কাজিরবাজার ডেস্ক :
আফগানিস্তান দখলের পর দেশটির সাধারণ জনগণকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আহ্বান জানিয়েছিল কট্টরপন্থী তালেবান। তাদের সে আহ্বান কাজে আসেনি। তালেবানের অতীত কর্মকান্ড স্মরণ করে রাজধানী কাবুলসহ দেশটির সাধারণ জনগণ ঘরের বাইরে বের হয়নি। মঙ্গলবারও কাবুল ছিল কার্যত নীরব নগরী। তালেবানের প্রধান নেতৃত্ব সকল সরকারী কর্মকর্তার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে নারীদেরও কাজে ফেরার আহ্বান জানায়। তাদের এসব আহ্বানে নারীরা আস্থা রাখতে পারেননি। মঙ্গলবারও পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তে বহু আফগানী জড়ো হয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। মঙ্গলবার কাবুলের কিছু দোকান খোলা হয়। তবে ক্রেতা ছিল না। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে তালেবানের দ্রুত উত্থান দেশটির সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারছে না। অনেকে জীবনের ভয়ে মুখ খুলছে না। মাজার-ই শরিফ, কাবুলসহ অন্য শহরের মানুষ ব্যথিত ও অবিশ্বাসের দোলাচলে পড়েছেন। মাজার-ই-শরিফের বাসিন্দা নাসিম জাভেদ বলেন, শহরটি তালেবানের দখলে যাওয়ার পর কিছু দোকানপাট খুলেছে। এছাড়া তালেবান যোদ্ধারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে ও কাজে যোগ দিতে উৎসাহ দিচ্ছে। এতে মানুষের সাড়া মিলছে না।
আফগানিস্তান তালেবানের হাতে চলে গেলেও দেশটির বিক্ষুব্ধ ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ বলেছেন, তিনি কখনই তালেবানের কাছে মাথা নত করবেন না। মঙ্গলবার কাবুলের উত্তর-পূর্বের পাঞ্জশির উপত্যকা থেকে তালেবানকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধের ডাক দেন তিনি।
তালেবানের কাবুল দখলের পর সেখানকার পরিস্থিতি আতঙ্কজনক হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তালেবানের আফগানিস্তান দখলের পর সোমবার প্রথম প্রকাশ্যে এসে বাইডেন স্বীকার করেন, তালেবানের এ অগ্রযাত্রা ধারণার চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। হোয়াইট হাউসে তিনি বলেন, যে দেশের নেতারা সব ছেড়ে পালিয়ে যায় সে জাতিকে মার্কিন সৈন্যদের রক্ষা করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, তাদের নিজস্ব ভবিষ্যত তৈরির সকল সুযোগ আমরা দিয়েছি। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করার ইচ্ছে শক্তি আমরা তাদের সরবরাহ করতে পারি না।
বাইডেন বলেন, যেখানে আফগান বাহিনী নিজেদের জন্য যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক নয়, সেখানে আমেরিকান সৈন্যের এই যুদ্ধ করা এবং এই যুদ্ধে প্রাণ দেয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র তার দূতাবাস কর্মী এবং মার্কিন বাহিনীকে সহায়তাকারী আফগানদের সরিয়ে নেয়ার কাজ সম্পন্ন করতে ইতোমধ্যে ছয় হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে।
ফ্রান্স, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়াসহ অন্য দেশের সরকার ভাড়া করা বিমানে করে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে। বাইডেন তালেবানের প্রতি কড়া হঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, তারা যদি মার্কিন সৈন্য কিংবা মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোন বিষয়ে হুমকি তৈরি করে তাহলে সামরিকভাবে এর কঠোর জবাব দেয়া হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আফগানিস্তানে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ হুমকি দমনে একত্রে কাজ করতে বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তালেবানরা কাবুলে ঢুকে পড়ার পর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে জরুরী ভিত্তিতে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
তালেবান সরকারের সঙ্গে কাজ করতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে চীন, পাকিস্তান ও রাশিয়া। তালেবান নেতাদের সঙ্গে মঙ্গলবার টেলিফোনে আলাপ করেছে তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, শর্ত মানলে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে ওয়াশিংটন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস তালেবানকে অভিনন্দন জানিয়েছে। সোমবার তালেবান নেতা মোল্লা আব্দুল গনি বরাদরের সঙ্গে এক ফোন কলে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া এই অভিনন্দন জানান।
আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর রাজধানী কাবুলে নতুন গবর্নর নিয়োগ দিয়েছে তালেবান প্রশাসন। নিয়োগপ্রাপ্ত গবর্নরের নাম মৌলবি আবদুর রহমান মনসুর।
কাতারে অবস্থিত তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। নতুন গবর্নরের পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি শাহিকোট যুদ্ধে মৃত্যুবরণকারী মৌলবি সাইফুর রহমান মনসুরের ভাই। তার পিতা মৌলবি নাসরুল্লাহ মনসুরও আফগান যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর মৌলবি মনসুর বলেছেন, রাজধানী কাবুলের পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। যেসব দুষ্কৃতকারী বিভিন্ন বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট করছে, তাদের ধরতে অভিযান শুরু হয়েছে। এ ছাড়া কাবুলের বাসিন্দাদের জন্য একটি সমন্বিত হটলাইন নম্বর চালুর কথা জানিয়েছে তালেবান প্রশাসন।
আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও একসময়ে দেশটির শান্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে কাবুলে আলোচনা করেছেন তালেবান নেতা আমির খান মুত্তাকি। তালেবানের সর্বশেষ শাসনকালে মুত্তাকি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এ সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট প্যালেস থেকে পালানোর আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ বজায় ছিল মুত্তাকির। আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে জার্মানি। দেশটিতে তালেবানের এই উত্থান তাদের জন্য ‘সবচেয়ে বড় পরাজয়’ উল্লেখ করেছে দেশটি। সোমবার জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মেরকেলের দলের প্রধান এমন কথা বলেন। ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবান দ্রুত ক্ষমতা দখল করায় সিডিইউ পার্টি প্রধান অর্মিন লসচাট বলেন, ‘এখন এটি সুস্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর এই অংশগ্রহণ সফল হয়নি। ন্যাটো বাহিনী প্রতিষ্ঠার পর তাদের জন্য এটা সবচেয়ে বড় বিপর্যয় এবং আমরা পরিবর্তনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি। একই সঙ্গে বর্তমান আফগান পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে রাশিয়া। দেশটির সরকারী দৈনিক রসিইসকায়া গেজেটায় পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক বিশ্লেষক ফিয়োদার লুকিয়ানফ দেশটির ঘটনাবলীকে এক ‘চরম বিশৃঙ্খলা’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, মার্কিন মদদপুষ্ট প্রশাসন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়েছে। আমেরিকানরা ঘরে ফেরেনি, তারা পালিয়েছে।
আফগানিস্তানের অন্যতম প্রধান সংবাদমাধ্যম টোলো নিউজে আবার নারী সংবাদ পাঠকদের উপস্থিতি দেখা গেছে। রবিবার তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকেই আফগানিস্তানে কোন চ্যানেলে নারী উপস্থাপক দেখা যায়নি। তখন অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া এক ছবিতে দেখা যায়, আফগানিস্তানের জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে একজন পুরুষ উপস্থাপক খবর পড়ছেন। তবে মঙ্গলবার টোলো নিউজের বার্তা বিভাগের প্রধান মিরাক পোপাল একটি টুইট করেছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন নারী সংবাদ উপস্থাপক তালেবান মিডিয়া টিমের একজন সদস্যের সাক্ষাতকার নিচ্ছেন।