কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রথম ধাপে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত এ তালিকায় রয়েছে এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম। বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ তালিকা প্রকাশ করেন।
তালিকাটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাসাইটে পাওয়া যাবে বলে জানান মন্ত্রী।
প্রথম ধাপে প্রকাশিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতা রয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী জানান, এছাড়া বরিশাল বিভাগের ১২ হাজার ৫৬৩ জন, চট্টরাম বিভাগের ৩০ হাজার ৫৩ জন, ঢাকা বিভাগের ৩৭ হাজার ৩৮৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগের ১০ হাজার ৫৮৮ জন, খুলনা বিভাগের ১৭ হাজার ৬৩০ জন, রাজশাহী বিভাগের ১৩ হাজার ৮৮৯ জন, রংপুর বিভাগের ১৫ হাজার ১৫৮ জন এবং সিলেট বিভাগের ১০ হাজার ২৬৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম চূড়ান্ত তালিকায় প্রকাশ করা হয়।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় তৃণমূল থেকে তদন্তের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্তকরণের কাজ করছি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকার প্রথম পর্যায় আজ প্রকাশ করা হলো। যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই তাদের প্রথম ধাপে স্বীকৃতি দেয়া হলো।’
৩০ এপ্রিলের মধ্যে গেজেটধারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে জানিয়ে মোজাম্মেল বলেন, ‘সবকিছু যাচাই-বাছাই শেষে সবশেষ তালিকা ৩০ জুনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য কেউ কোনো আবেদন করতে পারবেন না, এখন শুধু আপিল করা হবে এরপর রিভিউ হবে।’
সব মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা এক লাখ ৭০ হাজার পার হবে না বলে আশা করছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এটাই মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা, আগের তালিকা বাতিল হয়ে যাবে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর তাদের সনদ ও আইডি কার্ড দেয়া হবে।’
ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) এক লাখ ৮২ হাজার ৮৩৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম যুক্ত করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রায় ৩৫ হাজার জনের বেসামরিক গেজেটে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অনুমোদন না থাকায় তাদের এই তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে এসব গেজেট নিয়মিতকরণের লক্ষ্যে আমরা ৪৩৪ উপজেলার প্রতিবেদন পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই এবং আপিল শুনানি শেষে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে যাচাই-বাছাইধীন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের চূড়ান্ত তালিকায় প্রকাশ করা হবে।’
যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নিচ্ছেন তাদের মধ্য থেকে কেউ যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়লে কী হবে- এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘যারা প্রতারণা করে সনদ নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন হবে, এটা নিশ্চিত। আর যাদের কিছু বেসিক ছিল, জালিয়াতি না করেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন সময় বিবেচিত হয়েছিলেন, তাদেরটা অন্য দৃষ্টিতে দেখব।’
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ৫০ বছরের মধ্যে ৩০ বছরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করেছে। রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসিত করেছে এবং অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম তালিকায় আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘একাত্তর সালে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা মুক্তিযোদ্ধা, কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তার অপকর্ম, চেতনাবিরোধী কাজ করেছেন, জাতির পিতাকে হত্যা করেছেন, এজন্য যেটুকু বাতিল করা দরকার সেটুকু করেছি। তবে তার নামের পাশে এসব লেখা থাকবে।’
খন্দকার মোশতাকের নামও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় রয়েছে জানিয়ে মোজাম্মেল বলেন, ‘খন্দকার মোশতাক মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন, আদালতও সেই ক্ষমতা ও কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তার নাম (মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়) থাকবে সঙ্গে তার কর্মও অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর খুনি হিসেবে অভিযুক্ত ছিলেন, চার্জশিট হয়েছে, বিচার হয়নি, মৃত্যুবরণ করেছেন- নামের পাশে এগুলো লেখা থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘তার (মোশতাক) খেতাব বাতিল করেছি, খেতাব দেয়া কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা, আর এটা (মুক্তিযোদ্ধ) তাদের অর্জন। মুক্তিযোদ্ধা থাকবে, তার যেসব জিনিস বাতিলযোগ্য সেগুলো আমরা বাতিল করেছি। খেতাব হচ্ছে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা। এটা যে কর্তৃপক্ষ দেয় তারা তা প্রত্যাহার করে নিতে পারে। কিন্তু তিনি যেটা করেছেন সেটাও সত্য, পরেরটাও সত্য।’
মুক্তিযোদ্ধার নতুন তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ফের তা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে কি-না জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দুঃখিত, সেনাবাহিনীর তালিকা করার কোনো সুযোগই নেই, কারণ তারা জানেই না কারা যুদ্ধ করেছিল। তারা তো ছিল ফ্রন্টে।’
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ কারা করেছে জানে দেশের মানুষ। রামের জনগণ, সিভিল সোসাইটি নিয়ে (যাচাই) করবেন কি-না, বয়স্ক সিনিয়র সিটিজেনদের নিয়ে করবেন কি-না। কারণ সে জানে তার রামের, ইউনিয়নের বা পাশের রামের কে যুদ্ধ করেছে। সেনাবাহিনী ছিল যুদ্ধে ফ্রন্টে, তাদের জানার কোনো সুযোগ নেই। তারা সত্যবাদী লোক অন্যরা সব মিথ্যাবাদী লোক এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।’
‘বরং, আমি একটা জিনিস জোরালোভাবে বলতে চাই, সেনাবাহিনী যে গেজেট করেছে, সেটা বিতর্কিত গেজেট। সেনাবাহিনীর অধিকার হচ্ছে তাদের ইউনিট থেকে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের গেজেট করার। যেকোনো বাহিনী সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, আনসার, ইপিআর তাদের বাহিনীর সদস্য হিসেবে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের তালিকা করার দায়িত্ব তাদের। দৈনন্দিন কাজের রেকর্ড তাদের কাছে থাকে। তারা সেটা করবে।’
রাজাকারের তালিকা কবে হবে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা করার বৈধ কোনো এখতিয়ার কোনো কর্তৃপক্ষের ছিল না, জামুকার সেই অধিকার ছিল না। কিছুদিন আগে রাজাকারের তালিকা করতে আইন সংশোধন করা হয়েছে, এটা সংসদে উঠবে, এই আইন পাস হলে জামুকা রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন করবে।’
মমসংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক মো. জহুরুল ইসলাম রোহেল উপস্থিত ছিলেন।