কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভারত সীমান্তবর্তী দেশের সাত জেলায় করোনা সংক্রমণ কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। কঠোর বিধি নিষেধ ও নজরদারির পরও জেলাগুলোতে সংক্রমণ শঙ্কা জাগাচ্ছে জনমনে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় জেলার হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলাগুলোতে লকডাউন দেয়ার সুপারিশ করা হলেও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাদে বাকিগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে স্থানীয় প্রশাসনকেই লকডাউন ঘোষণার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মন্ত্রী পরিষদের পক্ষ থেকে।
গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী জেলাতেই নতুন আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯৮ জনে। শনাক্তের হার ৪২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ঈদের পর এক দিনে শনাক্তের হার বিবেচনায় এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। নতুন ১৯৮ জন নিয়ে জেলায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছে।
খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ৩০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে এটাই এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের সংখ্যা। এর আগে গত ৩০ মে এক দিনে ২৩২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।
গত রবিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে চাঁপাইনবাবঞ্জ বাদে রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলাতে লকডাউনের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু জেলাগুলোর বেশিরভাগেই অর্থকরী ফসল হিসেবে আম ও লিচু উৎপাদিত হয়। এই ফসলের ওপর জেলাগুলোর মানুষের বড় একটি অংশই নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করেই স্থানীয়ভাবে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতেও জেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ থেকে।
সীমান্তের জেলাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনায় নতুন সংক্রমণের পাশাপাশি গুরুতর রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সেখানকার রোগীরা জেলা হাসপাতালগুলোতে ঠিকমতো আইসিইউ সাপোর্ট পাচ্ছেন না। ফলে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় তাদের বিভাগীয় শহর, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা রাজধানীতে নিয়ে আসার আগেই রাস্তায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জেলা হাসপাতালগুলোতে তীব্র জনবল সঙ্কট। সব মিলিয়ে বিভাগীয় বড় হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে। চাপে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।
করোনার নতুন হটস্পট হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ হাসপাতালে অক্সিজেনের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সেখানে অক্সিজেন সরবরাহে নতুন প্লান্ট বসানো হচ্ছে। জেলাটির তিন দিকে ভারতের সীমান্ত হওয়ায় ভারতীয় ধরনের অস্তিত্বও মিলেছে সেখানে। সাতজনের দেহে ভারতীয় ধরন পাওয়া গেছে। আক্রান্তরা সবাই কমিউনিটি সংক্রমণের মাধ্যমে অসুস্থ হয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাশের জেলা রাজশাহীতেও এখন সংক্রমণের হার উর্ধমুখী। মঙ্গলবার সেখানে ৪২ দশমিক ৫৮ শতাংশ হারে রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া নওগাঁ ও নাটোর জেলাতেও সংক্রমণের উর্ধগতি রয়েছে। মূলত এই জেলাগুলোর রোগীদের চাপ পড়ছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওপর।
সরকারী নীতি অনুযায়ী, প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে ১০ থেকে ২০ বেডের আইসিইউ থাকা বাধ্যতামূলক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন অনুযায়ী, ১০০ বেডের হাসপাতালে কমপক্ষে ১০ বেডের আইসিইউ থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় ধরনে অধিক সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। তবে এসব জেলার অধিকাংশ হাসপাতালেই নেই করোনা চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২৫০ বেডের জেলা সদর হাসপাতালে ২০ বেডের কোভিড ইউনিট থাকলেও কোন আইসিইউ নেই। রোগীর অবস্থা খারাপ হলেই আইসিইউ সাপোর্টের জন্য নিয়ে যেতে হয় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। একই অবস্থা অন্য জেলা হাসপাতালগুলোতেও।
