কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় নয়টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ২৩৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিল থেকে পাঁচ হাজার চার কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ২৪৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য রয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে ‘কুষ্টিয়া-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়কটি কুষ্টিয়া হতে মেহেরপুর পর্যন্ত যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ করতে গিয়ে প্রচুর গাছ কাটা পড়বে। এই গাছ কাটার পরে নতুন করে গাছ লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে প্রাইমারী স্কুল মিল’র একটি প্রকল্প একনেকে তোলা হলেও পরে সেটি বাতিল করা হয়।
মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রকল্প অনুমোদনের কথা জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, পরিকল্পনা সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মামুন-আল-রশিদ, মোছাম্মৎ নাছিমা বেগম।
অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৬৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কুষ্টিয়া-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়কটি কুষ্টিয়া হতে মেহেরপুর পর্যন্ত যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ শিরোনামের প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় জানানো হয়, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রচুর গাছ কাটা পড়বে। এই গাছ কাটার পরে নতুন করে গাছ লাগানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তখন আলোচনায় উঠে আসে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করার আগে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র আনতে অনেক সময় চলে যায়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়। সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রকল্পে ছাড়পত্র দিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ছাড়পত্র দিতে হবে পরিবেশ অধিদফতরকে। ওই সময়ে না দিলে মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তখন ছাড়পত্র ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করতে পারবে। অনির্দিষ্টকালের জন্য তো আর বসে থাকা যাবে না। কোন কাজ ফেলে রাখার সুযোগ নেই। চুপচাপ বসে থাকবেন সে সুযোগ নেই। তাই দ্রুত ছাড়পত্র দিতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২১৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের ব্যয় হবে ৮৮ কোটি টাকা। দরিদ্র মহিলাদের জন্য সমন্বিত পল্লী কর্মসংস্থান সহায়তা প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্প; এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। দরিদ্র নারীদের জন্য সমন্বিত পল্লী কর্মসংস্থান সহায়তা প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্প, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি ও কমলনগর উপজেলাধীন বড়খেরী ও লুধুয়াবাজার এবং কাদের প-িতের হাট এলাকা ভাঙ্গন থেকে রক্ষাকল্পে মেঘনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প, যার ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৮৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ারড পাওয়ার প্রকল্প, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। উপজেলা পর্যায়ে মহিলাদের জন্য আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ প্রকল্প, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের নবসৃজিত নারায়ণগঞ্জ ব্যাটালিয়নের অবকাঠামোগত বিভিন্ন স্থাপনা প্রকল্প; এতে ব্যয় হবে ২৩৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের নবসৃজিত নারায়ণগঞ্জ ব্যাটালিয়নের অবকাঠামোগত বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্প সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ঢাকার আশপাশে দেশের সিংহভাগ শিল্প কারখানা অবস্থিত। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সেখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই বিজিবির নতুন ব্যাটালিয়ন রাখা হচ্ছে। শিল্প পুলিশ থাকলেও মাঝে মধ্যে অন্য বাহিনীর সহায়তার প্রয়োজন হয়। সেই চিন্তা থেকেই এটি করা হয়েছে।
আলোচিত খিচুড়ি প্রকল্প বাতিল : প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের পুষ্টির চাহিদা পূরণে প্রস্তাবিত ‘প্রাইমারী স্কুল মিল’ প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। এক হাজার কর্মকর্তার বিদেশ সফরসহ অন্যান্য ব্যয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় থাকা প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় তোলা হলে এটি বাদ দেয়া হয়। একনেক সভা শেষে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, একনেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘প্রাইমারী স্কুল মিল’ প্রকল্পটি বাদ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এটি পছন্দ করলেও এর কাঠামো পরিবর্তন করতে বলেছেন। মন্ত্রী বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষার্থীদের খাবার দেয়া অব্যাহত রাখতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে তা রান্না করা খাবার হিসেবে নয়। নতুন কোন ফরম্যাটে। ‘স্কুলে খাবার রান্না করা হলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে ক্ষতি হতে পারে। গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নতুন কোন ফরম্যাটে স্কুলের শিক্ষার্থীদের খাবার দেয়ার প্রকল্প নিতে বলা হয়েছে।’
পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, এ প্রকল্পের চূড়ান্ত প্রস্তাবে বিদেশে প্রশিক্ষণসহ বেশ কিছু খাত বাদ দেয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পের শুরুতে এক হাজার কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। এতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রাক-মূল্যায়ন কমিটির সভায় প্রকল্পটির এ ব্যয়সহ অন্যান্য কিছু ব্যয় নিয়ে আপত্তি তুলে তা সংশোধনের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীদের চাল, ডাল, শাকসবজি মিশিয়ে দুপুরে রান্না করা পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার দেয়ার কথা ছিল। শুধু বিদেশ সফরই নয়, প্রকল্পটিতে দেশেই প্রশিক্ষণের জন্য আরও ১০ কোটি টাকা, সামাজিক সংহতির জন্য সাড়ে সাত কোটি ও পরামর্শকের জন্য ছয় কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ ছাড়া দুই কোটি টাকা দিয়ে ফার্নিচার, মিটিং, সেমিনার ও ওয়ার্কশপের জন্য আরও পাঁচ কোটি টাকা নিয়েও আপত্তি তুলেছিল পরিকল্পনা কমিশন। পাশাপাশি পরিদর্শন ও মূল্যায়নের জন্য পাঁচ কোটি টাকা, খাবার সরবরাহের জন্য ১৭ কোটি টাকা, প্লেট কেনার জন্য ১১৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, গাড়ি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল।
সমালোচনা ও পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির পরে ডিপিপি পুনর্গঠন করা হয়। শুরুতে প্রস্তাব ছিল ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকার। পরে প্রকল্পের প্রায় প্রতিটি খাত মিলিয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমানোর কথা বলা হয়েছিল। এর আওতায় পাঁচ বছর ধরে প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীকে পুষ্টিকর বিস্কুট ও রান্না করা খিচুড়ি দেয়ার প্রস্তাব ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পুষ্টির জোগান বাড়াতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৪৯২টি উপজেলা ও ২১টি শিক্ষা থানার শিক্ষার্থীদের দুপুরে স্কুলে রান্না করা গরম খাবার দেয়ার কথা ছিল। ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা ছিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের।