হীরেন পন্ডিত :
সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইনের অপব্যবহার এই সময়ে ক্রমেই বিপজ্জনক আকার নিচ্ছে বলে উদ্বেগ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপব্যবহার দিন দিন মাত্রা ছাড়া রূপ ধারণ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই কারণে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার ও অপপ্রচার আটকাতে বা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এই দাবি উঠেছে বহুদিন আগে থেকেই। অনেক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম অনলাইনে ভাইরাল হিসেবে প্রচারিত কোনো বার্তা বা বক্তব্যের অরিজিনেটর কে তা ঠিক করে জানাতে পারে না। এ বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইনে অপব্যবহার ও অপপ্রচার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এই সময়ে ডিজিটাল বিশ্বের জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগ মানুষ অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। এসব ব্যবহারকারী গড়ে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে সময় কাটাচ্ছে এসব প্ল্যাটফর্মে। এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন গুজবনির্ভর অপপ্রচারের এক আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সংঘবদ্ধভাবে মাঠে রয়েছে অপরাধীরা এসব কুৎসিত অপপ্রচারের যেন কোনো শেষ নেই। একের পর এক কল্পকাহিনি জন্ম দিয়ে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় সর্বত্র।
অপপ্রচারকারীরা নামে-বেনামে ইউটিউব চ্যানেল, আইপি টিভি, অনলাইন পোর্টালসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানা রকম পেজ, গ্রুপ, ইভেন্ট খুলে যে যার ইচ্ছামতো মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা অপপ্রচারে লেগে আছে। তথাকথিত ব্রেকিং নিউজের নামে সকাল-বিকাল নানা গুজবের ভিডিও বানানো হচ্ছে। হঠাৎ আবিষ্কৃত এসব গায়েবি খবর তৈরি করে নিমেষেই ছড়িয়ে দেওয়া হয় প্রতিনিধিদের কাছে। এসব কুৎসিত অপপ্রচার অনুমোদনহীন অনলাইন চ্যানেল, পেজ ও গ্রুপে ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রকাশ করা হয়।
নামে-বেনামে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আইডি খুলে নানা কল্পকাহিনি প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। এসব মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করতেই ব্যস্ত। এই অপপ্রচারের আওতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবার, বিশিষ্ট নেতারা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক মানুষ, সশস্ত্র বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বাদ পড়ছে না কেউ।
সাইবারজগতের বিস্তার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। দিন যত যাচ্ছে কোটি কোটি মানুষ এর সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে মোবাইল প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ইন্টারনেট সুবিধা সহজীকরণ করা হয়েছে। এর বহু ভালো দিক রয়েছে। সেই সঙ্গে কিছু খারাপ দিকও আছে। তাই যখন কোনো ভালোর সঙ্গে খারাপটা আসছে তা যেন বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার এবং এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে না। টিকটকের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম বিপথে যাচ্ছে কি না তা ভাবার সময় এসেছে। আমরা ডিজিটাল নির্ভর শীল হয়ে যাচ্ছি, এ ক্ষেত্রে সাইবার অপরাধ মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ডিজিটাল হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সুতরাং এই সাইবার স্পেসের হুমকি আগামী দিনে আরো ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ফেসবুক-ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। কারণ এগুলো বন্ধ করে দিয়ে দূরে থাকা যাবে, তা নয়। এ জন্য শুধু আজকে নয়, আগামী দিনগুলোতে সাইবারজগতের কী ধরনের বিস্তার ঘটবে, আমরা কোন কোন জায়গায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। সেই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে।
উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরই মধ্যে সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে ইউটিউব-ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এসব সার্ভিস প্রোভাইডারকে আমাদের দেশের রেজিস্ট্রার্ড কম্পানির আওতায় আনতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। তারা রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এলে গুজব ও সামাজিক অস্থিরতা বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ তখন তারা আমাদের দেশের আইন-কানুন, নীতিমালা এবং আদালতের নিদের্শনা মানতে বাধ্য হবে। এই সার্ভিস প্রোভাইডারগুলো সরকারের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশে এখন ফেসবুক-ইউটিউবের বড় বাজার সৃষ্টি হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে গুজব রটানো ও অপপ্রচার চলছে। ভুয়া আইডি এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিদেশ থেকে পরিচালিত হওয়ার কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় সংঘটিত অপরাধ দমনে আমাদের স্থানীয় আইন সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। এই মাধ্যম ব্যবহার করছে, বাড়ছে প্রতারণাও। ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়।
সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা তথ্য-প্রযুক্তি যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি এখন সবার হাতে, মোবাইল, ইন্টারনেট সব কিছুই। তথ্য-প্রযুক্তি সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার ক্রাইম কিংবা প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধও বাড়ছে। আবার নানা ষড়যন্ত্র চলছে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। রটানো হয় নানা ধরনের গুজব। সামাজিক অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধই সংঘটিত হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও মিথ্যাচার অথবা অপরাধ শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটা বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের অনেক দেশকেও এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ফেসবুক, ইউটিউবের যেসব কনটেন্ট সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে, দ্রুত সেগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব অপপ্রচার সরল ও নিরীহ জনগণকে প্রভাবিত করছে। সরল মানুষ না বুঝে তাদের বিশ্বাস করছে। এ ক্ষেত্রে ফেসবুক, ইউটিউব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। দেশের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে। কিছু ইউটিউব, যারা সরকারের ভালো দিক প্রচার করছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কথা বলছে, তাদের উৎসাহিত করতে হবে, যাতে যারা অপপ্রচার চলাচ্ছে তাদের শক্তি দুর্বল করে দিতে পারে। গুজবকারীদের শনাক্তে নিয়মিত সাইবার প্যাট্রলিং করা হচ্ছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া গুজব রটনাকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কাজ করছে।
ফেসবুক, ইউটিউব বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা সামাজিক অস্থিরতার ভিডিও শেয়ার বা বার্তা ছড়াচ্ছে তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি গুজব সৃষ্টিকারী এসব ভিডিও বা বার্তার নেপথ্যে যারা রয়েছে তাদেরও খুঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ছে। সাইবারজগতে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে নিয়মিতভাবেই দেশি-বিদেশি অনেক চক্র মোটা অঙ্কের অর্থ লুটে নিচ্ছে। বিগো লাইভ, টিকটকসহ এ ধরনের অ্যাপস সামনে রাখছে অপরাধীরা। কিন্তু এর নেপথ্যে বড় ধরনের ফিন্যানশিয়াল ক্রাইম জড়িত। সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইনের এসব অপব্যবহার ও অপপ্রচার এখনই বন্ধ করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।