স্পোর্টস ডেস্ক :
যেন কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। এককথায় অনন্য, অসাধারণ, অপ্রতিরোধ্য, দুর্বার, সৌন্দর্যের পূজারি। একটা সময় অতি রক্ষণাত্মক ফুটবলের জন্য যে দলটা সমালোচনায় পিষ্ঠ ছিল সেই তারাই নিজেদের কি দুর্দান্তভাবে আমূলে পাল্টে ফেলেছে। আক্রমণাত্মক খেলার পসরা সাজিয়ে নান্দনিক ফুটবলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালি। যার নমুনা গত প্রায় তিন বছর ধারাবাহিকভাবে রেখে চলেছে দলটি। সর্বশেষ নিদর্শন দেখা গেল সদ্য শেষ হওয়া ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে। সব প্রতিপক্ষকে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়ে অনেকটা বলে কয়ে ১৬তম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কোচ রবার্টো ম্যানচিনির দল। রবিবার রাতে লন্ডনের বিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ফাইনাল মহারণে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে ভাগ্য নির্ধারণী টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে হারিয়েছে ইতালি। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা ১-১ গোলে ড্র থাকার পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে কোন দলই জাল খুঁজে পায়নি। এরপর ভাগ্য নির্ধারণ হয় টাইব্রেকারে। সেখানে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হওয়া গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি দোন্নারুমার নৈপুণ্যে শিরোপা জয় করে ইতালি।
টাইব্রেকারে প্রথম দুই শটে এগিয়ে ছিল ইংল্যান্ড। এ সময় ইংলিশরা দুই শটেই গোল পেলেও ইতালি মিস করে দ্বিতীয় শট। কিন্তু এগিয়ে থাকার সুবিধা কাজে লাগাতে পারেনি স্বাগতিক ফুটবলাররা। অবিশ্বাস্যভাবে ইংল্যান্ডের হয়ে পরের তিনটি শটেই যথাক্রমে গোল করতে ব্যর্থ হন তিন বদলি ফুটবলার মার্কাস রাশফোর্ড, জ্যাডন সানচো ও বুকায়ো সাকা। যে লক্ষ্য নিয়ে ইংলিশ কোচ তাদের মাঠে নামিয়েছিলেন সেটা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। রাশফোর্ডের দুর্ভাগ্য, তার শটে ইতালিয়ান গোলরক্ষক পুরোপুরি পরাস্ত হলেও বল সাইডপোস্টে লেগে প্রতিহত হয়। গোলটি হলে হয়তো ম্যাচের ভাগ্য অন্যরকম হতে পারত। দুই তরুণ সানচো ও সাকাকে শট নেয়ার সময় বেশ চিন্তিত দেখা গেছে। এত বড় ফাইনালে অভিজ্ঞদের রেখে তাদের দিয়ে পেনাল্টি শট মারানোয় ইংল্যান্ড কোচকে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে।
তবে শিষ্যদের পাশেই আছেন ইংলিশ বস। খেলোয়াড়ের বরং প্রশংসা করে সাউথগেট বলেন, ‘এটা ঠিক আমরা অনেক অনেক হতাশ। কিন্তু খেলোয়াড়রা অসাধারণ কাজ করেছে। ওদের যা কিছু দেয়ার ছিল সবটুকু দিয়ে খেলেছে। মাঝে মধ্যে খুবই ভাল খেলেছে, মাঝে মধ্যে হয়তো বলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে সেভাবে রাখতে পারিনি। কিন্তু এটা নিয়ে কোন অভিযোগ করা ঠিক হবে না। ওদের সঙ্গে কাজ করতে পারা অনেক আনন্দের ছিল। আমরা নিজেদের ইতিহাসে এর আগে যতটুকু করতে পেরেছিলাম তারচেয়েও বেশিদূর এগিয়েছে ওরা। পেনাল্টিতে যা হয়েছে সেটা নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও দোষারোপ করার কিছু নেই’।
ব্যর্থ ইংলিশদের সুযোগ করে দিয়েছিল ইতালিও। দলটির তৃতীয় ও চতুর্থ শটে যথাক্রমে ফাইনাল সেরা লিওনার্দো বোনুচ্চি ও ফেডেরিকো বার্নারডেস্কি গোল করলেও জর্জিনহোর নেয়া শেষ শটটি ফিরিয়ে দেন ইংলিশ গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড। তখন স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৩-২। এর ফলে নিজেদের শেষ শটে ইংল্যান্ড গোল করতে পারলে খেলা গড়াতো সাডেন ডেথে। কিন্তু বুকায়ো সাকার শেষ শট টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হওয়া দোন্নারুমা অসাধারণ দক্ষতায় ফিরিয়ে দিলে ৫৩ বছর পর শিরোপার উল্লাসে ভাসে ইতালি। এর আগে ম্যাচের নির্ধারিত সময়ের দ্বিতীয় মিনিটেই অসাধারণ গোল করে ইংল্যান্ডকে এগিয়ে নিয়েছিলেন লেফটব্যাক লুক শ। ইউরোর ইতিহাসে ফাইনালে এটাই সবচেয়ে দ্রুততম সময় গোল করার রেকর্ড। বিরতির পর ৬৭ মিনিটে ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় হওয়া লিওনার্দো বোনুচ্চির গোলে সমতা ফেরায় ইতালি। ইউরোর ফাইনালে সবচেয়ে বেশি বয়সে গোল করার রেকর্ড গড়েছেন তারকা এই সেন্টারব্যাক। ফাইনালের দিন বোনুচ্চির বয়স ছিল ৩৪ বছর ৭১ দিন।
এ নিয়ে নিজেদের দশম বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলে ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হলো ইতালি। এর আগে দলটি চার বিশ্বকাপ (১৯৩৪, ১৯৩৮, ১৯৮২, ২০০৬) ও একবার ইউরোতে (১৯৬৮) চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবার ৫৩ বছর পর নিজেদের দ্বিতীয় ইউরো ট্রফি জিতেছে আজ্জুরিরা। দশ ফাইনালের মধ্যে তারা চারটিতে হেরেছে। এর মধ্যে দু’টি বিশ্বকাপ ও দু’টি ইউরোতে। বাছাইপর্বসহ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে এ নিয়ে টানা ১৭ ম্যাচ জয়ের রেকর্ড গড়েছে ইতালি। আর সবমিলিয়ে অপরাজিত আছে রেকর্ড ৩৪ ম্যাচ। এখন অপরাজিত থাকার বিশ্বরেকর্ড গড়ার অপেক্ষা তাদের।
অন্যদিকে ইংল্যান্ড নিজেদের ইতিহাসে এই প্রথম ইউরোর ফাইনালে উঠে আসে। সবমিলিয়ে মাত্র দ্বিতীয় বৈশ্বিক ফাইনাল। দলটি সেই ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলে একমাত্র আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতেছিল। যে কারণে এবার ৫৫ বছর পর ট্রফি জয়ের স্বপ্ন বুনেছিল ফুটবলের জনকরা। কিন্তু তাদের অপেক্ষা আরও বাড়িয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছে অপ্রতিরোধ্য ইতালি। টাইব্রেকারে ইংলিশদের দুর্ভাগ্য নতুন কিছু নয়। ১৯৯০, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০১২ সালে বড় আসরে এই টাইব্রেকারই কাল হয়েছে ইংলিশদের। শুধু ২০১৮ বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে টাইব্রেকারে কলম্বিয়াকে হারাতে পেরেছিল থ্রি লায়ন্সরা। পরশু রাতে টাইব্রেকারে সেই ব্যর্থতার ধারা আবারও ফিরিয়ে এনেছে সাউথগেটের দল।
