কাজিরবাজার ডেস্ক :
পবিত্র মাহে রমজানের আজ ১৩তম দিবস। আজ আমরা এখানে একজন পথিকৃৎ মহীয়সী মহিলার সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত অনুধাবন করব। তিনি হলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা (রা.)। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স.)-এঁর প্রিয়তম সহধর্মিণী। মহানবীর তিরোধানের পর ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য জীবন্ত কিংবদন্তী ছিলেন হযরত আয়িশা (রা.)। সাহাবী পরবর্তী যুগের প্রখ্যাত তাবেঈ আতা ইবনে আবী রাবাহ (রহ.) বলেন, হযরত আয়িশা ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ বা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ, সবচেয়ে জানা ব্যক্তি এবং আমজনতার মধ্যে সুন্দর মতামতের অধিকারিনী (আল মুসতাদরিক)। হযরত রাসূলে কারীম (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা জ্ঞানের অর্ধেকই আয়িশা হুমায়রা থেকে গ্রহণ কর।’ মহানবী যে প্রিয়তমা স্ত্রী সম্পর্কে উম্মতদেরকে জ্ঞান আহরণের এত উচ্চ তাগিদ দিয়েছেন আজ আমরা তার থেকে জ্ঞানের ফায়দা হাসিল তো দূরের কথা, তার সম্পর্কেও অনেক নারী-পুরুষের মোটামুটি ধারণা কম রয়েছে। হিজরী সনের শাওয়াল মাস। হযরত আয়িশার সঙ্গে মহানবীর পবিত্র শাদি মোবারক সংঘটিত হয়েছিল। এদিক দিয়ে এ মাস নবীপত্নী আয়িশার বিভিন্ন স্মৃতিবিজড়িত। সঙ্গত কারণেই আজ এ মহীয়সী মহিলা সম্পর্কে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাঁর জীবনের কিছু চুম্বক আলোচনা।
খুব অল্প বয়সে তিনি স্বামীর ঘরে উঠেছেন। তাই তখনও শিক্ষাদীক্ষা পার করে আসতে পারেননি। কিন্তু সৌভাগ্য তাঁর; ঐশী জ্ঞানের অঝোর ধারা যেখানে প্রতিনিয়ত বর্ষিত হতো সেখানেই এখন তাঁর অবস্থান। শরীয়তের মহান শিক্ষক ঘরেই ছিলেন। রাতদিন তাঁর সাহচর্য লাভে ধন্য হতেন। প্রতিদিন মসজিদে নববীতে রাসূলুল্লাহর (সা.) তা’লিম ইরশাদের মজলিস বসত। মসজিদের গা ঘেষেই ছিল হযরত আয়িশার (রা.) হুজরা। এ কারণে রাসূল (সা) বাইরে লোকদের যে শিক্ষা দিতেন আয়িশা (রা.) ঘরে বসেই তাতে শরিক থাকতেন। কখনও কথা দূরত্ব বা অন্য কোন কারণে বুঝতে না পারলে রাসূল (সা.) ঘরে এলে জিজ্ঞেস করে বুঝে নিতেন। (মুসনাদ -৬/৭৭)।
হিজরী ১১ সনে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বিদায় হজের সফরসঙ্গী হন তিনি। হজ ও উমরার নিয়ত করেন। কিন্তু স্বাভাবিক নারী প্রকৃতির কারণে যথাসময়ে তাওয়াফ করতে পারলেন না। দারুণ কষ্ট পেলেন। কাঁদতে শুরু করলেন। রাসূল (সা.) বাহির থেকে এসে কাঁদতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলেন এবং তাকে করণীয় মাসআলা বাতলে দিলেন। তিনি ভাই আবদুর রহমান ইবন আবু বকরকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে অসমাপ্ত আবশ্যকীয় কাজ সমাপন করলেন। (বুখারি, কিতাবুল হজ্ব)। উল্লেখ্য, বিদায় হজে কমবেশ প্রায় এক লাখ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। উঁচুস্তরের সকল সাহাবীই সফরে রাসূলুল্লাহর (সা.) সফরসঙ্গী ছিলেন। ‘তানঈম’ নামক স্থানে নতুন ইহরাম বেঁধে কা’বার তাওয়াফ করার নির্দেশ দেন। নবীপত্নী হযরত আয়িশা তানঈম এলাকায় নতুন করে ইহরাম পড়ে ওমরাহ পালন করেছিলেন বলে আজও লাখ লাখ হাজী সে এলাকা থেকে ইহরাম বেঁধে উমরা পালন করেন। সৌদি সরকার এখানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশাল সুন্দর মসজিদ। এ মসজিদকে হযরত আয়িশার পূর্ণ স্মৃতির কারণে মসজিদে আয়িশা বলা হয়। স্থানীয়রা তানঈম এবং ওমরা মসজিদও বলে।
