কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঐতিহাসিক ৬ দফার ভেতরেই স্বাধীনতার এক দফা নিহিত ছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, এই ৬ দফার ভেতরেই এক দফা নিহিত ছিল, সেটা আমরা পরিবারের সদস্যরা জানতাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন ৬ দফা মানেই এক দফা, অর্থাৎ স্বাধীনতা। এই ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ এবং এই ছয় দফার ভিত্তিতেই সত্তরের নির্বাচন এবং আমাদের যুদ্ধে বিজয় এবং আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। আজকে আমরা সেই স্বাধীন জাতি। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। রক্ত কখনো বৃথা যায় না- এটা প্রমাণিত সত্য।
সোমবার সন্ধ্যায় ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস উপলক্ষে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত বিশেষ অনুষ্ঠান ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা’তে পূর্বে ধারণকৃত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং ৬ দফার দাবিতে আন্দোলন করতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন শহীদদের কথা স্মরণ করে বলেন, এই ৭ জুনে রক্তের অক্ষরে এই ৬ দফা দাবির কথা লিখে গিয়েছিল বলেই এই ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচন এবং আমাদের যুদ্ধে বিজয়। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। তিনি বলেন, এ দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ পাননি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। বিদেশ থাকা অবস্থায় আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। যখন দেশে ফিরে আসি তখন থেকে আমাদের একটাই চেষ্টা ছিল- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলব। তিনি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে রেখে গিয়েছিলেন। আজকে আল্লাহর রহমতে আমরা উন্নয়নশীল দেশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। রক্ত কখনো বৃথা যায় না-এটা প্রমাণিত সত্য। আজকে জাতির পিতা আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ আছে। ’৭৫-এর পর আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ হারিয়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু সেই আদর্শ আজকে আবার ফিরে এসেছে এবং জাতির পিতার সেই শিক্ষা নিয়েই বাংলাদেশ সারা বিশ্বের বুকে আজকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মর্যাদা নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত লাভ করবে।
পরে শহীদ বুদ্ধিজীবী আলিম চৌধুরীর কন্যা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ নুজহাত চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ড. নাজমা শাহীন।
বিশেষ বক্তব্যে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ছয় দফা দেয়ায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে প্রতিবাদে ডাকা হরতালে অনেক মানুষকে তারা (পাকিস্তানী হানাদাররা) হত্যা করেছে। ১১ জন সেখানে জীবন দেন। রক্তের অক্ষরে ৬ দফা তাঁরা লিখে যায়, আর সেই ৬ দফার ভিত্তিকে ৭০ এর নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়, যেটা পাকিস্তানিরা কোনদিনই আশা করেনি। এরপর অসহযোগ আন্দোলন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র বিপ্লব, সশস্ত্র বিপ্লব থেকে বিজয় অর্জন করেছি আমরা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছাত্রজীবন থেকে এদেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন। বাঙালি জাতির একটা উন্নত জীবন পাবে, সুন্দর জীবন পাবে- এটাই ছিল তাঁর আকাক্সক্ষা। তিনি সেটাই চেয়েছিলেন। তাঁর সময় চিন্তা ছিল কিভাবে এ জাতিকে দুঃখ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেবেন, ক্ষুধা শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিয়ে একটা উন্নত জীবন দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালির জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যে চিন্তা চেতনাগুলোর তাঁর (বঙ্গবন্ধু) ভেতরে লালিত ছিল, সেটাই প্রতিফলিত হয়েছিল ৬ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে। আর সেটা তাঁর আরও সুযোগ এসে গেল ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যখন দেখা গেল এই ভূখন্ডের মানুষ সম্পূর্ণভাবেই নিরাপত্তাহীন। সেই সময় তিনি এই ৬ দফা দাবিটা উত্থাপন করেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ৬ দফা দাবি উত্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানী শাসকদের কথা ছিল