কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীতে দ্বিতীয় হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। মাত্র ৬০ হাজার হজ্বযাত্রীর পদচারণায় মিনার মাঠে শনিবার শুরু হয়েছে এ বছরের পবিত্র হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা। দীর্ঘ ৯০ বছরের ইতিহাসে পর পর দ্বিতীয়বার সৌদি আরবের বাইরের কোন দেশ থেকে হজে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না কেউ। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। গতবছরও একই কায়দায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত আকারে মাত্র দশ হাজার মুসলিম নিয়ে হজ্ব সম্পন্ন করা হয়েছিল। সৌদি আরবের স্থানীয় সময় শনিবার সন্ধ্যায় মক্কা থেকে মিনায় রওনা হন এবারের হজ্বে অনুমতি পাওয়া মুসল্লিরা। ৫ লাখ ৫৮ হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে মাত্র ৬০ হাজার মুসল্লি এবার হজ্বে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। হজ্বের অনুমতি পাওয়া সবাই কোভিড-১৯ টিকার দু’টি ডোজই নিয়েছেন। বড় ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা নেই-এমন মুসল্লিরা- সুযোগ পেয়েছেন তাদের সবার বয়স ১৮ থেকে ৬৫ বছর পর্যন্ত।
পবিত্র কোরান ও হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম হজ্ব। মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভই হজ্ব পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। হজ্বের প্রতিটি কাজের মধ্যেই আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ, তার মুখাপেক্ষী হওয়া তার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং তার নির্দেশিত পথে বাকি জীবন পরিচালনার স্বীকৃতি ও অনুশীলনই প্রকাশ পায়। হজ্ব মাবরুর বা কবুল হওয়া হজ্বের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। এ জন্য হাজীরা সবসময় আল্লাহর কাছে দোয়া করেন আল্লাহ যেন হজ্ব পালনকে সহজ করে দেন এবং তার হজ্বকে মাবরুর হজ্ব হিসেবে কবুল করেন। পবিত্র মক্কায় হাজীদের বায়তুল্লাহ জিয়ারত, আরাফাতের ময়দানে অবস্থানসহ আনুষঙ্গিক আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে হজ্ব পালিত হয়। বিত্তবান ও শারীরিক সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর জীবনে একবার হজ্ব পালন করা ফরজ এবং প্রতিবছর কোরবানি দেয়া ওয়াজিব।
সৌদি আরবে হিজরি মাস গণনা অনুযায়ী আজ ৮ জিলহজ্ব। মক্কার অদূরে মিনার তাঁবুতে হাজীদের অবস্থানের দিন। আগামীকাল ৯ জিলহজ্ব সোমবার মিনা থেকে গিয়ে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিন অর্থাৎ হজ্বের দিন। মিনা থেকে হাজীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে অবস্থান নেবেন। এটাকে বলা হয় অকুফায়ে আরাফা। ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক ৯ জিলহজ্ব ভোর থেকে সন্ধ্যা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করার নামই হজ্ব। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজ্বের অন্যতম ফরজ। এখানে কেউ অবস্থান না করলে তার হজ্ব আদায় হবে না।
যদিও অন্যান্য বছর অধিক সংখ্যক হজ্বযাত্রীর কারণে ভিড় এড়াতে আগের দিন সন্ধ্যার পর থেকেই হজ্বযাত্রীদের মিনার তাঁবুতে অবস্থান শুরু হয়ে যেত। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে এ বছর মাত্র ৬০ হাজার হজ্বযাত্রীর অংশগ্রহণে হজ্ব পালিত হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশের ২০ লাখ মুসলিম হজ্ব পালন করেছেন। গত বছর থেকে সে চিত্র পাল্টে গেছে। এবার বিভিন্ন স্থানে হাজীদের সেবা দিতে ৪৫টি স্ট্রোক সেন্টার থাকবে। জাবালে রহমত এলাকায় ২৩টি ও মিনা প্রান্তরে থাকবে ২২টি। এছাড়াও ৪২টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র থাকবে। হজ্বের স্থানগুলোতে চিকিৎসাসেবা দিতে কাজ করবে ৩২টি চিকিৎসক দল ও ৩৬টি এ্যাম্বুলেন্স।