হাফিজ ইবন কায়্যিম হযরত আয়িশার (রা.) এ বর্ণনাটি নকল করার পর বলেছেন, হযরত আয়িশার (রা.) আমল ও হাদিস থেকে হজের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মূলনীতি গৃহীত হয়েছে। যেমন নারীদের ক্ষেত্রে শারীরিক বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে তাওয়াফুল কুদুম রহিত হয়ে যাবে। এ অবস্থায় হজের পর উমরার নিয়্যত করা জায়েজ। নারীরা বিশেষ অবস্থায় শুধু কা’বার তাওয়াফ ছাড়া হজের অন্যসব কাজ আদায় করতে পারবে। ‘তানঈম’ এলাকা হারামের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং হারামের বাইরে। উমরা এক বছরে এমনকি এক মাসেও দুই বার আদায় করা যায় ইত্যাদি। (যা’দুল মাআদ ১/২০৭, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা ৫/১৭০)।
একবার হযরত আয়িশা (রা.) স্বপ্ন দেখলেন যে, তাঁর ঘরে একের পর এক তিনটি চাঁদ ছুটে পড়ছে। তিনি এ স্বপ্নের কথা পিতা আবু বকরকে (রা.) বলেন। এরপর যখন রাসূলে কারীম (সা.) এর ইন্তেকাল হয় এবং তাঁকে আয়িশার ঘরে দাফন করা হলো তখন আবু বকর (রা.) মেয়েকে বললেন, তোমার স্বপ্নে দেখা সেই তিন চাঁদের একটি এই (অর্থাৎ তোমার ঘরে হুজুর (সা.) এর মহান লাশের অবস্থান) এবং (তিন চাঁদের) সবচেয়ে ভালটি। পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করেছে যে তাঁর স্বপ্নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় চাঁদ ছিলেন আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)।
হযরত আবু বকর (রা.) মাত্র দুই বছর খিলাফত পরিচালনার সুযোগ পান। হিজরী তেরো সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর যখন অন্তিম দশা তখন মেয়ে আয়িশা পিতার শিয়রে বসা। এর আগে সুস্থাবস্থায় তিনি মেয়েকে কিছু বিষয় সম্পত্তি ভোগ দখলের জন্য দিয়েছিলেন। এখন অন্য সন্তানদেরও বিষয় সম্পত্তির প্রয়োজনের কথা মনে করে বললেন: আমার কলিজার টুকরো মেয়ে! তুমি কি ঐ বিষয় সম্পত্তি তোমার অন্য ভাইদের দিয়ে দেবে? মেয়ে বললেন: অবশ্যই দেব। তারপর তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন রাসূল (সা.)-এঁর কাফনে কয়টি কাপড় ছিল? মেয়ে বললেন, তিনখানা সাদা কাপড়। আবার জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কোন্দিন ওফাত পান? বললেন সোমবার। আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি বার? বললেন: সোমবার। বললেন তাহলে আজ রাতে আমাকে যেতে হবে। তারপর তিনি নিজের চাদরটি দেখালেন। তাতে জাফরানের দাগ ছিল । বলল এ কাপড়খানি ধুয়ে তার ওপর আর দুইখানি কাপড় দিয়ে আমাকে কাফন দেবে। মেয়ে বললেন, এই কাপড় তো পুরনো। বললেন, মৃতদের চেয়ে জীবিতদেরই নতুন কাপড়ের প্রয়োজন বেশি। সেইদিন রাতেই তিনি ওফাত পান। হযরত আয়িশার, হুজরার মধ্যে রাসূল (সা.) এঁর পাশে একটু পায়ের দিকে সরিয়ে তাকে দাফন করা হয়। হযরত আয়িশার হুজরায় পতিত এটা হলো দ্বিতীয় চাঁদ। এত অল্পবয়সে স্বামী হারানো মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি পিতাকে হারালেন।
ব্যক্তিগত জীবনে হযরত আয়িশা (রা.) ছিলেন দানের ক্ষেত্রে খুবই দরাজহস্ত। অন্তরটাও ছিল অতি উদার ও প্রশস্ত। বোন হযরত আসমাও (রা.) ছিলেন খুবই দানশীল। দুই বোনের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য দানশীলতা। আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা.) বলেন, তাঁদের দুইজনের চেয়ে বড় দানশীল ব্যক্তি আর কাউকে দেখিনি। তবে দুইজনের মধ্যে পার্থক্য এই ছিল যে, হযরত আয়িশা (রা.) অল্প অল্প করে জমা করতেন। যখন কিছু জমা হয়ে যেত, তখন সব এক সঙ্গে বিলিয়ে দিতেন। আর হযরত আসমার (রা.) অবস্থা ছিল, হাতে কিছু এলে জমা করে রাখতেন না, সঙ্গে সঙ্গে বিলিয়ে দিতেন। হযরত আয়িশা (রা.) হিজরী ৫৮সনের ১৭ রমজান মোতাবেক ১৩জুন ৬৭৮খ্রিস্টাব্দে ৬৬বছর বয়সে মদিনায় ইন্তেকাল করেন।