কাজিরবাজার ডেস্ক :
দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড গত বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত টানা বৈঠক করে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। বোর্ডের কাছে যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তৃণমূলে বিতর্কিত চিহ্নিত হয়েছেন অনেকে। এ নিয়ে দলের ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বিক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতা ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা বলছেন, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে প্রার্থিতা বাতিল হবে। তবে তথ্য-প্রমাণ ছাড়া ঢালাও অভিযোগ আমলে নেওয়া হচ্ছে না। বোর্ডের সদস্যরা বলেন, মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় অনেকেই ক্ষুব্ধ। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে অনেকেই ঢালাও অভিযোগ করে যাচ্ছেন।
তারা আরও বলেন, কিছু ভুলত্রুটি হলে প্রার্থী বদলাচ্ছি। অন্তত ১০টি ইউনিয়নে তা করাও হয়েছে।
দুর্নীতিতে জড়িত বা সাবেক বিদ্রোহী প্রার্থী কিংবা অরাজনৈতিক কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী মহল। এ নিয়ে তৃণমূলে মৌখিক নির্দেশনাও পাঠিয়েছিল কেন্দ্র। বলা হয়েছিল অভিযুক্ত কেউ থাকলে তাদের বাদ দিতে। তৃণমূল নেতাদের দাবি, নির্দেশনা অনেক ধরনের থাকলেও মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি।
তৃণমূল নেতারা আরও দাবি করেন, চাঁদাবাজি, হত্যা ও মাদক মামলার আসামিও নৌকা প্রতীক নিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র থেকে। অপরদিকে ত্যাগী নেতারা হতাশ হয়ে রাজনীতি ছেড়ে দিতে যাচ্ছেন। বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে যেসব অভিযোগ উঠে এসেছে-
নৌকা পেলেন সাবেক বিএনপি নেতা
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানা বিএনপির বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম সেন্টু এবার কুতুবপুর ইউপিতে নৌকার টিকিট পেয়েছেন। সেন্টুর বিরুদ্ধে নাশকতার কয়েকটি মামলাও রয়েছে। বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম সাইফুল্লাহ বাদল এ প্রসঙ্গে বলেন, কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ থেকে শুধু সেন্টুর নাম পাঠিয়েছে। আমরা সেই নাম জেলায় ফরোয়ার্ড করেছি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই বলেন, ‘ইউপি ও উপজেলা থেকে শুধু সেন্টুর নামই পাঠানো হয়েছিল। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কখন দলে যোগ দিয়েছে। স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেনি। তাই চিঠিতে সই করিনি। তিনি বলেন, সে তো চিহ্নিত বিএনপি নেতা। এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না।’
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান ও ছাত্রদলের সাবেক সদস্য সচিব আশরাফুল হক। তার বাবা প্রয়াত সিরাজুল হকও বাঁশগাড়ী ইউপির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি রায়পুরা উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতিও ছিলেন।
রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইমান উদ্দিন ভুইয়া বলেন, ‘আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাবেক এক কেন্দ্রীয় নেতার ইচ্ছায় আশরাফুলের নাম কেন্দ্রে পাঠাই। তবে তার নামের পাশে অনুপ্রবেশকারী লিখে দিয়েছিলাম। এরপরেও মনোনয়ন বোর্ড কী করে তাকে বাছাই করেছে তা বোধগম্য নয়।’
পটুয়াখালীর মরিচবুনিয়া ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আসাদুল ইসলাম আসাদ। আসাদের পরিবার বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত বলে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
গত ৯ অক্টোবর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ভিপি আব্দুল মান্নান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ধানমন্ডির কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, মনোনয়ন প্রত্যাশী আসাদের বড় ভাই রফিকুল ইসলাম মুন্সি মরিচবুনিয়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক। এ ছাড়া আসাদের আপন মামাশ্বশুর মরিচবুনিয়া ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক।
মরিচবুনিয়া ইউপি থেকে আসাদ মনোনয়ন পাওয়ায় পরদিন রবিবার রাতে ধানমন্ডিতে বিক্ষোভ করে পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা ‘বিএনপির হাতে নৌকা কেন’ শ্লোগান দিতে থাকে।
পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর হোসেন বলেন, মরিচবুনিয়া ইউপিতে মনোনয়ন পাওয়া আসাদের (আসাদুল ইসলাম আসাদ) পরিবার বিএনপি করে। এ নিয়ে আমরা প্রত্যয়নপত্র দিয়েছি প্রধানমন্ত্রী বরাবর।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, কিছু ভুলত্রুটি থাকছে। সত্যতা ফেলে ব্যবস্থা নেবো।
বিদ্রোহীর হাতে নৌকা
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে অতীতে বিদ্রোহী হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে যারা নির্বাচন করেছেন তিনি যতই জনপ্রিয় হন তাকে আর মনোনয়ন দেওয়া হবে না। প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে বিষয়টি বিবেচনাও করা হয়েছিল। বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলও হয়েছিল সেসময়। কিন্তু এবার পটুয়াখালীর দুটি ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে তারা ডামি প্রার্থী ছিলেন ওই নির্বাচনে।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নওমালা ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে পরাজিত হয়েছিলেন কামাল হোসেন বিশ্বাস। তিনি ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে মাত্র ১৩৫ ভোট পেয়েছিলেন তিনি।
পটুয়াখালীর দশমিনা ইউনিয়নে গতবারের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হওয়া ইকবাল মাহমুদ লিটন এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। তালিকায় তার নাম পাঠানোর বিষয়ে জেলা সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় তার (লিটন) নাম পাঠাতে বলেছেন। এখন নেত্রী তাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। আমার তো কিছু করার নাই।’
আওয়ামী লীগের নেতা কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থীকে কোনোমতেই মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। সে একেবারেই বাদ। পটুয়াখালীতে যিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি ছিলেন আমাদের ডামি প্রার্থী। সেটা আমাদের জানিয়ে রাখা হয়েছিল।’
চাঁদাবাজি, হত্যা ও মাদক মামলার আসামি
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মহিদুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে যুবলীগ কর্মী ওমর ফারুক, আওয়ামী লীগ কর্মী শিমুল হত্যাসহ তিনটি মামলা রয়েছে। একটি চাঁদাবাজির মামলাও আছে। এরমধ্যে একটি মামলায় তিনি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি।
একই উপজেলার বুড়িগঞ্জ ইউপিতে মনোনয়ন পাওয়া রেজাউল করিম চঞ্চলকে র্যাব বিশেষ ক্ষমতা আইনে মাদকপাচারের দায়ে গ্রেফতার করে।
প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা আত্মসাতে অভিযুক্ত
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার ময়দানহাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম রূপম। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তার অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করলে সেই আদেশ স্থগিত হয়।
রায়নগর ইউনিয়নে মনোনয়ন পাওয়া শাহজাহান কাজী স্থানীয় বাঘমারা মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সহ-সভাপতি। ওই মাদ্রাসার গাছ চুরির অপরাধে জেলও খাটেন তিনি।
শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা নয়। দলের তৃণমূল থেকে তিন জন করে প্রার্থীর যে তালিকা পাঠানো হয়েছে, তা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকেই এসব প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছে।
তিন প্রার্থী পরিবর্তন
গত ১০ ও ১১ অক্টোবর পৃথক দুই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মেহেরপুরের মহাজনপুর, খুলনার আটালিয়া এবং নড়াইলের বিছালী ইউপির প্রার্থী পরিবর্তনের কথা জানানো হয়। মেহেরপুর ও খুলনার প্রার্থী পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রকাশিত তালিকায় অসাবধানতাবশত দুটি ইউপির চেয়ারম্যান পদে মনোনীত প্রার্থীর পরিবর্তে ভুল নাম লেখার কথা বলা হয়েছে দল থেকে। বিছালীর ক্ষেত্রে কোনও কারণ উল্লেখ করা হয়নি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘মনোনয়ন বোর্ড চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রার্থীর হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দেয়। শতভাগ শুদ্ধ মনোনয়ন হয় সেটাও নয়। কিছু ভুলত্রুটি ধরা পড়ে। সংশোধনের চেষ্টাও করা হয়। আর বঞ্চিত পক্ষের ক্ষোভ তো থাকবেই।’
এদিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার ১০নং নরোত্তমপুর ইউনিয়নে বিএনপি নেতা মো. হারুনুর রশিদ বাচ্চু পেয়েছেন নৌকার মনোনয়ন। এ নিয়ে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল চলছে। তিনি গতবার ইউপি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন।