জৈন্তাপুর থেকে সংবাদদাতা :
জৈন্তাপুর উপজেলার ৫নং ফতেপুর (হরিপুর) ইউনিয়নের স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা বিরাজ করছে। করোনাভাইরাস ও বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে পানিবাহিত অসহায় রোগীদের দেখার কেউ নেই। এতে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ও ঔষধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ওই এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী। এই ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল আফিসার প্রদীপ কুমার দাস সহ ৫জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকা সত্ত্বেও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কার্যক্রম পার্শ্ববর্তি প্রাণি সম্পদ অফিসে সরকারি চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও গত তিন মাস যাবত কোন চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে না। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নতুন ভবন তৈরীর জন্য পুরাতন ভবনটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। তাই নতুন ভবনের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উক্ত প্রাণী সম্পদ অফিসে অস্থায়ী ভাবে স্বাস্থ্য সেবা ও পরিবার পরিকল্পনার কার্যক্রম চালানোর জন্য সরকারি ভাবে সিদ্ধান্ত হয়। অস্থায়ী সেবা কেন্দ্রে ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে রোগীরা অপেক্ষা করে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, জৈন্তাপুর উপজেলার ৫নং ফতেপুর (হরিপুর) ইউনিয়ন অস্থায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ২৮ জুন রবিবার দুপুর পর্যন্ত রোগীরা অপেক্ষা করেও কোনো ডাক্তার বা কর্মচারীর দেখা মেলেনি। অস্থায়ী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দরজায় ঝুলছে তালা। ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে বাইরে অবস্থান করা রোগীরা দুপুরে বাড়ি ফিরে যান। তারা ডাক্তার বা কোনো কর্মচারীর সঙ্গে দেখা করতে না পেরে হতাশা প্রকাশ করেন। ফিরে যাওয়া অনেক রোগীদের মধ্যে রয়েছে- বাগেরখাল গ্রামের শাহ্ আলমের স্ত্রী শেফালী, খালেদা, হেমু ভাটপাড়া গ্রামের রেশমা বেগম, মাজপাড়া গ্রামের জয়নাল আবেদীন, দত্তপাড়া গ্রামের আবুল কালামের স্ত্রী কল্পনা। তারা দূর থেকে বিভিন্ন রোগের কারণে ও অসুস্থ শিশুদের নিয়ে আসে ডাক্তার দেখানোর জন্য। কিন্তু দরজায় তালা ঝোলানু দেখে ফিরে যাওয়ার সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে এক মহিলা বলেন, এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দীর্ঘ ৩ মাস ধরে কোনো ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা গরীব মানুষ এখন চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবো।
স্থানীয়রা আরও জানান, গত বুধবার এক গর্ভবতী নারী চিকিৎসা নিতে আসেন উক্ত স্বাস্থ্য ও পঃ কঃ কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে সকাল থেকে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু, চিকিৎসক তো দূরের কথা, ওখানকার সংশ্লিষ্ট কাউকে তিনি পাননি। অস্থায়ী ক্লিনিকটি তালাবদ্ধ থাকায় বাইরে বসে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। পরে কাউকে না পেয়ে দুপুর ২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে যান তিনি। একজন গর্ভবতি মহিলা প্রসবের পূর্বে ৪ বার চিকিৎসা নেয়ার কথা থাকলেও ওই ক্লিনিকে ২ জন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (ঋডঠ) থাকা সত্ত্বেও ফাহিমা বেগম কাওকে পায় নি।
ফাহিমা বেগম বলেন, ‘আমি গর্ভবতী। ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার জন্য ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। সারাদিন অপেক্ষা করে চিকিৎসা সেবা ও কোন পরামর্শ না পেয়ে ফিরে এসেছি। কাউকে পাইনি। ক্লিনিক তালা দেওয়া ছিল। তাই ভিতরে ঢুকতে পারিনি। বাইরেই বসেছিলাম।’
গত বৃহস্পতিবার শারমিন বেগম জ্বরের কারণে ফতেপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে অসেন। পরে তিনি একটি প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা নেন। তার টাইফয়েড ধরা পড়ে।
উক্ত কেন্দ্রের সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার প্রদীপ কুমার দাশ এর নামে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের স্টোর হইতে সাধারণ রোগীদের জন্য প্রতি মাসে ঔষধ সরবরাহ করা হয়। এমন কি ঐ কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (ঋডঠ) বীথি দাশকে ও প্রতি মাসে ঔষধ সহ পরিবার পরিকল্পনা সেবার নানা সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। গত তিন মাস থেকে অস্থায়ী স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে চিকিৎসা সেবা না দিয়ে প্রদীপ কুমার দাশ ও বীথি দাশের নামে যে পরিমাণ ঔষধ উত্তোলন করা হয় সে ঔষধ গুলো কোথায় গায়েব হয় এ নিয়ে ইউনিয়নের বিভিন্ন স্তরের জনগণের মাঝে আলোচনা সমালোচনা চলছে।
এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে ফতেপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল আফিসার প্রদীপ কুমার দাশ তিন মাস থেকে কর্মস্থলে না আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার স্টাফের এক কর্মচারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত থাকায় এত দিন আমি আসতে পারিনি। আমার কর্মচারী সুস্থ হলে আমি কর্মস্থলে ফিরে আসবো। তিনি আরো বলেন আমাকে প্রাণী সম্পদ অফিসে অস্থায়ী ভাবে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালানোর আদেশ দিলেও সেখান কার পরিবেশ ভালো না থাকায় আমি যাচ্ছি না।
ঔষধ উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী স্টোর কিপার (টঋচঙ) শামীমা বেগম বলেন, ফতেপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার প্রদীপ কুমার দাশ ও বীথি দাসকে নিয়মিত ঔষধ সরবরাহ করে আসছি। প্রতিমাসের ন্যায় গত সপ্তাহে ও প্রদীপ কুমার দাশের এক কর্মচারী দ্বারা আমার কাছ থেকে ঔষধ নিয়েছেন। তারা ঔষধ ও সরঞ্জামাদি কি করেণ এ বিষয়ে আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ডাঃ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। করোনাভাইরাসের ও বন্যা পরিস্থিতির এই সময়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। আজ আমি নিজেই সিলেট থেকে জৈন্তাপুর কর্মস্থলে আসার পথে উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল আফিসার প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (ঋডঠ) বীথি দাশ সহ কোন কর্মচারিকে পাইনি। অস্থায়ী কার্যালয়ে তালা ঝোলানো। প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন দিলে তিনি বলেন আমি অসুস্থ, আমার অফিসের এক কর্মচারি অসুস্থ থাকায় আমি আসছি না। তিন মাস থেকে কর্মস্থলে না আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন প্রাণী সম্পদ অফিসে তাকে অস্থায়ী ভাবে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালানোর আদেশ দিলেও সেখান কার পরিবেশ ভালো না থাকায় যাচ্ছেন না।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা পারভীন বলেন, এ ব্যাপারে আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগীয় পরিচালক কুতুব উদ্দিনের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। হরিপুরের মানুষ ফতেপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকের ওপর নির্ভরশীল। তাই এগুলো বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। ফতেপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র তিন মাস থেকে বন্ধ। এ ঘটনার ব্যাপারে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন বলেও তিনি জানান।