পাসপোর্ট সঙ্কটে ভোগান্তি চরমে

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পাসপোর্ট ভোগান্তি চলছেই। দেশ-বিদেশে সমানতালে এ সঙ্কট। পাসপোর্ট অধিদফতরের সার্ভারের যান্ত্রিক ত্রুটি ও বইয়ের অভাবের দরুন সাময়িকভাবে প্রবাসীদের জন্যও পাসপোর্ট সেবা বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন প্রবাসীরা। আপাতত করোনার ওপর সব দায় চাপানো হলেও প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে- সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণেই এ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কবে নাগাদ তার সুরাহা হবে সেটাও অনিশ্চিত। যদিও বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরীর দৃষ্টিতে এটা তেমন কোন সঙ্কট নয়, সাময়িক। নানা কারণে এ ধরনের সঙ্কট হতে পারে। এটা কেটে যাবে।
জানা গেছে, গত জুলাই মাস থেকে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে নতুন পাসপোর্ট ইস্যু কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এমআরপি সার্ভার সঠিক সময়ে হালনাগাদ না করায় পাসপোর্ট তৈরির কাজ থমকে গেছে। একটি সার্ভারে এই পাসপোর্ট ছাপানো হতো। জুন মাসে পাসপোর্ট অধিদফতরের এই ধারণ ক্ষমতা তিন কোটির বেশি সীমা পার হয়। এ কারণে পাসপোর্ট প্রিন্ট বন্ধ। ফলে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, ওমান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, লেবাননসহ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের অনেকেরই পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও আবেদন করেও পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। ফলে পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে ভিসার মেয়াদও বাড়াতে পারছেন না। এতে তাদের সেই দেশে গ্রেফতার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। আবার পাসপোর্ট না পেয়ে কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করার আবেদনও করতে পারছেন না। কেউ কেউ ছুটিতে দেশে আসতে পারছেন না। রাস্তায় চলাচল থেকে কর্মস্থলেও পড়ছেন ঝামেলায়। উপায়ান্তর না পেয়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে হাতে লিখে। এই পরিস্থিতিতে একের পর এক বিভিন্ন দূতাবাস থেকে জরুরী বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রবাসীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাওয়া হচ্ছে। এমন কঠিন সঙ্কটেও সম্প্রতি পাসপোর্ট অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে- তেমন কোন সঙ্কট নেই। সবই ঠিক হয়ে যাচ্ছে। অথচ আগারগাঁওয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে শত শত মানুষের অভিযোগ পাওয়া যায় পাসপোর্ট নিয়ে। কেউ বলছেন, সার্ভার স্লো হয়ে যাওয়ায় সঠিক সময়ে সেবা মিলছে না। কেউ বলছেন ই-পাসপোর্ট ও এমআরপি উভয়টাতেই সঙ্কট। কেউই স্বাভাবিক গতিতে পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছেন না। সাভারের রফিকুল ইসলাম এমন একজন ভুক্তভোগী যিনি দ্রুত সময়ে সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করাতে এসেছিলেন। কিন্তুু সারাদিন অপেক্ষা করে ই-পাসপোর্ট করাতে পারেননি। সার্ভার ডাউন থাকায় সারাদিন অপেক্ষা করার শেষ মুহূর্তে ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে পারেননি তিনি। ফলে আবারও তাকে সাভার থেকে পাসপোর্ট অফিসে আসতে হয়। মানিকগঞ্জের এক যুবক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন-আপনারা সাংবাদিকরা পাসপোর্টের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বললে মনে হবে দেশে কোন পাসপোর্ট সঙ্কট নেই। কিন্তু দেখেন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি কেমন। এখানে উপচেপড়া ভিড়। ভিড় সামলাতে বাধ্য হয়ে অফিসের গেট বন্ধ করা হয়। আবার খোলা হয়। হতে পারে স্বল্প জনবল দিয়ে হঠাৎ করে বেশি মানুষকে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- দেশের মতো বিদেশী মিশনগুলোতেও পাসপোর্ট নবায়ন সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। তাঁরা বলছেন- পাসপোর্টের মেয়াদ না থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ও মালয়েশিয়ায় যেমন বাংলাদেশী শ্রমিকদের আটক হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তেমনি মেয়াদ উত্তীর্ণ পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করা যায় না। জানা গেছে- গত জুনের মাঝামাঝি থেকে এমআরপি সার্ভারে কার্যত কোন তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে পাসপোর্ট নবায়ন করা যাচ্ছে না। এতেই বিপাকে পড়েন প্রবাসীরা। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়-এ সঙ্কট পাসপোর্ট অধিদফতর থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কিছু জানানো হয়নি। ফলে মন্ত্রণালয়ও মিশনগুলোতে কোন নির্দেশনা পাঠাতে পারেনি। যে কারণে মিশনগুলোও নিজেদের মতো করে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে পাসপোর্ট সেবা বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে। লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাস গত ২৮ জুন এবং চলতি মাসের শুরুর দিকে জাপান, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপে বাংলাদেশের মিশন পাসপোর্ট নবায়নে দেরির বিষয়টি জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়। কবে নাগাদ এ সেবা মিলবে সেটাও জানতে পারছে না প্রবাসীরা। এমনই এক ভুক্তভোগী মালয়েশিয়া প্রবাসী শহীদুল গণমাধ্যমকে জানান- তিনি এ বছরের শুরুতে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আবেদন করেছিলেন। গত ১৮ মার্চ তাঁর নতুন পাসপোর্ট পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি এখনও পাসপোর্ট বুঝে পাননি। কবে পাসপোর্ট পাবেন সেটা নিশ্চিত হতে পারছেন না। তার মতো অনেকেই পাসপোর্ট নবায়ন করাতে দিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষায় রয়েছেন।
