যাকাত ধনী-গরীবের মাঝে ইনসাফপূর্ণ বণ্টনব্যবস্থা

66

এহসান বিন মুজাহির :

ইসলামের যাকাত বিধান ধনী-গরীবের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ বণ্টনব্যবস্থা। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী-গরীবের মাঝে ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়। আর্থিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। সমাজ থেকে দারিদ্র্যতা দূর হয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর যাকাত ফরজ। যাকাত আদায়ের সুনির্দিষ্ট সময় না থাকলেও অফুরন্ত পুণ্যে ভরা মাহে রমজানুল মোবারকই যাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। যেহেতু নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের বছরের যেকোনো দিন নির্দিষ্ট পরিমাণে যাকাত আদায় করতে হবে, সেহেতু যাকাত আদায়ের সে সময়টা রমজান মাসকে বেছে নেয়াটা সর্বোত্তম। কেন না রমজান হলো ইবাদতের বসন্তকাল। আর আল্লাহ এই রমজান মাসে তাঁর যেকোনো ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল, ইবাদতের সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। তাই যাকাত আদায়কারী ব্যক্তিদের এ মাসে সুবর্ণ সুযোগটি গ্রহণ করা উচিত। যাকাত কারও প্রতি করুণা প্রদর্শন নয়; বরং গরীব-দুঃখীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার।
ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত নিয়মে যাকাত আদায় করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর ফরজ দায়িত্ব। আভিধানিক অর্থে যাকাতের অর্থ হলো বৃদ্ধি করা, পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয় এবং মালের মধ্যে বরকত বৃদ্ধি পায়। ঈমান আনা ও নামাজ আদায়ের পর যাকাত প্রদান করা ঈমানের দাবি। ইসলামি শরিয়তে জীবনযাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন মেটানোর পর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা যে কোন একটির সমমূল্যের সম্পদ কারো নিকট পূর্ণ এক বছর সঞ্চিত থাকলে নির্ধারিত সম্পদের একাংশ (শতকরা আড়াই শতাংশ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরআনে বর্ণিত আট প্রকার খাতে ব্যয় করাকেই যাকাত বলা হয়।
কোরআন ও হাদিসে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরআনুল কারীমে সূরা বাকারার ১১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত দাও’। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘যারা যাকাত দেয় না তারা হলো সে সব লোক, যারা আখেরাতের প্রতিও অবিশ্বাসী’। (সূরা হামিম আস সাজদা : ৭)। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তাদের ধনমালে রয়েছে সুনির্দিষ্ট অধিকার। প্রার্থী ও বঞ্চিত মানুষের জন্য। (সূরা মাআরিজ : ২৪)। আল্লাহ তায়ালা আরও এরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও। (সূরা নুহ : ৫৬)। কোরআন মাজিদে আরও এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং নামাজে অবনত হও তাদের সঙ্গে যারা অবনত হয়। (সূরা বাকারা : ৪৩)। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং রাসূল (সা.) এর আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও’। (সূরা নূর : ৫৬)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও এরশাদ করেছেন, ‘আর যারা সোনা ও রুপা সঞ্চিত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ প্রদান করুন। সেদিন ওইসব (সোনা-রুপা) দোজখের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। এটা তোমরা নিজেদের জন্য যা সঞ্চয় করেছিলে তার প্রতিফল। সুতরাং যা তোমরা সঞ্চিত করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ করো। (সূরা তওবা : ৩৪-৩৫)।
