কাজিরবাজার ডেস্ক :
উনিশ শ’ একাত্তর সালে বিশ্ব মানচিত্রে যে নতুন একটি দেশের অভ্যুদয় হয়েছিল সেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রক্তের। সেই রক্তের টানেই বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুই দিনের সফরে শুক্রবার সকালে তিনি ঢাকায় আসছেন। জন্মের ৫০ বছরের সঙ্গে সঙ্গে ভারত বাংলাদেশের সেই রক্তের সম্পর্কেরও ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। একইসঙ্গে বাংলাদেশ উদযাপন করছে এ দেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এসব অনুষ্ঠানে যোগদানসহ দুই দেশের সম্পর্ককে আরও নতুন মাত্রায় উন্নীত করতে মহামারী করোনা ভীতি উপেক্ষা করতে নরেন্দ্র মোদি আসছেন বাংলাদেশে। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ একটু বেশি আবেগপ্রবণ। তাইতো ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে লাল গালিচা নিয়ে প্রস্তুত বাংলাদেশ।
দুই দিনের এই সফরে কোন চুক্তি না হলেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প উদ্বোধন ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। উপহার হিসেবে অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার ১২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে আসছেন মোদি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন ২৬ মার্চ সকালে তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করবেন। তাকে ফুলের সম্ভাষণে বরণ করে নেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেয়া হবে জাঁকজমকপূর্ণ লাল গালিচা সংবর্ধনা।
বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নরেন্দ্র মোদি সরাসরি যাবেন সাভার স্মৃতিসৌধে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। সেখান থেকে এসে তিনি যাবেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। এখানে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। পরবর্তীতে তিনি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর পরিদর্শন করবেন।
পরিদর্শন শেষে তিনি ফিরে আসবেন সোনারগাঁও হোটেলে। ঢাকায় অবস্থানকালে এই হোটেলেই তিনি দুই দিন অবস্থান করবেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন দুপুরে এই হোটেলে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করবেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিকেলে যোগ দিবেন সেই ঐতিহাসিক বাংলাদেশের ৫০তম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে। তিনি সম্মানিত অতিথি হিসেবে প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের ওপর বক্তৃতা করবেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
সন্ধ্যায় নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে উদ্বোধন করবেন বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল মিউজিয়ামের। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুবিবুর রহমান ও ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও কর্মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে এই যাদুঘরটিতে। রাত ৮টা ১০ মিনিটে এই যৌথ যাদুঘরটির উদ্বোধন করা হবে। দুই দেশের জাতির পিতাকে যৌথভাবে তুলে ধরার এবং মর্যাদা দেয়ার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্ব বহন করে। রাতে সেখানেই তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া নৈশভোজে যোগ দেবেন।
পরদিন সকালে নরেন্দ্র মোদি যাবে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। সেখানে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্স পরিদর্শন করবেন। সেখান থেকে তিনি যাবেন পার্শ¦বর্তী উপজেলা কাশিয়ানিতে। ওখানে তিনি ওড়াকান্দি মন্দির পরিদর্শন করবেন। এই মন্দির পরিদর্শন শেষে তিনি যাবেন পার্শ¦বর্তী সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরে। সেখানে তিনি জেশরেশ্বরী দেবি মন্দির পরিদর্শন করবেন এবং প্রার্থনায় অংশ নেবেন।
বিকেলে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে যোগ দেবেন। এই বৈঠকেই দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে এবং কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন।
আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের ব্যাপারে সহযোগিতা, পরিবেশগত সুরক্ষায় সহযোগিতা এবং দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতাসহ কয়েকটি এমওইউ সই করার কথা আছে।
সন্ধ্যার পর নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাত করবেন এবং নৈশভোজে যোগ দেবেন। নৈশভোজ শেষে রাতেই তিনি দিল্লী ফিরে যাবেন।
সফরকালে ঢাকা ও নিউ জলপাইগুড়ির মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধন করা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে এ ট্রেন সার্ভিসের উদ্বোধন করবেন। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন সামনে থাকায় সেখানকার নির্বাচন কমিশন ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধনে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় শুধু বাংলাদেশ অংশে চালানোর মাধ্যমে ট্রেন সার্ভিসের উদ্বোধন হবে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর এবং কোভিড-১৯ মহামারী কমলে দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত নতুন এই ট্রেন সার্ভিস চলাচল করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে ঢাকা-কলকাতা এবং খুলনা-কলকাতার মধ্যে যাত্রীবাহী এবং বাংলাদেশের রোহনপুর এবং ভারতের সিঙ্গাবাদের মধ্যে মালবাহী ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির সফরকালে ঢাকা ও দিল্লীর মধ্যে একটি যৌথ ঘোষণা বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। এতে দুই দেশের সম্পর্কের আগামীর রূপরেখা থাকবে।
গত এক দশকে ঢাকা-দিল্লীর সম্পর্ক যেকোন সময়ের তুলনায় উষ্ণ এবং নিঃসন্দেহে এই সম্পর্ক বিশেষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সহযোগিতা বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী কোন শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দিচ্ছে না। ট্রানজিট আর ট্রান্সশিপমেন্টের বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ দ্রুত সাড়া দিয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণ হয়েছে। সর্বশেষ কলকাতা বন্দর দিয়ে পণ্য আনার ১৬০০ কিলোমিটারের দূরত্ব কমিয়ে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আনার জন্য গত ৯ মার্চ বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমকে সংযোগকারী মৈত্রী সেতু চালু করেছে। এই সেতুর মাধ্যমে ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্ব সাতটি রাজ্যের জন্য যোগাযোগের হাব হিসেবে কাজ করবে।
দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যার মধ্যে স্থল ও সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হলেও আকাশসীমা চিহ্নিতকরণ বাকি রয়েছে এখনও। আর বারবার প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামায়নি ভারত। প্রায় ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও তিস্তা চুক্তি সই হয়নি মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে। বর্তমানে দুই দেশের নেতারা বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ককে ‘সোনালী অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করলেও নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতীয় পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাসসহ বেশকিছু পদক্ষেপ এই সম্পর্ককে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
তবে মোদি যদি বাংলাদেশের সঙ্গে এই সম্পর্ককে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যেতে চান, তাহলে তার উচিত হবে আগামী দিনগুলোতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও জোরদারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ‘কমপ্রিহেনসিভ ট্রেড এ্যাগ্রিমেন্ট’ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা, যার মাধ্যমে দুটি দেশ করোনা পরিস্থিতিতে উইন-উইন পরিস্থিতি তৈরি করে এগিয়ে যেতে পারে। যেখানে সেভেন সিস্টারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের বিশেষ সুযোগ রাখা যেতে পারে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সামান্য মাত্রায় বাড়লেও ব্যবধান এখনও বিস্তর। পাশাপাশি পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে বাধা দেয়াসহ ভারত যত নন-ট্যারিফ বাধা দিচ্ছে তা দূর করা। সবচেয়ে বড় বিষয় লোক দেখানো নয়, বাস্তবে এ সম্পর্ককে এই অঞ্চলের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা। তার জন্য প্রয়োজন পরস্পরের আস্থা অর্জন, একে অন্যের আত্মমর্যাদাকে গুরুত্ব দেয়া।