ই-কমার্সের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়, শীর্ষে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ও দারাজ

22

কাজিরবাজার ডেস্ক :
গণমাধ্যম কর্মী নাজমুল হোসেন ইভ্যালি থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে বাটার তিনটি গিফট ভাউচার কেনেন গত ১ মে। পুরো টাকা নগদের মাধ্যমে পরিশোধ করেন। তার অর্ডার গ্রহণ করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রসেস করার কথা থাকলেও ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনও খবর নেই। বারবার ইভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগ করেও সমাধান পাননি তিনি। আর রিফান্ড চাওয়ার কোনও অপশন না থাকাতেও পড়েছেন বিপাকে।
শুধু নাজমুল হোসেন নন, এমন আরও অসংখ্য গ্রাহক ভোগান্তির স্বীকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক গ্রাহক জানান, গত মার্চ মাসে ৯৬ হাজার ১৯৫ টাকায় টিভিএস আরটিআর (১ লাখ ৭৪ হাজার বাজার মূল্য) মোটরসাইকেল ইভ্যালিতে অর্ডার করেন। ৪৫ দিনের মধ্যে না দিলে তিনি যোগাযোগ করেন ইভ্যালির অফিসে। তারা জানান, অর্ডার প্রসেসিংয়ে আছে। এর দুমাস পর রিফান্ডের কথা বলা হলে রাজি হন, ফর্ম পূরণ করেন। তারপরও সাড়া দেয়নি ইভ্যালি। কুরিয়ারের মাধ্যমে চেক পাঠানোর কথা থাকলেও তা পাননি তিনি। পরে অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করে চেক পান জুন মাসে। চেক দেওয়ার পর দেখেন ৬ সেপ্টেম্বর তারিখের ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার একটি পোস্ট ডেটেড চেক দেওয়া হয়েছে মিডল্যান্ড ব্যাংকের। তিনি জানান, সেই চেকের অ্যাকাউন্ট অনেক আগেই ক্লোজ। যার ফলে ইভ্যালি থেকে তাকে চেক জমা দিতে মানা করে। এরপর অ্যাকাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফারের মধ্যমে টাকাটা দেওয়ার কথা জানানো হয় ইভ্যালির পক্ষ থেকে। যদিও এখন পর্যন্ত তিনি কিছুই পাননি।
ইভ্যালির মতো চার বছরে ই-কমার্স খাতে অভিযোগ এসেছে ১৯ হাজার ৩০৪টি। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এই অভিযোগগুলো দায়ের হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে। এর মধ্যে শীর্ষে আছে ইভ্যালি, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিমাণ ৭ হাজার ১৩৮টি। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪৯৫টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলে জানায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, ইভ্যালি ছাড়াও ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৬৪৩টি, দারাজের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৫১টি, প্রিয়শপ ডটকমের বিরুদ্ধে ৬২৬টি, ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে ৩২৩টি, ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে ৩২২টি, পাঠাওয়ের বিরুদ্ধে ২৬৭টি, চালডাল ডটকমের বিরুদ্ধে ১৯০টি, আজকেরডিল ডটকমের বিরুদ্ধে ১৮২টি, বিক্রয় ডটকমের বিরুদ্ধে ১৭৪টি, উবারের বিরুদ্ধে ১২৮টি, সহজ ডট কমের বিরুদ্ধে ৯৩টি, আলেশামার্টের বিরুদ্ধে ২০টিসহ বিভিন্ন ফেসবুক পেজের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ৯৮২টি অভিযোগ দাখিল হয়েছে গত চার বছরে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি অভিযোগ হচ্ছে পণ্য সময়মতো না পাওয়া এবং এক পণ্যের পরিবর্তে অন্য পণ্য দেওয়া। বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্ত এবং শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করছে অধিদফতর। এর মধ্যে কয়েকটি ই-কমার্স ভিত্তিক কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ৯০ শতাংশের ওপরে নিষ্পত্তি হলেও এখনও অনেকগুলোর নিষ্পত্তির হার কম আছে।
অভিযোগ নিষ্পত্তির দিক থেকে এগিয়ে আছে পাঠাও, উবার, আজকেরডিল ডট কম, সহজ ডট কম এবং দারাজ। এছাড়া ই-অরেঞ্জ ডট কমের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৬৪৩টি অভিযোগ এলেও তার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৩৩টির। আর ইভ্যালির বিরুদ্ধে আসা ৭ হাজার ১৩৮টি অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪ হাজার ৪৯৫টির। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ এবং ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধেই ৫ হাজার অভিযোগ করা হয়েছে। জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৬৪৩টি অভিযোগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে শুধু ৩৩টি বা ১ দশমিক ২৪ শতাংশ অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে পেরেছে ডিএনসিআরপি।