অনুরূপভাবে আল্লাহপাক আরও এরশাদ করেন, ‘তোমাদের কীসে জাহান্নামে নিয়ে এসেছে? তারা বলবে, আমরা নামাজ পড়তাম না এবং অভাবগ্রস্তকে আহার্য (যাকাত) দিতাম না। (সূরা মুদাসসির : ৪২-৪৪)। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় যাকাতের হকদ্বার সম্পর্কে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চই সদকাহ হচ্ছে, ফকির ও মিসকিনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারিদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা : ৬০)। পবিত্র কোরআনে আরও এরশাদ হচ্ছে ধনীদের সম্পদে রয়েছে বঞ্চিতদের অধিকার (সূরা আয যারিয়াত : ১৯)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবি মুআজ (রা.) কে গভর্নর হিসেবে ইয়েমেনে প্রেরণ করলেন। এ সময় রাসূল (সা.) তাকে বললেন, তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছ যারা আহলে কিতাব।
প্রথমত, তুমি তাদের এ কথার সাক্ষ্য দিতে আহবান করবে যে, আল্লাহ ব্যতিত কোনো ইলাহ তথা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। অতপর তারা যদি এ কথার আনুগত্য করে, তবে তাদের জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তায়ালা দিবারাত্রে তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দিয়েছেন। তারা যদি এ কথার আনুগত্য করে তবে তাদের জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর যাকাত ফরজ করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা হবে। (মুসলিম : ১৬৮০)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যেসব স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক তা হতে তার হক (যাকাত) আদায় করে না, যখন কেয়ামতের দিন আসবে নিশ্চয়ই তার জন্য অনেকগুলো আগুনের পাত তৈরি করা হবে এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। আর তা দ্বারা তার পাঁজরে, ললাটে এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই পৃথক করা হবে তখনই পুনরায় তা শুরু করা হবে। তার এ শাস্তি অব্যাহত থাকবে সেদিন পর্যন্ত যার পরিমাণ হবে ৫০ হাজার বছরের সমান। যতক্ষণ না বান্দাদের সবার বিচার ফয়সালা শেষ করা হবে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ পথ ধরবে, হয় বেহেশতের দিকে না হয় দোজখের দিকে। (মুসলিম : ১৬৮১)।
যাকাতের ফরজ : যাকাতের ফরজ হওয়ার জন্য শত হলো ছয়টি। শর্তগুলো হচ্ছে : ১. মুসলমান হওয়া। ২. যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন হওয়া। ৩. ঋণমুক্ত হওয়া। ৪. নেসাব পরিমাণ (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সমপরিমাণ) সম্পদের মালিক হওয়া। ৫. নেসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। ৬. যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
যাকাতের ক্ষেত্র ও নিসাব : যাকাতের ক্ষেত্র খুবই ব্যাপক। প্রায় সকল প্রকার ধন সম্পদের ওপরই যাকাত ধার্য করা হয়েছে। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, কৃষিজ উৎপাদন, ব্যবসায়ের পণ্য, গৃহপালিত পশুসহ প্রায় সব কিছুই যাকাতের আওতায় আসে। যাকাতের হার শরিয়তের বিধান দ্বারা নির্দিষ্ট। একে মানুষের ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়নি। যাকাতক্ষেত্র অনুযায়ী যাকাত প্রদানের পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন। (যাকাত কোনো ক্ষেত্রে ২.৫ ভাগ। কোনো ক্ষেত্রে ৫ ভাগ, কোন ক্ষেত্রে ১০ ভাগ)। ফকিহগণের সর্বসম্মতিক্রমে স্বর্ণে যাকাতের নিসাব ২০ মিসকাল বা সাড়ে সাত ভরি, তথা ৮৭.৪৫ গ্রাম। এর কম হলে যাকাত দিতে হবে না। কারো নিকট ২০ মিসকাল পরিমাণ স্বর্ণ যদি এক বছর অতিক্রম করে তবে তাতে অর্ধ মিসকাল স্বর্ণ যাকাত ওয়াজিব হবে। (নূরুল আনওয়ার, শরহে বেকায়া)। ৫২ তোলা রুপা অথবা ৭.৫০ তোলা সোনা অথবা সমপরিমাণ অর্থ। শর্ত হলো নেসাব পরিমাণ সম্পদ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। উপরিউক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদ যার আছে তার ওপর যাকাত ফরজ। তবে গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে যাকাত আদায় পদ্ধতি ভিন্ন। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রী ছাড়াও মহিলাদের অলঙ্কারের যাকাত আদায় করা ওয়াজিব। নাবালেগের সম্পদের যাকাত অভিভাবক আদায় করবেন। ব্যবসায়িক পণ্যে যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে দোকান বা গুদামে মজুতকৃত সব পণ্যের মূল্যমান হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে। শিল্প-কারখানায় প্রস্তুতকৃত প্রস্ততকৃত পণ্যসামগ্রীর ওপরও যাকাত আদায় ওয়াজিব। অবশ্য কারখানার ভূমি, বিল্ডিং, মেশিনারি, গাড়ি ইত্যাদির ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। আনুমানিক থেকে বরাদ্দের মতো আন্দাজে একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে দান করলে যাকাত আদায় হবে না। সম্পদের হিসাব করে পরিমাণমতো যাকাত আদায় করতে হবে।
যাকাতের হকদার : কাছের আত্মীয় স্বজন যারা আর্থিকভাবে দুর্বল তারা যাকাতের বেশি হকদার। যারা যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত কোরআনের আলোকে তারা হচ্ছেন : নিঃস্ব, অভাবী, যাকাত সংগ্রহে নিযুক্ত কর্মী, নও মুসলিম, ঋণী, মুক্তিপ্রত্যাশী দাস-দাসী, মুজাহিদ ও মুসাফির।
যাকাতের খাত : যাকাতের খাত হলো আটটি। খাতগুলো হলো : ১.ফকির। ২. মিসকিন। ৩. যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি। ৪. মুআল্লাফাতুল কুলুব। ৫. দাসমুক্তি। ৬. ফি সাবিলিল্লাহ। ৭. ঋণগ্রস্ত। ৮. মুসাফির। উপরিউক্ত ৮ টির মধ্যে সবচেয়ে প্রাপ্যের অগ্রাধিকার হচ্ছে ফকির ও মিসকিন, অর্থাৎ সমাজের দরিদ্র শ্রেণি।
যাকাতের টাকা একজনকে অথবা খুচরা করে অনেকজনকে দেওয়া যাবে। তবে ১০০ জনকে খুচরা টাকা, শাড়ি-লুঙ্গি না দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো করে ব্যবস্থা করে দিতে পারলে (যেমন একটি দুধের গাভী কিনে দিলেন, দোকান করে দিলেন, অন্য কোনো ব্যবসার পুঁজি করে দিলেন) তা দারিদ্য বিমোচনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। যাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হবে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন। এমন প্রক্রিয়ায় যাকাত দেয়া সমীচীন নয় যাতে গরীব গরীবই থেকে যায় এবং প্রতি বছর সে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে। একজন যাকাতদাতা কোনো গরীব ব্যক্তিকে ১০ কেজি চাল বা একটি শাড়ি বা কিছু টাকা বা এই জাতীয় কিছু দিলো, সে কয়েকদিনে টাকা বা চাল শেষ করে দিলো, কাপড়টি সে পরিধান করে পুরনো করে দিলো। ফলে সে গরিবই থেকে গেল। যাকাতের অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থান করা উচিত যাতে সে স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসার পরিচালনা করতে পারে। দরিদ্রকে কি পরিমাণ যাকাত দিতে হবে এ সম্পর্কে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ‘উমর (রা.) বলেন- ‘যখন তোমরা দিবে তখন ধনী বানিয়ে দাও’। পিতা-মাতা-দাদা-নানা-স্ত্রী-সন্তানদের যাকাত দেওয়া যাবে না। মসজিদ ও মাদরাসা ভবন নির্মাণের জন্য যাকাত দেওয়া যাবে না। তবে মাদরাসার এতিম ও গরীব শিক্ষার্থীদের যাকাত দেওয়া যাবে। যাকাত রমজান মাসেই দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুবিধামতো অর্থবছর নির্ধারণ করে নিয়ে প্রতি বছর সেই হিসাব মোতাবেক যাকাত আদায় করা যায়। তবে রমজানে দানের সওয়াব যেহেতু বেশি, তাই বেশিরভাগ মুসলমান রমজানে যাকাত আদায় করে থাকেন। যাকাত প্রদানের আগে প্রত্যেকের নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেওয়া জরুরি। নিয়ত শুদ্ধ না থাকলে যাকাত আদায় কবুল হবে না। মহান আল্লাহ তাআলা যাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্টদের যথযথভাবে যাকাত আদায়ের তৌফিক দান করুন। আমিন।