স্টাফ রিপোর্টার :
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পরপরই সারাদেশের মতো সিলেটেও অস্থির হয়ে উঠেছে পেঁয়াজের বাজার। সকালের দিকে যেসব খুচরা দোকানীরা ৭০ থেকে ৮০ টাকায় প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি করেছিলেন দুপুরের পর তারাই ১০০ থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। নগরীর প্রধান পাইকারী বাজার কালিঘাটেও সারাদিন পেঁয়াজ নিয়ে নানা তেলেসমাতি দেখা গেছে। অনেক বড় বড় পাইকাররা গোডাউন ভর্তি পেঁয়াজ থাকার পরেও বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। তারা সুযোগে রয়েছেন দাম আরো বাড়বে। যেকারণে এখনই বাজারের ছাড়ছেন না।
নগরীর বন্দরবাজার, আম্বরখানা ও কাজিরবাজারসহ বিভিন্ন পাইকারী ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সময় যত ঘরাচ্ছে পেঁয়াজের দাম যেন হুঁ-হুঁ করে বাড়ছে। পাড়া-মহল্লার কোন কোন দোকানে প্রতিকেজি পেঁয়াজ দেড়শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে দেখা গেছে। গতকাল অনেকেই বাজারে গিয়ে পেঁয়াজের দাম শুনে না কিনেই বাড়ি ফিরেছেন। কেউ কেউ আবার ৫ কেজি ১০ কেজির জায়গায় ১ কেজি অথবা ২ কেজি কিনেই সন্তষ্টি থাকতে হয়েছে।
এদিকে, পেঁয়াজের মজুত ঠেকাতে মাঠে নেমেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই সময়ে পেঁয়াজের সরবরাহ ঠিক রাখাসহ মজুত ঠেকাতে মাঠে নেমেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১০টি টিম। সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১০ জন যুগ্ম-সচিবের নেতৃত্বে গঠিত এই ১০টি টিম দেশের বিভিন্ন জেলায় গেছে। টিমগুলোর কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে যুক্ত হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন সংশ্লিষ্টদের পেঁয়াজ মজুত না করে তা বাজারে ছেড়ে দিয়ে সরবরাহ ঠিক রাখারও অনুরোধ জানিয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার হঠাৎ করে প্রতিটন পেঁয়াজের রফতানি মূল্য ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮৫২ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে। এরপর থেকে অস্থির হয়ে ওঠা পেঁয়াজের বাজারে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে রবিবার (২৯ সেপ্টেম্বর)। এদিন ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার বরাত দিয়ে জানানো হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ থাকবে। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে দেশীয় পেঁয়াজের বাজারে। দেশের বাজারে পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকহারে বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। মাত্র ১৩ দিনের ব্যবধানে দুই দফায় মূল্য ৫০ টাকা থেকে বেড়ে সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কোথাও ১০০ টাকা, কোথাও ১১০ টাকা। সুযোগ বুঝে আবার কেউ কেউ ১২০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেঁয়াজের উৎপাদনকারী জেলা-পাবনা, ফরিদপুর ও নাটোর থেকে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন। এই সিন্ডিকেট ভাঙতেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে। দেশের পেঁয়াজ সরবরাহকারী জেলাগুলোয় এই টিমগুলোর সদস্যরা অবস্থান করবেন। এ সময় তারা পুরো বিষয়টি তদারকি করবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, বাজারে পেঁয়াজের মূল্য বাড়ার কারণ খুঁজতে টিমগুলো কাজ করবে। একইসঙ্গে টিমগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে পেঁয়াজের বাজার পর্যবেক্ষণ করবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) থেকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট ৩৫টি ট্রাকে প্রতিকেজি ৪৫ টাকা দরে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি করবে। টিসিবির এই কার্যক্রম ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হয়েছে। তবে, এতদিন ১৬টি ট্রাকে করে বিক্রি করলেও কাল থেকে এ সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৫টি করা হয়েছে।’
সচিব বলেন, ‘ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানার পর ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়ে মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন, কেউ কেউ মজুত করার চেষ্টা করছেন বলেও তথ্য মন্ত্রণালয়ে এসেছে। যদি কোনও অসাধু ব্যবসায়ী এই পেঁয়াজ মজুত রেখে মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে ইতোমধ্যে মিশর থেকে আমদানি করা দুই জাহাজ পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে বলে জানিয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘এক জাহাজের পেঁয়াজ খালাসও করা হয়েছে। মিয়ানমার থেকেও এলসির পাশাপাশি বর্ডার ট্রেডের মাধ্যমে প্রতিদিনই পেঁয়াজ বাংলাদেশে আসছে। পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া তুরস্ক থেকেও পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেড় মাসের মধ্যে দেশে নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করবে। এই মুহূর্তে আগামী ২ মাসের প্রয়োজনীয় পেঁয়াজের মজুত রয়েছে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা ট্যারিফ কমিশনের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। চলতি বছর দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ২৩ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদিত পেয়াজের ৩০ শতাংশ পচে যায়। তাই ঘাটতি দাঁড়ায় সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন। এই ঘাটতি মেটাতেই সরকার ৮ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে।
বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘দেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাছ উৎপাদনেও সফলতা অর্জন করেছে। তাহলে পেঁয়াজ উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব। তাই কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে স্থায়ী সমাধানে যাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যেন পেঁয়াজের উৎপাদন আরও বাড়ানো যায় এবং নিজেদের উৎপাদিত পেঁয়াজ থেকেই চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়।’
এদিকে, ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণার পরের দিনই রাজধানীর বাজারগুলোয় একলাফে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে।
রবিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর পর্যন্ত প্রতিকেজি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য ছিল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা। বিভিন্ন আড়তে প্রতিকেজি পেঁয়াজের পাইকারি মূল্য ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। কিন্তু সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই এলাকা ভেদে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর শ্যামবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, ‘ভারত সরকার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে কলকাতায় প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ রুপি দরে। তাই আমদানিকারকরা আমাদের ফোন করে বিষয়টি জানিয়ে মূল্য বাড়িয়ে বিক্রির পরামর্শ দিয়েছেন।’
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘ভারত সরকার পেঁয়াজের মূল্য বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর মিয়ানমার, তুরস্ক ও মিশর থেকে আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্রে বন্যার কারণে পেঁয়াজের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ বন্যায় সেখানে অনেক পেঁয়াজ পচে গেছে বলেও তিনি জানান।