ইংল্যান্ডের হৃদয় ভেঙেছে এমন এক দলের কাছে যে দলটিকে ২০১৮ সালের পর বিশ্বের কোন ফুটবলশক্তিই হারাতে পারেনি। অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা দেখিয়ে চলা ইতালি গত তিন বছর টানা ৩৪ ম্যাচে অপরাজিত আছে। দলটির এবারের মিশন ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ। সর্বশেষ ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে এই দলটি বাছাইপর্ব উতরাতে না পারায় খেলতে পারেনি। সেখান থেকে ইতালিকে খাঁটি সোনায় পরিণত করেছেন তারকা কোচ রবার্টো ম্যানচিনি। তার জাদুর পরশে এখন সবাইকে ছাড়িয়ে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে ইতালি।
স্বর্ণালি সাফল্যের কৃতিত্ব পুরোটাই শিষ্যদের দিয়ে ম্যানচিনি বলেন, ‘আমরা একে অপরের সঙ্গে দারুণ মানিয়ে নিয়েছি। কখনই কোন সমস্যা হয়নি। এ কৃতিত্ব ফুটবলারদেরই প্রাপ্য। শুধু মাঠেই নয়, সেখানে তো তারা অসাধারণ করেছেই। মাঠের বাইরেও আমরা দারুণ টিম স্পিরিট গড়তে পেরেছি। ওরা এমন একটি বন্ধন গড়ে তুলেছে যা আগামীতেও অটুট থাকবে। এই সাফল্যের প্রতিশব্দ হয়ে থাকবে ওরা। কারণ পরস্পরের প্রতি ওদের শ্রদ্ধা ও সম্মান গভীর’। ইতালির জয়ের নায়ক ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় লিওনার্দো বোনুচ্চি ম্যাচ শেষে বলেন, ‘ইংল্যান্ড ফাইনালে আসার পর থেকেই সবসময় প্রতিদিন শুনছিলাম, ‘কাপ আসছে হোমে লন্ডনে।’ তাদের জন্য দুঃখিত। কারণ কাপ আসলে যাচ্ছে রোমে। বিশ্বজুড়ে ইতালিয়ানরা এখন এই সাফল্য উপভোগ করতে পারে।’
ইতালির সাফল্যের দুই নায়ক অভিজ্ঞ দুই ডিফেন্ডার অধিনায়ক জিওর্জিও চিয়েল্লিনি ও বোনুচ্চি। এ দু’জন রক্ষণভাগে প্রতিপক্ষের জন্য রীতিমতো দেয়াল হয়ে ছিলেন। ২০১২ ইউরোর ফাইনালে স্পেনের কাছে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া দলেও ছিলেন বোনুচ্চি। ২০১৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সেই ব্যর্থতারও সাক্ষী তিনি। ওই ম্যাচে সুইডেন বাধা পেরোতে না পারায় ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তার দেশ ইতালির। এতটা বেদনার পরও বিশ্বাস হারাননি বোনুচ্চি, ‘বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পেরোতে না পারার হতাশা ছিল আমাদের। তবে বিশ্বাস সবসময় রেখে যেতে হয়। হাল না ছেড়ে সেরা হওয়ার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। এটা অবশ্যই ইতালিয়ান ফুটবলের পুনর্জাগরণ। আমি নিশ্চিত এই দল ও কোচ সামনে অনেক খবরের শিরোনাম হবে। আমরা স্পেশাল। কারণ যেদিন আমরা একসঙ্গে হয়েছি সেদিন থেকেই বিশ্বাস রেখেছি যে আমরা পারব।’
৩৬ বছর বয়সী গর্বিত ইতালিয়ান অধিনায়ক চিয়েল্লিনি এই সাফল্যকে টিম স্পিরিটের ফসল বলেছেন, ‘এ সাফল্য আমাদের প্রাপ্য। এই বয়সে আমরা আরও বেশি করে বুঝতে পারি যে এরকম একটি ট্রফি জয়ের অর্থ কি। এবার অন্যরকম একটা আবহ ছিল। এটা অবিশ্বাস্য যে দিনের পর দিন একসঙ্গে কাটিয়েও আমরা পরস্পরের সংস্পর্শে ক্লান্ত হইনি। টিম স্পিরিটের কারণেই এসেছে আমাদের এ সাফল্য।’