কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা থামছেই না ॥ কর্মসংস্থানের নামে পাচারও হচ্ছে

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রযুক্তির আলোয় সারাদেশ উদ্ভাসিত হলেও কমছেই না কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা, নির্যাতন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মতো ঘটনা। এসব ছাড়িয়ে নতুন করে যোগ হয়েছে প্রযুক্তির প্রলোভনে কন্যাশিশু পাচার। না বুঝেই সরলমনা কিশোরীরা টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের ফাঁদে পড়ে প্রেমের নামে প্রতারণার শিকার হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে দুবাই, সৌদি আরবসহ বিশে^র অন্যান্য দেশে। করোনা মহামারীকালে আর্থিক সঙ্কটে পড়া অনেক পরিবারের কন্যাশিশুদের কর্মসংস্থানের নামেও পাচার করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। যেখানে ভয়াবহ যৌন নির্যাতন, অমানবিক শারীরিক পরিশ্রম করতে হচ্ছে তাদের। কেউ কেউ হচ্ছে হত্যার শিকারও। করোনাকালীন বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজ থেকে ঝড়ে পড়া কন্যাশিশুরাও আর ফিরছে না ক্লাসে। তারা ঝরে পড়া অবস্থাতেই রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই ২৯ অক্টোবর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে পালিত হয়েছে শিশু অধিকার সপ্তাহ। যেখানে ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। তবে কোন দিবস পালন নয় বরং কন্যাশিশুর জন্য নিরাপদ ভবিষ্যতের দাবি করছেন অভিভাবকেরা। একই সঙ্গে কন্যাশিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, সহিংসতা ও পাচারকার্যে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা। আর বিশিষ্টজনরা বলছেন, কন্যাশিশুর পথচলা এখনই নিরাপদ না করতে পারলে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহ মাসুল দিতে হবে।
জাতীয় কন্যাশিশু এ্যাডভোকেসি ফোরামের এক গবেষণা প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে জানা যায়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত উচ্চ আদালতে দাখিলকৃত পুলিশ সদর দফতরের তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশের থানাগুলোতে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩৩১টি, ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৬৮৩টি, ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৬৯৫টি, ২০১৯ সালে ৬ হাজার ৭৬৬টি ও ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৬ হাজার ২২০টি মামলা দায়ের করা হয়। আর চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে দেশে অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে ১৪০ কন্যাশিশু। এর মধ্যে অপহরণ হয়েছে ৫৮ কন্যাশিশু। অপরদিকে জাতীয় মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাচার হয়েছে ৪ কন্যাশিশু। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নবেম্বরে পাচার হয় আরও ৩ কন্যাশিশু।
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কত নারী পাচার হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান পুলিশের কাছে না থাকলেও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু পাচার হয়েছে। বছরে দেশ থেকে ২০ হাজার নারী, কিশোরী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে। অপর এক হিসাব অনুযায়ী কয়েক বছরে ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্যান্য দেশে ৫০ হাজার নারী ও কন্যাশিশু পাচার হয়েছে। সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার মোঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশজুড়ে নারী ও শিশু পাচারকারীদের ভয়াবহ নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা টিকটক, লাইকি, ফেসবুক, ইমো, ভাইবার, ডিসকড, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির অ্যাপস ব্যবহার করে পাচারের জন্য নারীদের সংগ্রহ করছে। নিজস্ব দালাল নিয়োগ করেও নানা কৌশলে নারীদের পাচার করে দিচ্ছে ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, কাতার, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে। এরকম ৩০টি বা তারও বেশি চক্র সারাদেশে রয়েছে বলেও জানান তিনি।
