ভার্চুয়ালি জিসিএ বাংলাদেশ অফিস যৌথভাবে উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বান কি মুন ॥ দক্ষিণ এশিয়াকে দুর্যোগে টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়াতে হবে

7
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশে বৈশ্বিক অভিযোজন কেন্দ্রের (গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন-জিসিএ) আঞ্চলিক কার্যালয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকার কথা তুলে ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের চক্র থেকে এ অঞ্চলের মানুষকে বের করে আনতে অভিযোজনের আঞ্চলিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। একইসঙ্গে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন এবং জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান বাড়াতে সেসব দেশের প্রতি আহ্বান জানান। মঙ্গলবার বিকেলে গণভবন থেকে বাংলাদেশে বৈশ্বিক অভিযোজন কেন্দ্রের (গ্লোবাল সেন্টার অন এ্যাডাপটেশন-জিসিএ) আঞ্চলিক কার্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। ভার্চুয়ালি যৌথভাবে জিসিএ বাংলাদেশের আঞ্চলিক অফিস উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও জিসিএ বোর্ডের সভাপতি বান কি মুন।
ভার্চুয়াল এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, ভূমিধস, হিমবাহে ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে দক্ষিণ এশিয়া। এমনকি তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস (প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায়) বাড়লেও বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। দুর্যোগে শিশু, নারী, বয়স্ক এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের ঝুঁকির বিষয়টিও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্ধেক জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ প্রায় ৭০ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ অঞ্চলের মানুষ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটি এসে আঘাত হানে, ফলে যে কোন অগ্রগতি উল্টে যায়। এই চক্র ভাঙ্গতে দক্ষিণ এশিয়াকে দুর্যোগে টিকে থাকার সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক ব্যাপার। তাই প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন এবং জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানগুলো বাড়ানোর আহ্বান জানাই।
প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন, গ্রিন হাউস গ্যাসের কারণে বাড়তে থাকা তাপমাত্রা এবং অন্যান্য পরিবেশগত ক্ষতি রোধে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের সরকার ২০০৯ সালের বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি এ্যান্ড এ্যাকশন প্ল্যানের আওতায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে নানা পদক্ষেপ এবং অভিযোজন কর্মসূচী নিয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমরা জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল প্রতিষ্ঠা করেছি এবং কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এ পর্যন্ত ৪৩ কোটি ডলার নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দিয়েছি। অভিযোজন বিষয়ক কর্মকা-ে সরকার ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর জিডিপির এক শতাংশ, অর্থাৎ ২০০ কোটি ডলার করে ব্যয় করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ শীর্ষক শতবছরের পরিকল্পনা গ্রহণের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জিসিএর বাংলাদেশ কার্যালয় দক্ষিণ এশিয়ার অভিযোজন এবং জলবায়ু সহিষ্ণুতা অর্জনে সহায়তা করবে বলেও আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, এই কার্যালয়ের মাধ্যমে অভিযোজন বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা এবং কর্মসূচী বিনিময় হবে। এ অঞ্চলের অভিযোজন বিষয়ক সমস্যা সমাধান এবং সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে কাজ করবে এই কার্যালয়।’
ইউএনএফসিসিসি’র জলবায়ু বিষয়ক দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম’ এবং ‘ভালনারেবল-২০’ এর সভাপতি পদে বাংলাদেশের প্রার্থিতায় জিসিএর ঢাকা কার্যালয় সমর্থন দেবে বলেও আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ‘অনন্য নজির’ স্থাপন করেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় এখানকার জনগণ বারবার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। তারপরও পরিবর্তন করার মতো এখনও অনেক কিছু আছে। আমি মনে করি, এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশেরও অভিযোজন বিষয়ে একই ধরনের অভিজ্ঞতা এবং কর্মসূচী রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা একসঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা এবং উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারব।
জলবায়ু পরিবর্তন যেহেতু একটি বৈশ্বিক সমস্যা, তাই এর ঝুঁকি কমাতে এবং ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন দেশের প্রতিশ্রুত জাতীয় সহায়তা বৃদ্ধির আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। কোভিড-১৯ মহামারী সব দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং একসঙ্গে কাজ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের সঙ্কট মোকাবেলায় আমাদের একে অপরকে ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়।
মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশে কার্যালয় চালু করতে সহযোগিতা করায় জিসিএর সভাপতি ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিসিএর বাংলাদেশ কার্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। জিসিএ আঞ্চলিক কেন্দ্রটি ঢাকার আগারগাঁওয়ে পরিবেশ অধিদফতরের নতুন ভবনে অবস্থিত। ঢাকায় আঞ্চলিক অভিযোজন কেন্দ্রের (জিসিএ) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে উৎসর্গ করা হয়েছে।
ডাচ (নেদারল্যান্ড) প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট ভার্চুয়ালি এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং জিসিএ’র সিইও প্রফেসর ড. প্যাট্রিক ভেক্রোজেইন স্বাগত বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, ভুটান ও মালদ্বীপের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ শ্রেষ্ঠ শিক্ষক- বান কি মুন : জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের অষ্টম সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন। মঙ্গলবার গ্লোবাল সেন্টার অন এ্যাডাপ্টেশন (জিসিএ) বাংলাদেশ আঞ্চলিক কেন্দ্র উদ্বোধনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতিসংঘের অষ্টম সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন ঢাকায় স্থাপিত গ্লোবাল সেন্টার অন এ্যাডাপ্টেশন (জিসিএ) বাংলাদেশ আঞ্চলিক কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের ৮ম সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, জিসিএ সিইও প্যাট্রিক ভেক্রোজেইন প্রমুখ।
বান কি মুন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় গ্লোবাল সেন্টার অন এ্যাডাপ্টেশন কাজ করবে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অভিযোজনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। সে কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই জিসিএ অফিস খোলা হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আরও এগিয়ে যাবে। আর আমি এ বিষয়ে খুবই আশাবাদী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতাও বাড়ছে। যে কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে প্রাণহানির সংখ্যা এখন খুবই কম। বাংলাদেশে জিসিএ অফিস খোলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন হিসেবে কাজ করবে।