ই-কমার্স খাতের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সচরাচর অভিযোগ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে এলেও ফৌজদারি মামলা আগে কখনও দায়ের হয়নি। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া মেহজাবিন এবং প্রতিষ্ঠানটির বেশ কিছু কর্মকর্তা ১৬ আগস্ট গ্রাহকদের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে গ্রেফতার হন। এরপর থেকে তারা কারাগারেই আছেন। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বনানী থানার ওসি (তদন্ত ) সোহেল রানাকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে আটক করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। এছাড়া গুলশান থানায় এক গ্রাহকের করা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল এবং এর চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন কারাগারে আছেন।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮ নামে একটি আইন থাকলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বছরের জুলাই মাসের আগে পর্যন্ত মানসম্মত কার্যপ্রণালীবিধি (এসওপি) ও নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। এই নীতিমালা অনুযায়ী একটি ই-কমার্স নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি করার কথা থাকলেও সরকার এখনও তা করেনি। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আনোয়ারুল ইসলাম বাঁধন গত সোমবার দ্রুত ই-কমার্স নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরির নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেছেন।
ইভ্যালির বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেছেন, দেশে বর্তমানে ৩০ হাজার অনলাইন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১০-১২টির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। তাই সামগ্রিকভাবে অনলাইন প্রতিষ্ঠানকে খারাপ বলা যাবে না। এর আগে আমরা দেখেছি- ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানের সম্পদ কাজে লাগানো হয়নি। সেগুলো অন্যরা ভোগদখলে রেখেছে। অথচ গ্রাহক তাদের পাওনা বুঝে পাননি। ইভ্যালির ক্ষেত্রেও যেন এমনটা না হয় সেজন্য গ্রাহকদের টাকা ফেরতের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার।
ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ও গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে সরকারকে ছয়টি প্রস্তাবনা দিয়েছে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)। প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বিদ্যমান সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করে ই-ক্যাব। বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এই প্রস্তাবনাগুলো পাঠায় তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, আমাদের প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে আছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মাধ্যমে সেন্ট্রাল ডিজিটাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরি, এবং সমস্যা প্রতিকারে আইন প্রয়োগ। আমাদের অটোমেশনে যেতে হবে। তা নাহলে এরকম হাজার হাজার অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারবো না। এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর উপায় হচ্ছে ডিজিটাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। ভোক্তা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এটি দেখবে এবং ই ক্যাব কারিগরি সহযোগিতা দিবে। আমাদের প্রস্তাবনাগুলো যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিবেচনা করে আমরা আশা করি এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে।
ই-ক্যাবের অন্যান্য প্রস্তাবনার মধ্যে আছে‑ ডিজিটাল কমার্স সেল কার্যকর ও এর সক্ষমতা বাড়ানো (প্রয়োজনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার), ডিজিটাল কমার্স পলিসি-২০১৮ মোতাবেক কমিটি গঠন (রিস্ক ফ্যাক্টর ম্যানেজমেন্ট কমিটি, কারিগরি কমিটি, উপদেষ্টা কমিটি) বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এসক্রো সেবা চালু, ডাক বিভাগকে সংযুক্ত করে ডেলিভারি বা লজিস্টিক এগ্রিগেটর প্ল্যাটফর্ম।