এবারও স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনেই হজ্ব সম্পন্ন করতে হবে। মীনার মাঠে প্রতিটি খিমায় বা তাঁবুতে আগে যেখানে ৮/১০ জন অবস্থান করতেন, এবার সেখানে ৩ থেকে বড়জোর ৫ জন অবস্থান করার সুযোগ পাবেন। গতবারও একই কায়দায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই হজ্ব সম্পন্ন করেছেন মুসল্লিরা। প্রতিটি খিমার সামনে রাখা হয়েছে হ্যান্ডস স্প্রে, স্যানিটাইজার, পর্যাপ্ত সাবান ও টিস্যুর সুব্যবস্থা করা হয়েছে। কোন হজ্বযাত্রীর যদি শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তাহলে তাৎক্ষণিক নিকটবর্তী ফাস্ট এইডে অক্সিজেন নেয়ার সুযোগ পাবেন। এছাড়া সার্বক্ষণিক এ্যাম্বুলেন্সেরও সুব্যবস্থা রাখা আছে।
আজকের দিনটিকে মীনা দিবসও বলা হয়। মূলতঃ ৮ জিলহজ্ব ফজরের নামাজের পর থেকেই ইহরাম বেঁধে তালবিয়া পাঠ করতে করতে হাজীদের মিনার তাঁবুতে গিয়ে অবস্থান করার নিয়ম। সে হিসাবে হজ্বের দিনগুলোর সূচনা গতকাল থেকেই শুরু। আজ নির্ধারিত স্থান (মিকাত) থেকে ইহরাম বেঁধে মিনায় অবস্থান করেই হাজীরা হজ্বের সব করণীয় সম্পন্ন করবেন। সেখান থেকেই কাল আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে রওয়ানা হবেন। দিন শেষে আরাফাতের ময়দান থেকে ফেরার পথে মুজদালিফায় রাত যাপন করে ১০ জিলহজ্ব (মঙ্গলবার) সকালে আবার মিনার তাঁবুতে ফিরবেন। সেখান থেকে গিয়েই জামারাহ তথা শয়তানের প্রতিকৃতিতে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করবেন। কোরবানি করবেন এবং তাওয়াফে জিয়ারাহ, সাফা মারওয়া সাঈ করে আবার মিনার তাঁবুতে ফিরে আসবেন। পরের দুই দিনও একইভাবে মিনার তাঁবু থেকে গিয়ে জামারায় পাথর নিক্ষেপ করবেন। ১২ অথবা ১৩ জিলহজ্ব পাথর নিক্ষেপ শেষ করে হাজীরা মিনার তাঁবু ত্যাগ করে হজ্বের কর্তব্যের সমাপ্তি ঘটাবেন। এরপর মক্কা ত্যাগ করার আগে বিদায়ী তওয়াফ করে যে যার অবস্থানে চলে যাবেন। মিনার তাঁবুতে হাজীরা তালবিয়া পাঠ ছাড়াও ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। হজ্বের মাসলা মাসায়েল নিয়ে নিজেরা আলোচনা করেন। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে মোনাজাত করেন।
এদিকে শনিবার ফোন করে জানা যায়, শনিবার সন্ধ্যা থেকেই এক যোগে সব হাজিরা রওনা হন মীনার উদ্দেশে। এ সময় পবিত্র মিনা লাখ লাখ মুসল্লির ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ তালবিয়া পড়তে থাকেন। মূলত ৭ জিলহজ্ব থেকে ১২ জিলহজ্ব মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় অবস্থান করেই হজ্ব সম্পন্ন করতে হয়। হাজিরা মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত কসর নামাজ আদায় করবেন। আগামীকাল ফজরের পর তারা আরাফাতের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। শরীয়ত মোতাবেক হজ্বের অংশ হিসেবে সোমবার সকাল পর্যন্ত তারা অবস্থান করবেন মিনায়। সেখানে হাজিরা সারা জীবনের পুঞ্জীভূত গোনাহ মাফ ও মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় জিকির-আজকার ও ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে সময় কাটাবেন। প্রতিদিন নিজ নিজ খিমায় (তাঁবু) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন জামাতের সঙ্গে। আগামীকাল হজ্বযাত্রীরা নিজ নিজ খিমায় ফজরের নামাজ আদায় শেষে- আরাফাতের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। সাধারণত হজ্ব যাত্রীরা নিজস্ব মোয়াল্লেমের ব্যবস্থাপনায় পাঠানো বাসে মীনার মাঠ থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের আরাফাতের ময়দানে পৌঁছে থাকেন। ফজর থেকে শুরু তাদের যাত্রা শুরু হয়। চলে দুপুর পর্যন্ত। হজ্ব যাত্রীরা খোদার প্রেমে উম্মাদের মতো ছুটেন আরাফাতে। তাদের সঙ্গে থাকে শুধু একটি ব্যাগ- যাতে রাখা হয় একটি কিছু অতীব জরুরী জিনিসপত্র। যেমন থালা বাসন, পানির মগ, ওষুধ ও অজু-গোসলের জন্য গামছা জাতীয় কাপড় চোপড়।