শাবলু শাহাবউদ্দিন :
বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেশটি স্বাধীন করা হয়েছে। কেউ লোভে পড়ে যুদ্ধে যায় নাই। যারা যুদ্ধে গিয়ে ছিল তাদের একটাই দাবী ছিলো, দেশ শত্রু মুক্ত করতে হবে । দেশ কী সত্যি শত্রু মুক্ত হয়েছে? হয় তো বা দৃশ্যমান শত্রু মুক্ত হয়েছে কিন্তু অদৃশ্যমান শত্রু মুক্ত করবে কে ?
যারা যুদ্ধে গিয়ে ছিল তাদের একটাই দাবী ছিলো পাকিস্তান হঠাতে হবে, বাংলা বাঁচাতে হবে, শত্রু মুক্ত দেশ গড়তে হবে। সবার মাঝে সমতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত দেশ গড়তে হবে। ন্যায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জহির রায়হানের একটি গল্প আছে “সময়ের প্রয়োজনে”। এই গল্পে কোন এক মুক্তিযোদ্ধা বলেছিল, সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধে এসেছি । হয় তো কোন কোন বীর যোদ্ধা সময়ের দাবিতে যুদ্ধে গিয়ে ছিল । শহীদ জননী জাহানারা ইমামের “একাত্তরের দিনগুলি” , এ কে খন্দকারের “একাত্তরের ভেতরে বাইরে”, আবুল মনসুর আহমদের “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” অথবা আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রুটি আওরাত’ , হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ , সৈয়দ শামসুল হকের ‘ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ‘ আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কলিমদ্দি দফাদার’ এছাড়া ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধরী স্যারের ” বাংলাদেশের ইতিহাস ” গ্রন্থগুলি পড়লে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক চিত্র বুঝতে পারা যায় ।
গ্রন্থগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর রচিত । লেখকগণ প্রত্যক্ষ চোখে স্বাধীনতা দেখেছেন । আবার অনেক লেখক স্বয়ং নিজে স্বাধীনতা যুদ্ধের ময়দানে সশরীরে অংশ গ্রহণ করেছেন । কোন কোন লেখক বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে নানা ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন । তাঁদের কলমে উঠে এসেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র । সেই চিত্র কেউ কি অস্বীকার করতে পারে ? নিশ্চয় পারে না ।
তবে বর্তমানে এসে কেন এত অস্বীকার, কেন সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এত তামাশা । কখনো কখনো দেখা যাচ্ছে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের নাম রাজাকারের তালিকায় । আবার কখনো কখনো দেখা যাচ্ছে রাজাকারদের নাম মুক্তিযুদ্ধাদের তালিকায় । তবে এটা হওয়া অনেক সময় স্বাভাবিক, যদি কলিমদ্দি দফাদারদের মত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে থাকে। তবে সবাই তো কলিমদ্দি দফাদারদের মত কৌশলে যুদ্ধ করে নাই । যারা সশরীরে যুদ্ধ করেছেন তাদের নাম কেন রাজাকারের তালিকায় ? ১৯৭১ সালে অনেক দেশ প্রেমিক ছিলো যারা দিনের আলোতে রাজাকার কিন্তু রাতের অন্ধকারে দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা । রাইফেল রুটি আওরাত গ্রন্থে একজনকে দেখা যায় বিকেলে রাজাকার কমান্ডারের বাসায় বসে একজন রাজাকার মুক্তিযুদ্ধাদের নামে নানা গালিগালাজ করছে । সশরীরে মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী ঐ বাড়ির আঙিনায় । কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেই রাজাকার হাজার মুক্তিযুদ্ধা ত্রাণকর্তা । কীসের লোভে ঐ সকল মানুষ গোপনে যুদ্ধে নেমেছে, কৌশলে যুদ্ধ করেছে, বীর বাঙালি সন্তানদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে, আজ কেউ বলতে পারবেন ? তাঁরা কেন এমন মহৎ কাজ করেছে অদৃশ্য হাতে? নিশ্চয়ই বলতে পারবেন না। আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর কিংবা একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থে দেখা যায় রাজাকারের গাড়িতে নব জোয়ান বীর মুক্তিযোদ্ধা । বলতে পারবেন কীসের জন্য ঐ রাজাকার এমন সাহায্য সহযোগিতা করেছিল? নিশ্চয়ই বলতে পারবেন না । হ্যাঁ ঐটাই ছিলো দেশ প্রেম। এরা ছিল রাজাকার কিন্তু দেশ প্রেমিক রাজাকার। তবে হ্যাঁ তখনও হাজার হাজার হারাম জাদা ছিল যারা প্রকৃত রাজাকার ছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে নানা রকম বাধা সৃষ্টি করেছে । কখনো কখনো দেখা গেছে পাক হানাদারদের চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে ঐ সকল রাজাকার, আল বদর , আল শামস।
কেউ প্রকাশ্যে যুদ্ধ করেছে, কেউ গোপনে, কেউ ছদ্মবেশে । কেউ যুদ্ধের সময় দেশ ত্যাগ করেছে। বহির্বিশ্বে জনমত যোগাড় করেছে । তাঁরা কিন্তু যুদ্ধ করে নাই । তবে দেশের কল্যাণে নানা ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে । বলতে পারবেন কেন করেছে? নিশ্চয় পারবেন না? আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন তার সন্তান যখন যুদ্ধে যেতে চায় তখন তাঁর স্ত্রী বাঁধা দেয়, তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । তাঁরা কিন্তু বিদেশে গিয়ে চুপ ছিলেন না । প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছেন । কেন করেছে বলতে পারবেন? নিশ্চয়ই আমরা আজ বলতে পারব না ।
যারা দেশকে ভালোবেসে যুদ্ধ করলো তাদের কে নিয়ে কেন এত তামাশা? কেউ বলতে পারে না । মুক্তিযুদ্ধের বিরোধে সাম্প্রতিক কালে প্রকাশ্যে শ্লোগান দিয়ে নুরু এবং তাদের সহযোগীরা আজ যুবসমাজের এবং ছাত্র সমাজের আইকন হয়েছে । রাজনৈতিক সংগঠন গড়েছেন । দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছে । মুক্তিযুদ্ধের নিয়ে এ কেমন তামাশা করেছে বাংলার এই যুব সমাজ ? এর জন্য দায়ী কারা ? আমি মনে করি এর জন্য দায়ী সচেতন নাগরিক সমাজ । আবার আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ নামে সংগঠন খুলে কখনো আলোচনায় আবার কখনো কখনো ব্যাপক সমালোচনায় আসে । মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি নাতনিদের কোটা ব্যবস্থা । যেটা চরম হারে অপমানে বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞদের মত । কোটা পদ্ধতি উঠে দেওয়ার জন্য সারা বাংলাদেশ প্রায় চারদিন বন্ধ করে রেখেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা । এটা কত বড় অপমানের এটা কী কখনও আমরা বুঝতে পারি ? সরকার একবার কোটা দিল আবার সেই কোটা ব্যবস্থা উঠিয়ে নিল। এ কোন ধরনের প্রহসন ভাবতে পারেন? সেই কোটা ব্যবস্থা আবার চালু করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি নাতনিরা আন্দোলন করে । এটাই কী কম অপমান জনক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ? একবার চিন্তা করে দেখুন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক শ্রেণীর লোক দেশ ত্যাগ করেছিলেন । তাঁদের চিন্তা ছিল দেশ শান্ত হলে দেশে ফিরে আসবে । দেশ শান্ত না হলে আসবে না । এই পলাতক সুবিধাবাদী শ্রেণী আজ কেমনে বীর মুক্তিযুদ্ধা হয়? জাতির কাছে সচেতন মনে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায় ।
মুক্তিযোদ্ধা শব্দের আগে কখনো ভুয়া শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে । এটা কোন ধরনের অপব্যবহার করা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা শব্দের? একবার ভেবে দেখুন ? সাম্প্রতিক কালে পুলিশ, ম্যাজিসেট্রট এবং ডাক্তারের উত্তেজনামুলক ভিডিও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় , সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি নানা ভাবে অপব্যবহার হচ্ছে যুবসমাজের মাঝে ।
দেশকে তাঁরা স্বাধীন করেছে বিনা স্বার্থে। সেই স্বার্থহীন মানুষগুলো আজ কেন এত অদৃশ্য অপমানের সম্মুখীন হবে ? বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষার্থে মুক্তিযোদ্ধা শব্দটির অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সকল নাগরিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আমরা সচেতন হই। বীর সন্তানদের সম্মান রক্ষার্থে মুক্তিযোদ্ধা শব্দের অপব্যবহার বন্ধ করি।