গত বছরের ২ জুন করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় গতবছরের ২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন, ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের নির্দেশ দেন। কিন্তু এতদিনেও জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতিকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, করোনা চিকিৎসার অন্যতম উপাদান আইসিইউ। পরিস্থিতি একটু জটিল হলেই রোগীদের আইসিইউ লাগে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে আইসিইউ না থাকায় সঙ্কটাপন্ন রোগীদের নিয়ে যেতে হচ্ছে বিভাগীয় হাসপাতালে বা তাদের অনেককেই আসতে হচ্ছে ঢাকায়। এটি একটি চরম দুর্ভোগ। তিনি বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে যেভাবে মানুষ কেনাকাটা ও গ্রামের বাড়িতে যাওয়া শুরু করেছিল, সংক্রমণ তো বাড়বেই। আমরা আগেই বলেছিলাম ঈদের ১০ থেকে ১৪ দিন পরেই এর প্রভাব দেখা যাবে। এখন তা-ই দেখা যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও সংক্রমণ বাড়ছে, এক্ষেত্রে করোনার ভারতীয় ধরনও কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য দেশের সব জেলা সদর হাসপাতালে হাইফ্লো-ন্যাজাল ক্যানোলা পাঠানো হয়েছে। এটি থাকলে আর আইসিইউয়ের প্রয়োজন হয় না। তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে আইসিইউ আগে ছিল না। বর্তমানে সব জেলায় আইসিইউ স্থাপনের কাজ চলছে। এদিকে করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি সম্প্রতি অধিক সংক্রমিত সীমান্তবর্তী সাত জেলায় সর্বাত্মক লকডাউন দেয়ার সুপারিশ করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
করোনা সংক্রমণের উর্ধগতি দেখা দেয়ায় সীমান্তবর্তী সাত জেলায় বিশেষ লকডাউন বাস্তবায়ন চায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের কাছে একটি সুপারিশ পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে দ্বিতীয় দফায় লকডাউন ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। মঙ্গলবার থেকে ৭ জুন পর্যন্ত এ লকডাউন কার্যকর থাকবে। সারাদেশে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের মধ্যেই ২৪ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন প্রথম দফায় লকডাউন ঘোষণা করেছিল। তখন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে সারাদেশের গণপরিবহন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। স্থানীয়ভাবে লকডাউন ঘোষণার পর সেখানে আগের তুলনায় সংক্রমণ কমেছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের সীমান্ত এলাকায় মৃত্যু এবং আক্রান্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য কারিগরি কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী সীমান্তের সাত জেলায় দ্রুতই সর্বাত্মক লকডাউন দেয়া হবে। এছাড়া যেসব জেলায় করোনার সংক্রমণ উর্ধমুখী সেখানে লকডাউন দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লকডাউন দিয়ে দেয়া উচিত, তাহলে সংক্রমণ ছড়ানো রোধ করা যাবে।
খুলনা বিভাগে আক্রান্ত বাড়ছে : খুলনা বিভাগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের উর্ধগতি অব্যাহত আছে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা-সংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ৩০ দিনে বিভাগে ৩ হাজার ২৭৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে ৭০ জন মারা গেছেন। গত ১০ দিনে মারা গেছেন ৩৪ জন।
মঙ্গলবারে নতুন শনাক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৯১ জন (নগরে ৮০) খুলনা জেলার বাসিন্দা। এ ছাড়া বাগেরহাটে ১১ জন, যশোরে ৮৪, সাতক্ষীরায় ৩৫, নড়াইলে ৫, মাগুরায় ৩, মেহেরপুরে ১৬, চুয়াডাঙ্গায় ১৮, ঝিনাইদহে ৬ ও কুষ্টিয়ায় ৩১ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। জেলাভিত্তিক হিসেবে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৩১৫ রোগী শনাক্ত হয়েছেন খুলনা জেলায়। এর মধ্যে খুলনা শহরেই শনাক্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৩৯৯ জন।
রাজশাহীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ : মঙ্গলবার দুপুরে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ হাবিবুল আহসান স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় ৩৮২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। রাজশাহীতে ২৪ ঘণ্টায় মোট ৪৬৫ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৯৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৪২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ঈদের পর এক দিনে শনাক্তের হার বিবেচনায় এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। নতুন ১৯৮ জন নিয়ে জেলায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছে। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২১ জন, নওগাঁর ৬৭ জন, নাটোরের ১৭, জয়পুরহাটের ২৯, বগুড়ার ১২, সিরাজগঞ্জের ২০ ও পাবনার ১৮ জন। লকডাউনের কারণে চাপাইনবাবগঞ্জ জেলায় নতুন সংক্রমণের হার কমেছে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট ও আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ২১৬ জন। যার মধ্যে পজিটিভ রোগী ৯১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে করোনা ইউনিটের আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন ১৬ জন। এরমধ্যে করোনা ইউনিটে ৩০ রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৮ জন, রাজশাহীর ১০ জন ও নাটোরের দুইজন।