কাঠগড়ায় ই-কমার্স ॥ কিছু অসাধু চক্রের প্রতারণা, ই-ভ্যালির সদস্যপদ বাতিল করতে যাচ্ছে ই-ক্যাব

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
গত বছরের শুরুতে করোনা মহামারীতে ঘরবন্দী থাকা নগরবাসীর কাছে অনেকটাই আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল দেশের ই-কমার্স। খুব অল্প সময়ে ভোগপণ্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পণ্যই ই-কমার্সের বদৌলতে ঘরে বসেই পেয়েছেন ক্রেতারা। কিন্তু সুসময় দেখানো ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যবসা এখন নানা সমালোচনার মুখে। অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে ব্যবসার পদ্ধতি, ধরন এক সময়ের আলোচিত এমএলএম কেলেঙ্কারির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। বড় অঙ্কের ক্যাশব্যাক, অফারের নামে ক্রেতাকে সময়মতো পণ্য না দেয়া ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অর্থ না দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালিসহ অন্তত ১০ প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের রিফান্ডের চেক দিলেও ব্যাংক হিসাবে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় চেক বাউন্স হচ্ছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একে একে সম্পর্ক ছিন্ন করছে পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (মার্চেন্ট)। ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ডে লেনদেন স্থগিত করেছে এক ডজন ব্যাংক। সম্প্রতি ১১ কোম্পানির ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন অভিযোগে ইভ্যালির সদস্যপদ স্থগিত করতে যাচ্ছে ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন (ই-ক্যাব)। গত বৃহস্পতিবার ধামাকা শপিংয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তদন্ত করছে সংস্থাটি। গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)।
বাংলাদেশে অন-লাইনে কেনাবেচার শুরু মূলত ২০১১ সাল থেকে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ (এনএসপিবি) চালু করলে ব্যাংকের মাধ্যমে অনলাইনে মূল্য পরিশোধের পদ্ধতিটি চালু হয়। এরপর ২০১৩ সালে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই বছর দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দ্রুতগতির তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (থ্রিজি) চালু করে। এরপর চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (ফোরজি) চালু হয় দেশে। এই সময়ে মানুষের স্মার্টফোন ব্যবহারের যেমন প্রবণতা বেড়েছে, ঠিক তেমনই ই-কমার্স খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ এসেছে। সব মিলিয়ে খাতটি বড় হয়েছে। ক্রেতাও বেড়েছে। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) হিসাবে তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১১০০। বছরে বিক্রির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। অবশ্য এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছোট ছোট পণ্য বিক্রেতা রয়েছেন। আবার দোকান মালিকরা অনেকেই অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন। তাদের অনেকেই আবার সুপরিচিত অনলাইন মার্কেট প্লেস বা কেনাবেচার মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত।
জানা যায়, দেশে করোনার বিস্তার ঠেকাতে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হয়। ওই সময় প্রচলিত পণ্যের বিপরীতে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয় মুদি ও নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের। ফরমায়েশের চার-পাঁচ গুণ বৃদ্ধি সামাল দিতে ব্যাপক সঙ্কটে পড়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। পরে অবশ্য বেশির ভাগের ব্যবসা আবার বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করে ব্যবসা চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। ই-কমার্সের প্রতি মানুষের এ নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে কিছু অসৎ চক্র গ্রাহকদের সঙ্গে করছে প্রতারণা। অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন আর লোভনীয় অফার দেখে অনেক মানুষ পণ্য কিনে নানাভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে পণ্য বিক্রিতে গত এক বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্বিগুণ, তিনগুণ অফার কিংবা ক্যাশব্যাক দিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্রেতাই সময়মতো পণ্য পাননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইভ্যালির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, ৬০ হাজারের মতো অর্ডার ঝুলে আছে ইভ্যালিতে। এর মধ্যে তিন হাজার মানুষের অর্ডার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এক বছরের বেশি সময়, যেগুলো দেড় মাসে ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিল। এদের বেশির ভাগের অর্ডার প্রথম ছয় মাস ঝুলিয়ে রাখা হয় সেলারের কাছে প্রোডাক্ট নাই বলে। বাকি ছয় মাস পার করেছে রিফান্ডের কথা বলে।
তিনি আরও বলেন, ‘ইভ্যালিসহ বেশকিছু কোম্পানি যেভাবে নতুন গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুরনো গ্রাহকদের পণ্য বা রিফান্ড দিচ্ছে তা কোনমতেই ই-কমার্স বিজনেস নয়।’ তিনি বলেন, ‘ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৫ কোটি টাকা নিয়ে পণ্য দেয়নি, আবার মার্চেন্টদের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য এনেছে ১৯০ কোটি টাকার। গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নেয়ার পরও মার্চেন্টদের কাছে বকেয়া থাকার কথা নয়। এখন তারা গ্রাহক বা মার্চেন্ট কারও পাওনাই পরিশোধে করতে পারছে না। তাহলে এসব অর্থ গেল কোথায়?’