কন্যাশিশুকে যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণের মতো ঘটনার পাশাপাশি পাচারের ঘটনাকে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক হিসেবে মন্তব্য করে জাতীয় মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা আমাদের দেশে এক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদেরকে সমাজে দুইভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। একদিকে সামগ্রিকভাবে নিপীড়িতদের একজন হিসেবে, অন্যদিকে কেবল নারী হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত তাদেরকে নানা নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়। যাকে লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন বলা হয়। নবজাতক কন্যাশিশুর প্রতি সমাজের যে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ৮০ বছরের বৃদ্ধ নারীর প্রতিও একই দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজমান। তবে সময়, বয়স ও পারিপাশির্^ক পরিস্থিতিতে অনেক সময় নিপীড়নের চেহারা ভিন্ন হয়, নিপীড়কের ভূমিকাও ভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হলো নারী ও কন্যাশিশুরা সর্বত্রই নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। নতুন করে প্রযুক্তির ব্যবহার করে এক নতুন ধারার নির্যাতন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে যেমন সাইবার বুলিং রয়েছে তেমনি রয়েছে প্রেমের ফাঁদে ফেলে পাচারের মতো ঘটনাও। কর্মসংস্থানের নামেও পাচার হচ্ছে অনেক। আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত তথ্য আসছে এসবের। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি টিকটক বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এমনভাবেই অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শিশুদের পদচারণা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পাচার রোধে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে অনেক কঠিন সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।
অধিকাংশ পাচারের ঘটনা প্রেমের ফাঁদে বা কর্মসংস্থান তৈরির নামেই হয়ে থাকে দাবি করে জাতীয় কন্যাশিশু এ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, সম্প্রতি ইন্টারনেটের মাধ্যমে মডেলিং বা নৃত্যশিল্প বানানোর নাম করেও পাচারের ঘটনা আমরা দেখেছি। এসব ক্ষেত্রে পরিবারের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন বন্ধ এবং তাদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মিডিয়া একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি কন্যাশিশুর প্রতি বঞ্চনা শুরু হয় তার জন্মলগ্ন থেকেই। কোন কোন ক্ষেত্রে ভ্রƒণ অবস্থা থেকেই। তাই তাদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ ও বঞ্চনা প্রতিরোধের কর্মকৌশল নির্ধারণ, পাশাপাশি এ্যাডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কন্যাশিশুদের সার্বিক চিত্র জানা প্রয়োজন। বিশেষ করে জানা প্রয়োজন তাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে। আমরা বিশ্বাস করি কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন বন্ধ এবং তাদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবারের যেমন ভূমিকা রাখতে হবে তেমনি রাষ্ট্রের ভূমিকা রাখতে হবে। একটি শক্তিশালী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পলিসি তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
সম্প্রতি টিকটক হৃদয় ও তার বাহিনী কর্তৃক ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে এক বাংলাদেশী তরুণীকে ভয়াবহ নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরপরই নারী ও কন্যাশিশু পাচারের ঘটনাটি আলোচনায় আসে। এরপর পরই ধারাবাহিকভাবে আরও কয়েকটি নারী ও কন্যাশিশু পাচারের ঘটনা আলোচনায় আসে। এসব ঘটনা দেখে আতঙ্কে সময় পার করছেন কন্যাশিশুর অভিভাবকরা। রাজধানীর গ্রীনরোড এলাকার বাসিন্দা রাখী রানি বলেন, করোনার সময় স্কুল বন্ধ থাকায় একমাত্র মেয়েকে নিয়ে দিনের পর দিন ঘরেই সময় কাটিয়েছি। কিন্তু অনলাইনে ক্লাস করার ফলে সারাক্ষণ তার অনলাইনে বিচরণ ছিলই। টিকটক, ইনস্টাগ্রাম কতকিছু যে বলে সে। আমার মাথায় এসবের কিছুই ঢুকে না। সম্প্রতি টিকটকের মাধ্যমের পরিচয়ের সূত্র ধরে তরুণী পাচারের ঘটনা খবরে দেখার পর থেকেই আতঙ্কে সময় কাটে। এই বুঝি কি হয়ে যায়। আমাদের কন্যা সন্তানদের ভবিষ্যত নিরাপত্তায় সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।