জানা গেছে, পাসপোর্ট নিয়ে সঙ্কট হঠাৎ একদিনে হয়নি। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরে আসে গত মাসের প্রথম সপ্তাহে। পাসপোর্টের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা নতুন নয়। আগেও এমনটা হয়েছে। এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন-নীতি নির্ধারকরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় এ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। প্রতিবছর পাসপোর্টের কি পরিমাণ চাহিদা দেখা দেয় তার বিপরীতে কি পরিমাণ সর্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখতে হবে- যান্ত্রিক বা সার্ভার সঙ্কটে পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করতে হয়- সেটার কোন পরিকল্পনা করা হয়নি। এমনকি করোনা চলছে দু’বছর ধরে। এসময়ে পৃথিবীব্যাপী সঙ্কট থাকবে এটা গত বছরের মার্চেই জানা গিয়েছিল। তারপরও আপদকালীন সঙ্কট মোকাবেলায় কি করতে হবে এমন চিন্তাই নীতিনির্ধাকরদের মাথায় আসেনি। যার খেসারত দিতে হয়েছে এখন সাধারণ মানুষকে।
এদিকে বিধিনিষেধের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার পাসপোর্ট অফিসে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয়। এতে প্রথমদিন অতিরিক্ত মানুষের চাপ সামলাতে দুপুরের দিকে প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন মানুষের ভিড় আরও বাড়ে। এদিনও একপর্যায়ে মেইন গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। আবার তিনদিন বন্ধ থাকার পর শুরু হয় স্বাভাবিক কার্যক্রম। কিন্তু দীর্ঘ সময় সার্ভার ডাউন থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন অনলাইনে ই-পাসপোর্ট আবেদনকারীরা। নগরীর জিগাতলা থেকে আসা আরিফুল ইসলাম বলেন, অনলাইনে ই-পাসপোর্ট আবেদন করতে পারিনি আগেরদিন। পরের দিনও একই সমস্যা। জানিনা কখন পাব।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে যে সঙ্কট তা মূলত যান্ত্রিক। যদিও কর্তৃৃপক্ষ দাবি করেছে-সার্ভার ডাউন যাতে আর না হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের পরিচালক (ই-পাসপোর্ট প্রকল্প) মোঃ সাইদুর রহমান বলেন- লকডাউন ও সাপ্তাহিক ছুটির কারণে মানুষের ভিড় বেশি। ই-পাসপোর্টে মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি। সবাই ই-পাসপোর্ট করতে চায়। আমরাও আমাদের সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সার্ভার ডাউন প্রসঙ্গে সাইদুর রহমান বলেন, যান্ত্রিকভাবে এটা হয়েছে। এর জন্য আমরা দুঃখিত। সার্ভারে সমস্যা হলে এটা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা যায় না। সবাই মিলে কাজ করে এটা সমাধান করা হয়। তবে সামনে এমন সমস্যা যাতে না হয় সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ভুক্তভোগীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়- এত সাধের ই-পাসপোর্ট নেয়ার জন্য এত আগ্রহ নিয়ে আসার পরও মিলছে না সময়মতো। বলা হচ্ছে সার্ভার সমস্যা। যার কোন কৈফিয়ৎ নেই কারোর কাছে। যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলা হলে আর কি করার থাকে। এদিকে ই-পাসপোর্ট ছাড়াও মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) নিয়ে জটিলতা রয়েছে। প্রায় এক দশ আগে এ কাজটি পেয়েছিল মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠান আইরিস করপোরেশন। সেখানে তিন কোটি পাসপোর্টের চুক্তি ছিল। তবে সম্প্রতি সেই তিন কোটি আঙুলের ছাপ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর নতুন করে আর পাসপোর্ট ছাপা যাচ্ছিল না। ফলে সার্ভারের ত্রুটির কথা উল্লেখ করে সৌদি, কুয়েত, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, লেবানন, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশের পাসপোর্ট সেবা সাময়িক বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় সেখানকার হাইকমিশন। পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ই-পাসপোর্ট উদ্বোধনের পর ধারণা করা হচ্ছিল এই সময়ের মধ্যে পুরোটাই ই-পাসপোর্টে চলে যাবে। কিন্তু করোনার কারণে বিভিন্ন দেশে ই-পাসপোর্টের মেশিন বসাতে না পারায় এখন বাড়তি সময় এমআরপি দিয়ে কার্যক্রম চালাতে হবে। তাই ধারণ ক্ষমতার বেশি পাসপোর্ট ইস্যুর আবেদন পড়ায় নতুন করে প্রিন্ট করা যাচ্ছিল না।
পাসপোর্ট অধিদফতরের ব্যাখ্যা : এদিকে পাসপোর্ট অধিদফতরের এক ব্যাখায় বলা হয়- পাসপোর্ট সমস্যা নিয়ে কিছু কিছু বৈদেশিক মিশন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের মধ্যে এবং মিডিয়ায় এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়েছে। যা অনাকাক্সিক্ষত বলে দাবি করেছে পাসপোর্ট অধিদফতর। এতে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছুই ছিল না। সফটওয়ার আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমটি পুরোপুরিভাবে কখনও বন্ধ হয়নি-শুধু গতি হ্রাস পেয়েছিল।