গত মার্চে তৈরি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই বছরের বেশি সময়ে গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে। যেখানে কোম্পানিটির চলতি সম্পদ মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। মাত্র ৬৫ কোটি টাকার চলতি সম্পদ দিয়ে কোন অবস্থাতেই কোম্পানিটির এই দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা নেই। আরও বলা হয়, চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালি। অন্যদিকে ইভ্যালি যেসব কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কিনে- ওইসব ব্যবসায়ীর কাছে কোম্পানিটির বকেয়া ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইভ্যালির সব চলতি সম্পদ দিয়ে গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের বকেয়া অর্থের মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব হবে এবং আরও ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সমপরিমাণ দায় অপরিশোধিত থেকে যাবে। ইভ্যালির চলতি সম্পদের স্থিতি দিয়ে শুধু গ্রাহক দায়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিশোধ করা সম্ভব হবে। ইভ্যালির চলতি দায় ও লোকসান দুটিই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং কোম্পানিটি চলতি দায় ও লোকসানের দুষ্ট চক্রে বাধা পড়েছে। ক্রমাগতভাবে সৃষ্ট দায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব টিকে না থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরুর বছর থেকেই ইভ্যালি লোকসানে রয়েছে এবং দিন দিন এর লোকসান বাড়ছে। প্রথম বছর কোম্পানিটির নিট লোকসান ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। গত ১৪ মার্চ কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এ বিষয়ে কথা বলতে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলের সেল ফোনে বারবার কল দেয়ার পরও রিসিভ করেননি তিনি। পরবর্তীতে তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর পরও তার কোন জবাব পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়াসহ বেসরকারী খাতের বিভিন্ন ব্যাংক ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ধামাকা শপ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, কিউকম ও ইঅরেঞ্জ এর সঙ্গে ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ডে লেনদেন স্থগিত করেছে। এর আগে গত ৪ জুলাই, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে অগ্রিম নেয়া ৩৩৮ কোটি টাকা আত্মসাত কিংবা অবৈধভাবে সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা করে আলোচিত-সমালোচিত ই-কমার্স কোম্পানি ইভ্যালি ডটকমের বিরুদ্ধে মামলা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ইভ্যালির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাওয়া আর্থিক অনিয়মগুলো তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) পৃথক চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়। এছাড়া গ্রাহকদের কাছ থেকে ২১৪ কোটি টাকা অগ্রিম গ্রহণ করে পণ্য ডেলিভারি না দেয়া ও মার্চেন্টদের ১৯০ কোটি টাকা পাওনা ফেরত দেয়ার বিষয়ে তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে নির্দেশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ইভ্যালির সদস্যপদ স্থগিত করতে যাচ্ছে ই-ক্যাব ॥ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে ইভ্যালি ডট কমের সদস্যপদ স্থগিত করার উদ্যোগ নিয়েছে ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্সপেকশন রিপোর্টসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, বিভিন্ন ক্রেতা ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার প্রেক্ষিতে ‘সদস্যপদ কেন স্থগিত করা হবে না’ তার জবাব চেয়ে গত বুধবার ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ই-ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বুধবার রেজিস্ট্রি ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়েছি। চিঠি পাওয়ার সাত কর্মদিবসের মধ্যে ইভ্যালিকে জবাব দিতে বলা হয়েছে। মূলত ইভ্যালির সদস্যপদ স্থগিত করার জন্য ই-ক্যাবের গঠনতন্ত্রের ৯(ডি) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শোকজ লেটার পাঠানো হয়েছে।’ চিঠিতে ই-কমার্স ব্যবসার নামে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাত, মার্চেন্টদের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন অভিযোগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখিত বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে ইভ্যালির বিরুদ্ধে সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়েছে। ইভ্যালি ছাড়াও গ্লিটার্স আরএসডি ওয়ার্ল্ড, গ্রীন বাংলা ই-কমার্স লিমিটেড, এ্যানেক্স ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লিমিটেড, আমার বাজার লিমিটেড, এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড এ্যাগ্রো ফুড এ্যান্ড কনজ্যুমারস লিমিটেডকে শোকজ লেটার পাঠিয়েছে ই-ক্যাব। আরও বেশকিছু কোম্পানিকে শোকজ লেটার পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
সংগঠনটির গঠনতন্ত্রে সদস্যপদ স্থগিত বা বাতিল করার আগে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিধান থাকায় এ চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানান ই-ক্যাব কর্মকর্তারা। শাহাব উদ্দিন জানান, ব্র্যাক ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক যে ১০টি কোম্পানির সঙ্গে তাদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন স্থগিত করেছে, ওই ১০ কোম্পানির মধ্যে যারা ই-ক্যাবের সদস্য রয়েছে, তাদের সবাইকে শোকজ লেটার পাঠানো হচ্ছে। মূলত ই-কমার্স সেক্টরের সম্ভাবনা কাজে লাগানো ও গ্রাহক আস্থা বাড়াতেই এমএলএম পদ্ধতিতে পরিচালিত কোম্পানিগুলোর সদস্যপদ স্থগিত করা হবে।
ধামাকা শপিংয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে সিআইডির চিঠি : আলোচিত ই-কমার্স কোম্পানি ধামাকা শপিংয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বাংলাদেশকে ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘ধামাকার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছি আমরা। বিভিন্ন ই-কমার্স কোম্পানি নিয়ে চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধামাকা শপিং চলতি বছরের মে মাসে সিংগার ব্র্যান্ডের একটি রেফ্রিজারেটরের ওপর প্রায় ৪১ হাজার টাকার মূল্যছাড় প্রদান করে। পণ্যটির প্রকৃত মূল্য ছিল ৮৬ হাজার টাকা। ছাড় পেতে হলে, ক্রেতাদের অফারকৃত সম্পূর্ণ মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করার শর্ত প্রদান করা হয়। কিন্তু জুলাই মাসেও অর্ডার দেয়া একটি পণ্যও পাননি কোন গ্রাহক।
এছাড়া পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধামাকার কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা পেলেও দিতে পারছে না কোম্পানিটি। চেক দিলেও তা বাউন্স হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আলোচিত ই-কমার্স প্লাটফর্ম ইভ্যালির মতোই বিপুল ডিসকাউন্টে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নিয়ে সময়মতো পণ্য বা রিফান্ড পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে গত বছর ব্যবসা শুরু করা ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে। এর আগে গত ৩০ জুন ধামাকা শপিংসহ আলেশা মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, কিউকম, দালাল প্লাস, ইঅরেঞ্জ এবং বাজাজ কালেকশনের ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংক : চলতি বছরের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট। প্রচারের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি তাদের পণ্যে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় ঘোষণা করে। ৩৫ দিনের মধ্যে পণ্য পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রীম অর্থ আদায় করা হয়। যাত্রা শুরুর প্রথম মাসেই অনলাইন বাজারটি ক্রেতাদের কাছ থেকে ২৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা সমমূল্যের ক্রয়াদেশ বা অর্ডার পায়। সময়ের সঙ্গে ই-কমার্স এই সাইট বিভিন্ন পণ্যে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় ঘোষণা করে। ফলে এপ্রিলে মাসিক বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৪ কোটি টাকা। প্রথম চার মাসে আলেশা মার্টের মোট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা। গত ৩০ জুন পর্যন্ত আলেশা মার্টকে ৪৬ হাজার বাইকের জন্য ৬৫৮ কোটি টাকা দিয়েছেন গ্রাহকরা, যেগুলো সরবরাহ শুরুর তারিখ ছিল গত ৬ জুলাই। গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার বাইক সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এভাবেই লোভনীয় ছাড়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎগতিতে অনলাইন বাজারগুলোর বিক্রির হার বৃদ্ধি পায়। একই ব্যবসা পদ্ধতি অনুসরণ করে আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চার মাসে গ্রাহকদের কাছ থেকে ৪০০ কোটি টাকার বেশি অর্ডার গ্রহণ করে। এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠানটির মাসিক বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫০ কোটি টাকা। পণ্যে অতিরিক্ত ছাড় প্রদানের জন্য জনপ্রিয় আরেক অনলাইন বাজার ধামাকা শপিং জানুয়ারি থেকে চার মাসের মধ্যে সর্বমোট ৩৫০ কোটি টাকার অধিক মূল্যের অর্ডার পায়। নতুন এই ব্যবসা পদ্ধতিতে অনলাইন বাজারগুলো ক্রেতাদের কাছ থেকে দুই-এক মাসের অগ্রীম টাকা সংগ্রহ করে। কিছু ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য সরবরাহ করতে আরও বেশি সময় নিয়ে থাকে। এছাড়া প্রায়ই তারা ক্রেতাদের জানিয়ে দেয় যে, তাদের অর্ডারকৃত পণ্যগুলো শেষ হয়ে গেছে আর তাই সেটা পাঠানো সম্ভব নয়। তবে মাসের পর মাস ধরে অপেক্ষার পরেও প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে ক্রেতারা তাদের টাকা ফেরত পান না বলে অসংখ্য অভিযোগ ওঠে। অনলাইন ক্রেতাদের লোভনীয় সব ছাড়ের ফাঁদে ফেলে দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অনলাইন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যে ব্যবসা পদ্ধতি অনুসরণ করে : সাধারণত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ সূচনালগ্ন থেকেই মুনাফা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যবসার একটি নতুন ধারা উদ্ভূত হয়েছে যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো নেতিবাচক ব্যালেন্স শিট দিয়ে যাত্রা শুরু করে। নতুন এই ব্যবসার মূল লক্ষ্য হলো ডিজিটাল গ্রাহকদের সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে নগদ প্রবাহ বাড়িয়ে তোলা, যার মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে ব্যবসার প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এই ধারায়, ই-কমার্স বা অন্যান্য প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের ওপর বিপুল মূল্যছাড়ের লোভনীয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাজারে প্রবেশ করে। চলমান কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অনলাইন কেনাকাটার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লোভনীয় ছাড়ের সব অফার নিয়ে ই-কমার্স খাতে প্রবেশের দিকে ঝুঁকছে। অনলাইন ক্রেতাদের আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। কোন নতুন ডিজিটাল বাজারে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে তারাও ছাড়ের সন্ধান করে থাকেন। প্রশ্ন হলো- এ ধরনের ব্যবসায়িক মডেল বা পদ্ধতি টেকসই বা স্থিতিশীল কিনা। পাশাপাশি, ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবসাগুলো এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের আওতায় না আনায় ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। বিপুলসংখ্যক অনলাইন বাজার ই-কমার্স খাতে প্রবেশ করার পর চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে মোট লেনদেনের পরিমাণ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৯১১ কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছায়।