শেখ একেএম জাকারিয়া
দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান আনন্দনুষ্ঠান। এ আনন্দনুষ্ঠানে সবাই আমোদ-প্রমোদে মেতে ওঠে। বাংলার পাড়ায় পাড়ায় আনন্দধারা বইতে থাকে। পূজোর কালে প্রতিটি হিন্দু বাঙালি-ই সাধ্যানুসারে দোকান থেকে পোশাক পরিচ্ছদ ও কসমেটিকস ক্রয় করে থাকেন। এ কারণে দুর্গা পূজোর প্রায় এক-দেড়মাস পূর্ব থেকেই পোশাক পরিচ্ছদের দোকানে ভিড় ভাট্টা লেগে থাকে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে আমাদের দেশে সাধারণত একমাস স্কুল-কলেজ ছুটি থাকে। অফিস আদালতও এ সময় এক-দু’দিন ছুটি থাকে। তাছাড়া যাঁরা দূরে বা বিদেশে থেকে চাকরি কিংবা লেখাপড়া করে থাকেন, তাঁরা পূজো উদযাপন করতে এ সময় নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। আমাদের দেশে সাধারণত শরৎ ও বসন্তকালে অর্থাৎ বছরে মোট দুবার দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়। শরৎকালের পূজাকে শারদীয় পূজা আর বসন্তকালের পূজাকে বাসন্তী পূজা বলে অভিহিত করা হয়। এ সময়ে শারদীয় পূজার-ই চলন বেশি। তবে এবার-ই নিয়মের অন্যথা হয়েছে। শরতের আশ্বিনে নয় দুর্গা পূজো, হেমন্তের কার্তিকে শুরু। দুর্গা পূজোর বর্ণনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, দুর্গা তাঁর বাহন সিংহের ওপর দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁর বাঁদিকে বীণা হাতে তাঁর এক কন্যা সরস্বতী, ডানদিকে অন্য এক কন্যা লক্ষ্মী। সরস্বতীর বাঁদিকে তীরধনুক হাতে এক পুত্র কার্তিক আর লক্ষ্মীর ডানদিকে আর-এক পুত্র হস্তীমুখ গণেশকে দেখা যায়। এছাড়া দেবী দুর্গার পায়ের কাছে, দুর্গা নিজ হাতে মহিষাসুরকে বধ করছেন এমন চিত্র দেখা যায়।
বাংলাদেশে সাধারণত পূজার দিনে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে স্নান করে পুজোর জন্য ফুল, বেলপাতা, তুলসী, দূর্বাসহ পুষ্পপত্র সাজিয়ে দেবী দুর্গার দুয়ারে গমন করেন। সবার আগে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে ঘট বসিয়ে দুর্গাপূজার সূত্রপাত করা হয় ও একেই বলে বোধন। এদিনে দেবীর হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়, দেবীকে মণ্ডপে আহ্বান জানানো হয়, নানা রকম গয়না দ্বারা সজ্জিত করা হয়। অতঃপর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী এই চারদিন ধরে মহাসমারোহ পূজা উদযাপিত হয়। সপ্তমীতে দেবীর চক্ষুদান দিয়ে পূজা শুরু হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, দেবী এদিনে চোখ মেলে নতুনভাবে ভক্তবৃন্দকে দেখেন। তাই ভক্তরা অধীর আগ্রহে দেবীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অষ্টমীতে অঞ্জলি দেওয়া ও কুমারী পূজা করা হয়। এই দিন সন্ধ্যায় মানবকল্যাণে সন্ধ্যা আরতি করা হয়। এসময়ে ধূপের মাতাল গন্ধ যেন চৈতন্য হারিয়ে দেয়। ঢাকের তালে দু’হাতে ধুনচি নিয়ে মঙ্গল আরতিতে মেতে ওঠে সবাই। অষ্টমী আর নবমীর সন্ধিক্ষণে হয় সন্ধিপূজা। এ সময়ে মাটির ঢেলা দিয়ে মণ্ড বানিয়ে তৈরি করা হয় ১০৮টি প্রদীপ। বাহারি রকমের ফল কেনা হয় সেদিন। সন্ধ্যায় মণ্ডপে মণ্ডপে চলে দেবী দর্শন। দশমীর রাতে প্রতিমাকে অর্থাৎ মাটি দিয়ে গড়া দেবমূর্তিকে নদী বা সাগরজলে বিসর্জন দেওয়া হয়। অবশ্য দেবী বিসর্জনের আগে দশমীতে দেবীবরণ চলে, সবাই মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। আবির আর সিঁদুরে রাঙা হয় ভক্তদের ললাট, কপোল ও জামাকাপড়। মিঠা মুখে, ধুনচি হাতে, ঢাকের তালে তালে, জলে নিমজ্জিত হয় দেবী প্রতিমা। অশ্রুসিক্ত হয় ভক্তবৃন্দের চোখ। তবে তারা আশায় বুক বাঁধনে দেবী বছর ঘুরে আবার আসবেন। দেবী দুর্গার অপেক্ষায়, আর তাঁর মেয়ে দেবী লক্ষ্মীর আগমনী বার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আয়োজনে। আনন্দে মেতে উঠবে সবাই। আশীর্বাদপুষ্ট হবে মানবজীবন। এত কিছুর পরেও মানবমনে একটা হাহাকার ওঠে। দেবী দুর্গাকে তাঁর ভক্তরা বলতে থাকে
“হে সকলের কল্যাণকারিণী, কৈশোরের আমোদ-প্রমোদ, বাবার হাত ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানো, মা-দিদি-দিদার সঙ্গে জোছনারাতে শিউলি ফুল তোলা ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও মায়ের হাতের নাড়ু-সন্দেশ খাওয়া আর পুজোর দিনে বাড়িতে থেকে পূজো উদযাপন করা, সুস্থিরতার অমৃতধারা বর্ষণ করো মানুষের জীবনে।”
দেবী বিসর্জন শেষে ছোটোরা বড়োদের-ভূমিতে বা পায়ের উপর আনত হয়ে অভিবাদন জানায়। যাকে প্রণাম বলা হয়। আর বড়োরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করেন, একে অন্যকে মিষ্টি খাওয়ান। অতঃপর পূজোর ছুটি শেষ হতে না হতেই লেখাপড়ায় মন দিতে হয় শিশুকিশোর ও যুবকদের। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুললেই পরীক্ষার ঘণ্টা বেজে ওঠে। অন্যদিকে বড়োদের অর্থাৎ কর্মজীবীদের ফিরে যেতে হয় নিজ নিজ কর্মস্থলে।