এটা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এই দাবি তিনি তুলেছেন। কিন্তু সেটা বাস্তব না। তিনি মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। ৬ দফা দাবিকে জনগণের দাবিতে রূপান্তর করতে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ৬ দফা দাবিকে জাতির পিতা নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের বাঁচার দাবি হিসেবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দলের অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকার মধ্যেই পরে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬ দফাকে গ্রহণ করা হয়। এরপর ১৯ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘৬ দফা প্রশ্নে কোন আপোস নেই। রাজনীতিতেও কোন সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদেরকেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। এ দেশে আওয়ামী লীগ সব সংগ্রামেরই বাণী প্রথম বহন করেছে। সংগ্রামের পথে তাঁরা নির্যাতন ভোগ করেছে সত্য, কিন্তু সংগ্রাম ব্যর্থ হয় নাই। ৬ দফা সংগ্রামও ব্যর্থ হবে না। ত্যাগ-তিতিক্ষা দ্বারা এ সংগ্রামকেও আমরা সার্থক করে তুলব, ইনশাআল্লাহ। বিজয় আমাদেরই।’
প্রধানমন্ত্রী ছয় দফার পক্ষে চট্টগ্রামে ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির জনসভায় জাতির পিতার ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-‘ যাওয়ার বেলায় বলে যাই, যারা দেশের জন্য মরে গেছে তারা কী স্বাধীনতা ভোগ করেছে? আপনারা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হোন। মৃত্যু আমার হতে পারে তবে ভবিষ্যত বংশধর সুখে থাকবে। ত্যাগ ও সাধনা ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসে না। ত্যাগ যদি করেন দাবি আদায় হবে।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা আরও বলেন, এরপর ২০ মার্চ পল্টন ময়দানে জনসভা হয়, সে জনসভায় সকলে ভাষণ দেন এবং ৬ দফাকে গ্রহণ করেন। তারপর তিনি (বঙ্গবন্ধু) শুরু করেন ছয় দফার পক্ষে সারা বাংলাদেশ সফর। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় আনাচে-কানাচে সফর করেন। একদিকে দলকে সংগঠিত করা এবং ৬ দফা দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন আদায় করা। সেই সঙ্গে সঙ্গে ৬ দফার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। দেশের জনগণ এই ৬ দফাকে খুব দ্রুত মেনে নেন।
তিনি বলেন, ৬ দফা দেবার পর আন্দোলন চলতে থাকে, বঙ্গবন্ধু সফর করতে থাকেন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা শেষে ফিরে আসার সময় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম, পাবনা, যশোরসহ খুলনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, যেখানেই জনসভা করেছেন বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বক্তৃতা করার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করেছে, তাঁকে জেলে নিয়েছে, আবার সেখান থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আরেক জায়গায় বঙ্গবন্ধু জনসভা করেছেন। বঙ্গবন্ধু কিভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তিনি নিজের জীবনকে কিভাবে উৎসর্গ করেছিলেন- তাঁর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সেই কথাগুলো উঠে এসেছে।
৭ জুনের হরতাল সফল করতে নিজের মায়ের অবদানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, মে মাসে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারে পর তাঁর মুক্তির দাবিতে এবং ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন চলছিল তিনি কারাবন্দী থাকা অবস্থায়। তখন ৭ জুন হরতাল ডাকা হয়। এখানে আমি আমার মায়ের কথা বলব। এই হরতাল সফল করার জন্য আমার মা (বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব) বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ইন্টেলিজেন্স বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাদের ছাত্রদের সঙ্গে, সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে হরতাল সফল করার জন্য কাজ করেছেন। রক্তের অক্ষরে লেখা ছয় দফার ভিত্তিতেই সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।
তিনি বলেন, তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় সম্মেলনের ডাক দেয়। সে সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এ দাবির প্রতি আয়োজক পক্ষ গুরুত্ব প্রদান করেনি। তারা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ৬-দফা উত্থাপন করেন। বাংলাদেশে এসেও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ছয় দফা উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু।