কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জিয়াউর রহমান, তার স্ত্রী ও ছেলের হাতে মানুষের রক্তের দাগ। ইনডেমনিটি দিয়ে জিয়া যেমন বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার না করে পুরস্কৃত করেছিলেন, ঠিক একইভাবে খালেদা জিয়াও ক্লিন হার্ট অপারেশনের নামে মানুষ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের ইনডেমনিটি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। এরা দেশে খুনের রাজত্ব তৈরি করেছিলেন, আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশের মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। এদের হাতে মানুষের রক্তের দাগ। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে যা যা করার তার সবই করে গেছেন জিয়াউর রহমান।
শোকাবহ আগষ্টের মাসব্যাপী কর্মসূচীর সমাপনী দিনে সোমবার স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মরণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এদের (জিয়া-খালেদা জিয়া) তো কোন শিক্ষাদীক্ষা নেই। সে কারণে ক্ষমতাকে তারা ভোগের বস্তু হিসেবে দেখেন। সে কারণে ক্ষমতায় থাকতে, ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে খুন করতে তারা কোন দ্বিধাবোধ করেননি। কিন্তু আমরা সেটা করি না, আমরা ক্ষমতাকে দায়িত্ব হিসেবে মনে করি।
তিনি বলেন, কোন আত্মত্যাগই কখনও বৃথা যায় না। ত্যাগের মধ্যেই শান্তি, ভোগের মধ্যে নয়। একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে দেশপ্রেম ও ত্যাগের আদর্শ না থাকলে তারা দেশকে কিছু দিতে পারেন না। কী পেলাম বা পেলাম না সেটা বড় কথা নয়, মানুষের জন্য কী করে যেতে পারলাম সেটাই বড় কথা। দেশের মানুষ অবশ্যই তা একদিন মূল্যায়ন করবেন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষকে উন্নত জীবন দিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন, শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনটাও দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন দেশের মানুষ সুন্দর জীবন উপহার দেয়া- সেটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। দেশের কোন মানুষ গৃহহারা থাকবে না, প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা বিদ্যুৎ পৌঁছে দেব। আমরা ক্ষমতায় এসে প্রতিশোধ নিতে যাইনি, দেশের উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছি। মিথ্যার পরিবর্তে আজ সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে। তিনি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে দলের চলমান বৃক্ষরোপণ অভিযান অব্যাহত রাখার জন্যও তিনি ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় আলোচনায় সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমানসহ ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের নিয়মিত প্রকাশনা ‘মাতৃভূমি’র মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরাবতা পালন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি যতই গলাবাজি করুক, সত্যকে অস্বীকার করবে কীভাবে? বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী কর্নেল ফারুক-রশিদরা বিবিসিতে নিজেরাই সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছে যে, এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে (বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড) জিয়া তাদের সঙ্গে ছিল। আর এ কারণেই অবৈধভাবে খুনী মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করে। কিন্তু বেইমান-মীরজাফররা বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না, মোশতাকও পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী এই জিয়া সেনাবাহিনীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা অফিসার-সৈনিকদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ছাত্রদের হাতে অস্ত্র-অর্থ তুলে দিয়ে বিপথে নিয়ে গেছে এবং হজের জন্য বঙ্গবন্ধুর কেনা হিযবুল বাহার জাহাজকে প্রমোদতরী বানিয়ে এই জিয়া ছাত্রদের চরিত্রকে ধ্বংস করেছে। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে যা যা করার তার সবই করে গেছে এই জিয়াউর রহমান। আর স্ত্রী খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় এসে বলেছিল আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করতে নাকি তার ছাত্রদলই যথেষ্ট।
বাংলাদেশে গুম-খুনের রাজনীতি জিয়াউর রহমানই শুরু করেছে মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, অবৈধ ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে পুরো দেশকেই রক্তাক্ত করেছে এই জিয়া। ১৮-১৯টি ক্যু’র ঘটনায় হাজার হাজার সেনা অফিসার-সৈনিককে হত্যা করেছে এই জিয়া। এটাই নাকি তার গণতন্ত্র! এদেশে গুম-খুনের শুরু করেছে এই জিয়াই। অনেক সেনা পরিবার জিয়ার আমলে লাশটুকুও ফেরত পাননি। ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে শত শত মানুষকে হত্যা করে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকেও হত্যা করে তাদের লাশ গুম করে ফেলা হয় ওই সময়ে।
ভোট দিয়ে দেশ সেবার সুযোগ প্রদানের জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষ দেশ সেবার সুযোগ দিয়েছিল বলেই ’৭৫ সালে দেশের যে সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল, সেই সম্মান আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার করেছি, যারা জড়িত ছিল তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে নেপথ্যে যারা জড়িত, ইতিহাস থেকে তাদেরও একদিন পাওয়া যাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার করে আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ইতিহাস, ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনার ইতিহাস মুছে ফেলতে, দেশকে আদর্শহীন এবং স্বাধীনতাকে অর্থহীন করতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল।
দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতার পাশাপাশি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বিশাল অবদানের কথা তুলে ধরে তাঁদের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মায়ের মতো একজন সঙ্গী পেয়েছিলেন বলেই আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) নিবেদিত প্রাণ হয়ে দেশের জন্য লড়াই-সংগ্রামসহ কাজ করে গেছেন। এটা একটা বিরল ঘটনা। প্রতিটি ঘটনায় আমার মা পিতা বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে সঠিক পরামর্শ দিতেন, সাহস জুগিয়েছেন। কারণ দেশের মানুষের পার্লস, তারা কী চায়, কখন কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তা পর্যালোচনা করার এক অসীম ক্ষমতা ছিল আমার মায়ের।’
৬ দফা আন্দোলন, প্যারোলে মুক্তি না নেয়া এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বঙ্গমাতার অপরিসীম সাহসী অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণার পর গ্রেফতার হন। তখন আমাদের অনেক বড় নেতাই ছয় দফা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু আমার মা তাদের স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ৬ দফার একটি দাড়ি কমাও এদিক-সেদিক হবে না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়ও বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে পাকিস্তানে বৈঠকের কথা বলা হয়। তখনও অনেক নেতাও সেজেগুজে রেডি ছিলেন। কিন্তু আমাকে দিয়ে আমার মা কারাগারে একটি সিদ্ধান্ত জানাতে পাঠালেন। অনেক চেষ্টার পর বাবার সঙ্গে দেখা হলো, তাঁকে মায়ের সিদ্ধান্ত জানালাম যে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে পাকিস্তানে যাওয়া যাবে না।
ওই সময়ের ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর আমাদের অনেক নেতাই ৩২ নম্বরে এসে আমার মাকে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘এটা কী সিদ্ধান্ত নিলেন, বঙ্গবন্ধুকে তো ওরা (পাকিস্তান) মেরে ফেলবে, আপনি বিধবা হবেন।’ তখন আমার মা স্পষ্ট করে তাদের বলেন, ‘আমি একজন বিধবা হব, কিন্তু যে আরও ৩৪ জন জেলে রয়েছে তাদের কী হবে? তাই ভুল করবেন না, প্যারোলে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি নিয়ে যাবেন না। তখন আমাকেও অনেক নেতা বলেছিলেন- এমন ভুল সিদ্ধান্ত কেন নিলে? জবাবে বলেছি- প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আমার বাবা পাকিস্তানে যাবে না।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই ভাষণ দেয়ার আগেও আমাদের বাড়িতে এসে অনেক নেতা অনেক কিছু লিখে দিলেন, পরামর্শ দিতে থাকলেন এসব কথা বলতে হবে। অনেক ছাত্রনেতাও এসে বাবাকে বলতে শুনেছি এসব বলতে হবে। তখন আমার বাবা ওইসব ছাত্র নেতাদের বলেছিলেন, জনসভায় কী বলতে হবে আমি জানি। তিনি বলেন, জনসভায় যাওয়ার আগে বাবাকে আমার মা সম্পূর্ণ আলাদা করে নিয়ে গেলেন। আমিও বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম। তখন বাবাকে আমার মা বললেন- ‘এদেশের মানুষের জন্য সারাটা জীবন তুমি সংগ্রাম করেছ, তুমিই একমাত্র জানো দেশের মানুষের জন্য কী বলতে হবে। কারোর কথা শুনতে হবে না, তোমার মনে যা আসবে তাই বলবে।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা। যে ভাষণটি ’৭৫ এর বাজানো নিষিদ্ধ ছিল, ভাষণটি বাজাতে গিয়ে ওই সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে জীবন পর্যন্ত দিয়েছে। সেই ভাষণটি আজ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা দু’বোন বিদেশে থাকায় বেঁচে যাই। আমরা এক রাতে নিঃস্ব হয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ৬টি বছর আমাদের বিদেশের মাটিতে রিফিউজি হিসেবে কাটাতে হয়েছে। দেশে ফেরার পর ৩২ নম্বরে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের মাগফিরাত কামনায় সামান্য নামাজ পড়তে ঢুকতে দেয়নি এই জিয়াউর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা পড়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি করোনা মহামারীর সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মরদেহ দাফন-সৎকারসহ কৃষকদের জমির ধান কেটে তাদের বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। এটাই হলো দেশসেবা। যারা করোনার সময় হাত পাততে পারে না, ছাত্রলীগসহ আমাদের সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের বাসায় বাসায় গিয়ে ত্রাণ সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে। ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের এসব কর্মকান্ড আগামী প্রজন্মের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ভালভাবে পড়াশুনো করে উপযুক্ত হয়ে নিজেদের গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, শিক্ষিত জাতি ছাড়া কোন দেশ উন্নতি করতে পারে না। ডিসেম্বর মাসে আমরা ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা প্রণোদনা দেয়ার চিন্তা করছি, যাতে তারা নতুন ড্রেস বানাতে পারে। আর দেশের এক ইঞ্চি জায়গাও যেন অনাবাদী না থাকে সেদিকে সবার দৃষ্টি দিতে হবে। করোনার সময় দেশের মানুষকে সচেতন করতে কাজ করতে হবে। সবাইকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারাদেশে বৃক্ষরোপণ অভিযানও অব্যাহত রাখতে হবে। ইনশাল্লাহ, আমরা দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলবোই।