কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়েছেন। তাদের এই সমস্যায় পড়ার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা গেছে, পরিবারের সদস্যদের করোনায় আক্রান্ত হওয়া। এছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, যা জরিপে মোট অংশগ্রহণকারী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর ৮৬.৮৪শতাংশ।
শনিবার (৯ অক্টোবর) সামাজিক সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ‘বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের প্রভাব’ শীর্ষক জরিপে এসব চিত্র পাওয়া যায় বলে জানান উদ্যোক্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ। এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেনÍ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. ইমরান মাহমুদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর আফসানা বেগম, সাইকোলজিস্ট দীপন সরকার।
আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, ধারাবাহিক জরিপ কাজের এবারের জরিপটির মূল লক্ষ্য ছিল কোভিড-১৯ মহামারির ফলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, সে বিষয়ে বিশ্লেষণ করা।
জরিপে প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগ এই করোনা মহামারিতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার (যেমন- মন খারাপ থাকা, ঠিকমতো ঘুম না হওয়া, নিজেকে তুচ্ছ ভাবা ইত্যাদি) সম্মুখীন হয়েছেন। অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ বা ২ হাজার ১৬০ জন শিক্ষার্থী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯৯৯ জন পুরুষ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ১ হাজার ৫৫২ জন নারী শিক্ষার্থীর ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ এই মহামারিতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। এখানে লক্ষণীয় যে, পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
করোনাকালীন অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থী করোনা মহামারিতে শহরে অবস্থান করেছেন। অংশগ্রহণকারী মোট শিক্ষার্থীর ৩০.৩ শতাংশ গ্রামে ও ৬৯.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী শহরে অবস্থান করেছেন। যারা ডিপ্রেশনে ভুগেছেন তাদের মধ্যে শহরে ছিলেন ৮৪.০ শতাংশ ও গ্রামে ছিলেন ৮৬.২ শতাংশ। এটি নির্দেশ করে শহরের চেয়ে গ্রামে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের মানসিক বিপর্যয়ের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
জরিপে উঠে আসে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণকারী মোট ৭৩৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯১ জন বা ৮০.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। ধারণা করা যায়, অনলাইনে হলেও পড়াশুনা চলমান থাকায় প্রাইভেটের শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক সমস্যার হার তুলনামূলক কম।
আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, শিক্ষার্থী বা তার পরিবারের সদস্যরা করোনায় আক্রান্ত হওয়া মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রধান কারণ। জরিপে অংশগ্রহণকারী ২ হাজার ৫৫২ জন শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বা তাদের পরিবারের সদস্যরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর মানসিক অশান্তির হার সবচেয়ে বেশি, যা প্রায় ৮৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। যারা করোনাক্রান্ত হননি তাদের চেয়ে ১০ দশমিক ০৮ শতাংশ বেশি।
দ্বিতীয়ত, করোনাকালীন মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো সঠিক সময়ে না ঘুমানো। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ যেহেতু অনলাইনের মাধ্যমে তাদের প্রাত্যহিক কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেন, তাই দিনের বড় একটা সময় তাদের স্ক্রিনের সামনে অতিবাহিত করতে হয়েছে। দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে থাকায় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। এর মধ্যে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া, মাথা ব্যথা, কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটা অন্যতম। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির আরেকটি বড় কারণ এটি। এছাড়া জরিপ হতে মানসিক সমস্যার আরও যেসব কারণ চিহ্নিত করা গিয়েছে সেগুলোর শীর্ষে রযেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, দ্বিতীয় স্থানে আছে একাকিত্ব। অপরদিকে সেশনজটকে মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে তৃতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন শিক্ষার্থীরা।
মানসিক ঝুঁকি বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আঁচল ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের লিডার সাজিয়া ইফফাত বলেন, ‘এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে এটি শিক্ষার্থীদের অগ্রসরের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আমরা মনে করি, পরিস্থিতি বিবেচনায় সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে যদি একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হই, তবে শিক্ষার্থীরা এই মানসিক সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারবেন।’
উত্তরণের পথ নিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘সমস্যাটা এমন যে, এটা একপাক্ষিকভাবে সমাধান করা কঠিন। আমরা দেখতে পাই, যেসব শিক্ষার্থী ঠিকমতো ঘুমাতে যান না, তাদের মাঝে বিষণ্নতা বেশি। যারা অতিমাত্রায় ডিভাইস ব্যবহার করেন তাদের ডিপ্রেশনের হার বেশি। পরিমিত ঘুম, সঠিক মাত্রায় ডিভাইস ব্যবহার, কোনও কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে।’