার প্রক্রিয়ায় ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এ ধরনের অভিযোগ আরও বেড়েছে। নারীদের পাশাপাশি অনেক পুরুষও সেক্সটরশনের (যৌন সম্পর্কের ঘটনা ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে সুবিধা আদায়) শিকার হচ্ছেন। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে সামাজিক বা ব্যক্তি-মর্যাদাহানি, ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় বা অন্য কোন সুবিধা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।
দেশে সাইবার অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গঠন করা হয় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাংগঠনিক কাঠামোতে যোগ করা হয় ‘সাইবার পুলিশ সেন্টার’ নামের ইউনিটটি। এছাড়া গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের (সিসিটিসি) পৃথক উইং এ নিয়ে কাজ করছে।
ডিএমপির তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত সাইবার অপরাধে মামলা হয়েছে ৫৯৮টি। আসামি ১ হাজার ১৪৭ জন। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৪০৮ জন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সাইবার অপরাধে মামলা হয়েছে ২০০টি, ২০২০ সালে ২৬২টি, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মামলা হয়েছে ১৩৬টি।
ডিএমপির সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের তথ্য মতে, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টে ২০১৯ সালে ৮৭১টি, ২০২০ সালে ১৩৩৬ ও ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে ৬০৫টি মামলা হয়। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে ২০১৯ সালে ৫৬৩, ২০২০ সালে ৬৮৩ ও ২১ সালের ছয় মাসে ৪৪২ মামলা হয়। ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাসে সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে সাইবার অপরাধীদের শিকার ৮২৭ জন ভিকটিমকে সেবা দেয়া হয়। এ সময়ে অনলাইনে সাহায্য করা হয় ৮ হাজার ৭৭০ জনকে।
ডিবির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় এর অপব্যবহার হচ্ছে, সাইবার অপরাধ বেড়েই চলছে। সাইবার বুলিংও বাড়ছে। যার শিকার হচ্ছেন নারীরা। অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে অভিযোগ করেন না, যারা অভিযোগ করেন তারা নিরুপায় হয়ে করেন। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থাও নেয়া হয়।
এদিকে সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট ২ হাজার ৬৪২টি মামলা আসে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২৫৬টি, ২০১৯ সালে ৭২১টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে আসে তিনটি মামলা। সাল ভিত্তিক মামলার সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাইবার অপরাধ দিন দিন বাড়ছে এবং এ অভিযোগে মামলাও বাড়ছে। ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১২৪টি মামলার রায় ঘোষণা করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৩৫টি মামলার আসামিদের সাজা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৮৯টি মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এছাড়া অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ২০০টিরও বেশি মামলার আসামিরা।
সরাসরি ট্রাইব্যুনালে দায়ের হয়েছে ১ হাজার ৮২টি মামলা। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২৪৯টি, ২০১৯ সালে ৬৬৮টি এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৬৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে ৪৪৭টি বিভিন্ন সংস্থাকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। বাকি ৬৩৫টি মামলায় প্রয়োজনীয় উপাদান না থাকায় আদালত খারিজ করে দেন। তদন্তাধীন ৪৪৭টি মামলার মধ্যে ১৫০টির তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে আদালতে জমা হয়েছে।
সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইন্টেলিজেন্স) মোঃ রেজাউল মাসুদ বলেন, আমাদের তিনটি উইং যথা সাইবার মনিটরিং ও সাইবার ইন্টেলিজেন্স, সাইবার ইনভেস্টিগেশন ও সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ২৪ ঘণ্টা কাজ করে। প্রতিমাসে কমপক্ষে তিন হাজার অভিযোগ আসে। প্রতারণা, হুমকি, হ্যাকিং, পর্নোগ্রাফি, আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগই বেশি। এসব অপরাধের অধিকাংশ ভুক্তভোগী হলেন নারী। তারা সাইবার পুলিশ সেন্টারের ই-মেইল, ফেসবুক অথবা ইমোতে ফোন করে অভিযোগগুলো দেন।
পুলিশের ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) তথ্য মতে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাইবার অপরাধের ঘটনায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ৩ হাজার ৬৫৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৭৫টি মামলা সাইবার ট্রাইব্যুনালে গেছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২২টির। ২৫ মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে দেশের বিভিন্ন থানায় সাইবার ক্রাইমসংক্রান্ত ২ হাজার ১৯২টি মামলা হয়। এর মধ্যে সেক্সটরশনের অভিযোগ করেন ৫৫ জন পুরুষ ও ১১৮ জন নারী। সেক্সটরশনের শিকারদের বেশির ভাগই নারী। তাদের বয়স ১৯ থেকে ৩৫ বছর। ২০২০ সালে এই নারীদের মধ্যে ১০১ জন সেক্সটরশনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন। পুরুষদের মধ্যে এ অভিযোগ করেছেন ৪৩ জন।
সিডিএমএসের তথ্য মতে, ২০২০ সালে সারাদেশের বিভিন্ন থানায় সাইবার ক্রাইমসংক্রান্ত ২ হাজার ১৯২টি মামলা হয়। এর মধ্যে ফেসবুক আইডি হ্যাক করার অভিযোগ করেন ৩৬৭ পুরুষ ও ৩৫৮ নারী। ই-মেইল আইডি হ্যাকের অভিযোগ করেন ৩৫ পুরুষ ও ১৩ নারী। ফেক আইডি খোলার অভিযোগ করেন ১৬৩ পুরুষ ও ২৩১ নারী। সেক্সটরশনের অভিযোগ করেন ৫৫ পুরুষ ও ১১৮ নারী। মোবাইল ব্যাংকিংসংক্রান্ত অভিযোগ করেন ৩১০ পুরুষ ও ১০২ নারী। অন্যান্য হয়রানির অভিযোগ করেন ২৪৭ পুরুষ ও ১৯৩ নারী।
ডিএমপির ডিবির (দক্ষিণ) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, সাইবার অপরাধ দিন দিন বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ ‘সচেতনহীনতা’। এছাড়া বহু কারণে সাইবার অপরাধ বাড়ছে। আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন, তাদের আরও সতর্ক হতে হবে। কেউ সাইবার অপরাধীদের শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আশ্রয় নেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।