কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্বের প্রায় সব দেশে রেলকে নিরাপদ বাহন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশেও রেলপথে যাতায়াতে যাত্রী চাহিদা ক্রমে ই বাড়ছে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ের কারণে পুরোপুরি নিরাপদ হচ্ছে না রেলপথ। রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা পরিণত হয়েছে নিয়মিত ঘটনায়। কখনো যানবাহন পিষে যাচ্ছে কখনো কাটা পড়ছেন পথচারীরা। এসব দুর্ঘটনা এড়াতে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভিন্ন প্রকল্প নিলেও তার দৃশ্যমান কোনো প্রভাব নেই। অন্যদিকে পথচারীদেরও রয়েছে সচেতনতার ঘাটতি।
সূত্রমতে, এখন দেশের ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত। এসব রেলক্রসিংয়ে ট্রেন চলাচলের সময় যানবাহন আটকানোর জন্য কোনো পাহারাদার বা প্রতিবন্ধক নেই। বাকি ১৮ শতাংশ ক্রসিংয়ে পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক থাকলেও দায়িত্ব অবহেলার কারণে অনেক সময় ঘটছে দুর্ঘটনা।
সবশেষ গতকাল শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুরে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেলস্টেশন এলাকায় পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে নিয়ে যায় চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেস। এতে মাইক্রোবাসে থাকা ১১ যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার কারণে রেলক্রসিংয়ের গেটম্যানকে আটক করে পুলিশ। পরে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে রেলওয়ে পুলিশ।
এসব দুর্ঘটনার জন্য সব সময় দায় শুধু গেটম্যানের নয়, দেশের নাগরিকরাও সচেতন নন। সরেজমিনে রাজধানীর মগবাজার রেলক্রসিংয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, গেটম্যান প্রতিবন্ধক ফেলার পরও পথচারীরা বারবার ঝুঁকি নিয়ে রেলক্রসিং পার হচ্ছেন। ট্রেন একেবারে সন্নিকটে দেখেও কেউ কেউ কয়েক সেকেন্ড ধৈর্য ধরতে পারছেন না। বেশ কিছু যানবাহনকে দেখা গেছে সিগন্যাল পড়ার পরও প্রতিবন্ধক ঠেলে রেড জোনে প্রবেশ করতে।
প্রতি বছর রেলপথে দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, এর ৮৫ শতাংশই রেলক্রসিংয়ে মারা যান বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা। বাকি ১৫ শতাংশ মৃত্যু রেললাইনে কাটা পড়ে। এই মৃত্যুর হিসাব রাখে না রেল কর্তৃপক্ষ। কারণ, রেলপথে প্রাণহানির দায়ে ট্রেনচালক বা সংশ্লিষ্টদের শাস্তির বিধান নেই। উল্টো যানবাহনের চালককে দায়ী করে রেল কর্তৃপক্ষ। তাই ক্রসিংয়ে পাহারাদার থাক বা না থাক নিজ দুর্ঘটনা এড়াতে যানবাহন চালক ও যাত্রীদের সচেতন থাকতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা কমাতে ২০১৫ সালে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল (চট্টগ্রাম) ও রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে (রাজশাহী) আলাদা দুটি প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। এই দুটি প্রকল্পের আওতায় ৭০২টি স্থানে রেলক্রসিং প্রতিবন্ধক, পাহারাদার ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ১৯৬ কোটি টাকা। এছাড়া এসব রেলক্রসিংয়ে এক হাজার ৫৩২ জন পাহারাদার নিয়োগ দিয়েছে সংস্থাটি। তারপরও রেলক্রসিং নিরাপদ হয়নি। ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ২২১ জন। এর মধ্যে ১৮৭ জনই প্রাণ হারিয়েছেন রেলক্রসিংয়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এখন রেলপথে দুই হাজার ৫৬১টি রেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৩২১টির অনুমোদন নেই। সব মিলিয়ে দেশের ৮২ শতাংশ রেলক্রসিংই অরক্ষিত। যেগুলোতে যানবাহন আটকাতে প্রতিবন্ধকতা, পাহারাদার নেই। ফলে কিছুদিন পরপরই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিধান না থাকায় এসব ঘটনার বিচারও হচ্ছে না।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, রেলপথ বা রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সবই জানেন রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কিন্তু তারা বড় বড় প্রকল্প, রেলওয়ের কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত। তারা আন্তরিক হলে এই দুর্ঘটনা ঘটতো না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব ও রেলওয়ের অংশীজন মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, রেলপথকে আরও নিরাপদ করতে প্রতিটি অংশীজন সভায় রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলা হচ্ছে। কিন্তু রেলওয়ের টনক নড়ছে না। গতকাল মিরসরাইয়ের ঘটনায় রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা ও পাহারাদারই দায়ী। যদিও দুই-চারদিন পর এই দুর্ঘটনার খবর সবাই ভুলে যাবে।
তিনি বলেন, মিরসরাইয়ের যে স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে প্রতিবন্ধক ও পাহারাদারও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তারপরও সেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যে এক হাজার ৩২১টি ক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক ও পাহারাদার নেই, সেখানে কী ঘটছে তার হিসাব কেউ রাখে না। এসব দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে গুরুত্বপূর্ণ রেললাইন ক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে উড়ালপথ নির্মাণ করতে হবে। অরক্ষিত ক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক বসানো এবং পর্যাপ্ত পাহারাদার নিয়োগ দেওয়া সময়ের দাবি।
অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক স্থাপনের বিষয়ে জানতে শনিবার (৩০ জুলাই) দুপুরে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. কামরুল আহসান, রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার ও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তারা রিসিভ করেননি। পরে এ বিষয়ে অবগত নন বলে জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার শরিফুল আলম।