কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা তান্ডবের দরুন এ বছর বাংলাদেশীরা হজ্বে যেতে না পারায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এ খাত। এতে চরম দৈন্যের কবলে পড়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এ লোকসানের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে বিমান, ট্রাভেল ও হজ্ব অপারেটরগুলোতে। এ খাতের ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার অমানিশা। যা আগামী দু বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। হাব, আটাব ও বিমানের নীতি নির্ধারকদের প্রাথমিক নিরীক্ষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। নজিরবিহীন এই বিপর্যয়ের দরুন চরম হতাশায় ভুগছে উদ্যোক্তারা।
ধর্মমন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, শুধু হজ্ব নয়-বিপর্যয় শুরু হয়েছে ওমরাহ থেকেই। গত মার্চের লকডাউন থেকেই ওমরাহ বন্ধ থাকায় বিপর্যয়ের সূচনা ঘটে। বিমান আটাবসহ এ খাতের ব্যবসায়ীরা চোখে সরষে ফুল দেখতে থাকে। বিশেষ করে চরম ক্ষতির মুখে পড়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। প্রতি হজ্ব মৌসুমে দেশে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার লেনদেন হলেও এ বছর এই অংক ‘শূন্যের’ কোঠায় থেকে যাচ্ছে। ফলে অনেক হজ্ব ও টিকিট বিক্রি করা ট্রাভেল এজেন্সিকে প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধে ধুঁকতে থাকা বিমান হারাবে রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় সুযোগটি। ফলে তাদের সামনে আরও বিপর্যয়। চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার ১৯১ জনের হজ্বে যাওয়ার কথা ছিল। বিমান সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু এরই মাঝে চরম দুঃসংবাদটি আসে গত ২২ জুন। সেদিন এক আদেশে সৌদি সরকার সীমিত আকারে হজ্ব সম্পন্ন করার ঘোষণা দেয়। ওই আদেশ অনুসারে, শুধু সৌদি আরবে বসবাসরতরাই এবারের হজ্বে অংশ নিতে পারবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের মুসলিম যারা বর্তমানে সৌদি আরবে বসবাস করছেন- তারাও হজ্বে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিমদের মতো এবার বাংলাদেশের কেউ সেখানে হজ্ব করতে যেতে পারছেন না।
এবার বাংলাদেশ থেকে কেউ হজ্বে যেতে না পারায় সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির নেমে এসেছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে। বিমান জানিয়েছে, গত মার্চ থেকেই ওমরাহ বন্ধ থাকায় বিপর্যের শুরুটা দেখা দেয় তখনই। ওমরাহর ভর মৌসুম রমজানে কোন হাজী পাঠানো যায়নি। এতে প্রায় চার শ’ কোটি টাকার টার্ন আউট থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে বিমানকে। গত তিন মাস ধরে ‘দৈন্যদশা’য় চলতে থাকা বিমান ইতোমধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে দুই শ’ কোটি টাকা। এরপর সর্বশেষ আঘাতটি আসে সৌদির হজ সংক্রান্ত ঘোষণায়। বিমানের বিপণন বিভাগ জানিয়েছে, ওমরাহ ও হজ্ব মিলিয়ে এ বছর বিমান প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই বিপর্যয় আপাতত কাটিয়ে ওঠার কোন উপায় নেই। এ সম্পর্কে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মোঃ মাহবুব আলী বলেছেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিমান কর পূর্ব নিট লাভ করেছে ৪২৩ কোটি টাকা। বিমানের এই লাভের সিংহভাগ এসেছিল হজ্বফ্লাইট থেকে। কারণ দেশে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদি এয়ারলাইন্স একচেটিয়াভাবে সব হজ্বযাত্রী বহন করে। এ বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ১৯১ জনের হজ্বে যাওয়ার চুক্তি হয়েছিল। যার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৬৮ হাজার ৫৯৫ জনকে বহন করত বিমান। প্রতি টিকিট এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা হলে শুধু হজ্বযাত্রী বহন করে ৯৪৬ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার টাকা আয় হতো বিমানের। তারপর খরচ বাদ দিয়ে লাভ হতো। একইভাবে ওমরাহের বেলায়ও ৩শ’ কোটি টাকার ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বিমান।
জানা গেছে, সৌদির এ ঘোষণার পরপরই ঢাকায় হজ্ব এজেন্সিগুলোর সংগঠন হাব নেতৃবৃন্দ জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। ধর্মমন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে দীর্ঘ বৈঠকে দেশের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা সবাই উপস্থিত থেকে এ খাতের বিপর্যয় নিয়ে আলোচনা করেন। তারা প্রত্যেকেই নিজ সেক্টরের সম্ভাব্য ব্যবসা, বার্ষিক টার্নআউট ও লাভ লোকসানের বিষয়টি তুলে ধরেন। হাব জানিয়েছে, দীর্ঘ একবছর প্রস্তুতি নিয়ে চূড়ান্ত মুুহূর্তে সৌদি সরকারের এ সিদ্ধান্ত ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাত। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে হজ্ব এজেন্সিগুলো। হজ্ব ভিসা থেকে শুরু করে মক্কা-মদিনায় বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া, হজ্বযাত্রীদের খাওয়া সার্বিক ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আয় হতো তাদের। তবে হজ্ব সীমিত করার সিদ্ধান্তে তারা এই আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হাবের বর্তমান সদস্য ১ হাজার ২৩৮। এজেন্সিগুলোর মালিকসহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজারের মতো। এ ছাড়া এ পেশার সঙ্গে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশে ও সৌদি আরবে আরও প্রায় এক লাখ লোক নিয়োজিত। সৌদির সিদ্ধান্ত এ বছর তাদের অনেক ভোগাবে বলে মনে করছে হাব। এ বিষয়ে এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, এ বছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার জনের হজ্বে যাওয়ার কথা ছিল। হজ্বকেন্দ্রিক প্রায় সাড়ে সাত থেকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতো। কিন্তু সৌদির শেষ মহূর্তের এই সিদ্ধান্তে আমাদের কাক্সিক্ষত লেনদেনটি হচ্ছে না। এতে ছোট-বড় সব হজ্ব এজেন্সিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি অনেক এজেন্সির টিকে থাকাও কষ্ট হয়ে যাবে। হজ্বযাত্রীদের সৌদি পাঠাতে না পেরে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে টিকিটিং এজেন্সিগুলোকেও। এ বছর হজ্বের বিমানভাড়া ধরা হয়েছিল এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা। প্রতিটি টিকিটিং এজেন্সি টিকিট প্রতি ৭ শতাংশ হারে কমিশন পেতো। হজ্ব সীমিত হওয়ার কারণে তারাও এই কমিশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এমন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির কাটিয়ে ওঠার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আমরা হাবের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছি। যদি প্রতীকী প্রণোদনাও দেয়া হয় তাহলেও কিছুটা রক্ষা হবে। হজ্ব, ওমরাহ, ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেটরসহ সংশ্লিষ্ট এ গুরুত্বপূর্ণ খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে। আমরা এখনও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
এ বিষয়ে এ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) জানায়, বিশ্বব্যাপী করোনা তান্ডবের দরুন কয়েক মাস ধরে দেশে ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ ছিল প্রায় সব ট্রাভেল এজেন্সি। যেসব বিশেষ ফ্লাইট চলেছে- সেগুলোর টিকিট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এয়ারলাইন্স কোম্পানি নিজেরাই বণ্টন করেছে। ফলে গত তিন মাস ধরে কোন আয় নেই তাদের। হজের মৌসুমের অপেক্ষায় ছিল তারা। কিন্তু হজ্ব সীমিত করার ঘোষণায় মহাবিপর্যয় নেমে। চারদিকে আন্ধকার অমানিশা নেমে আসে। আটাবের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মাজহারুল এইচ ভূঁইয়া বলেন, দেশে ৬০০ থেকে ৬৫০টি এজেন্সি সক্রিয়ভাবে হজ্বযাত্রী বহন করে। প্রতিটি এজেন্সি থেকে কমপক্ষে ১০০ থেকে ৩০০ জন হজ্বযাত্রীর টিকিট কাটা হতো। হজ্ব সীমিতকরণের ঘোষণায় আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। অনেক এজেন্সি কয়েক মাস ধরে চরম সঙ্কটে রয়েছে। হজ্ব সীমিত করার সিদ্ধান্তে এই সঙ্কট আরও প্রকট হলো। আটাব সভাপতি মনসুর আহমদ কালাম বলেন, গত চার মাস ধরে আমাদের ব্যবসা নেই। অন্যান্য খাতগুলো ধীরে ধীরে সচল হলেও এই সেক্টরটা এখনো থমকে আছে। এজেন্সিগুলো এতদিন কোনমতে কর্মীদের ঠিকঠাক বেতন দিয়ে ধরে রেখেছে। তবে এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী জুলাই মাসে কর্মীদের বেতন দেয়া সম্ভব হবে না। আমরা অর্থমন্ত্রী বরাবর একটি প্রণোদনা চেয়ে চিঠি পাঠালেও কোন সাড়া পাইনি। তবে আমাদের বিকল্প পন্থায় হলেও এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার কৌশল বের করতে হবে।