কাজিরবাজার ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালুর শুরুতেই কাতার এয়ারওয়েজের টিকিট নিয়ে তুঘলকি কান্ড ঘটছে। আকাশচুম্বী দাম দিয়েও টিকিট পাচ্ছেন না যাত্রীরা। ইকোনমি ক্লাসের ১ লাখ টাকার টিকিট তিন লাখ টাকায়ও মিলছে না। আবার বিজনেস ক্লাসের টিকিটও কিনতে হচ্ছে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকায়। ফ্লাইট চালুর শুরুর দিনেই রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কাতার এয়ারের সেলস সেন্টারে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে মিলছে এ ধরনের অবিশ্বাস্য সব অভিযোগ। কেন এমনটি ঘটছে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছেন না বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষও। দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোর টিকিট বিক্রির এই রেগুলেটরি সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-শুরুতে বাড়তি দাম নেয়ার অভিযোগ থাকলেও সেটা ক্রমশ সহনশীল হয়ে যাবে। বেবিচক সদস্য এফএস আর গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেছেন, এয়ারলাইন্সগুলো কি নীতিতে টিকিট বিক্রি করবে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু যদি থাকে সেটা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা যেতে পারে।
এ বিষয়ে খ্যাতিমান এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেন, কাতার এয়ার একচেটিয়া মনোপলি বিজনেস করছে। বেবিচকের উচিত হয়নি- শুধু কাতার এয়ারকে এককভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অপারেট করার অনুমতি দেয়া। যদি এমিরেটস টার্কিসসহ অন্যান্যরাও ফ্লাইট চালানোর সুযোগ থাকতো তাহলে যাত্রী সাধারণের এমন দুর্ভোগ হতো না। কভিডের সুযোগে কোন একটি এয়ারলাইন্স গলাকাটা দামে মানুষের পকেট কাটবে এটা দেখা উচিত বেবিচকের। এ মনোপলি ভেঙ্গে দিতে হবে।
উল্লেখ্য মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক রুটে বিমান ও কাতার এয়ারকে ফ্লাইট অপারেট করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আপাতত বিমান শুধু লন্ডন যাবার সুযোগ পাচ্ছে আর কাতার শুধু ঢাকা থেকে বহির্বিশ্বের ট্রানজিট যাত্রী আনা নেয়া করতে পারবে। অর্থাৎ দোহায় বাংলাদেশীদের প্রবেশ করতে না দেয়া হলেও দেশটি থেকে ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে যেতে পারবেন প্রবাসীরা। এ বিবেচনায় কাতারই প্রথম ফ্লাইট শুরু করে সোমবার দিবাগত রাতে। ওই ফ্লাইটে পৌনে তিন শ’ যাত্রী নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে কাতার এয়ার। যাত্রীদের বেশ ক’জন বিমানবন্দরে অভিযোগ করেছেন, তারা আগের চেয়ে তিনগুণ ভাড়া বেশি টিকিট কেটেছেন। যাত্রীদের বেশির ভাগই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিমুখী ছিলেন। তারা সবাই ঢাকা থেকেই ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমেই টিকিট কিনেন। ক’জনের অভিযোগ তাদের টিকিট আগে কাটা থাকলেও অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। তাদের অভিযোগ-ইউরোপ-আমেরিকাসহ কাতার এয়ারওয়েজের কোন দেশের টিকিটই পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। টিকিটের জন্য মঙ্গলবার ভোর থেকে কাতার এয়ারওয়েজের তেজগাঁওয়ের এসপিএল ওয়েস্টার্ন টাওয়ারের কার্যালয়ের বাইরে দীর্ঘ লাইন ধরেছেন। শত শত লোককে টিকিটের জন্য হাহাকার করতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে কথা হয় মহাখালী বাস টার্মিনালের শ্রমিক নেতা মিনহাজের সঙ্গে। তিনি জানালেন- কিছুতেই টিকিট মিলছে না। আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত নাকি সব টিকেট শেষ। এখন কি করা ? আমার স্বজনদের অবশ্যই আগামী ২৯ জুনের আগেই আমেরিকা যেতে হবে।
একচেটিয়া চড়া দামে টিকিট কেনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেন- আমি নিজে ঢাকা থেকে টরেন্টো শিকাগো হয়ে ঢাকায় ফেরার একটি টিকিট কিনেছি ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকায়। যা কিছুতেই ৩ থেকে সাড়ে তিন লাখের বেশি হওয়া উচিত নয়। কভিড পূর্ব সময়ে ঢাকা নিউইয়র্কের ইকোনমি ক্লাসের যেই টিকিট বিক্রি হতো ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় সেটাই এখন বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকায়। বিজনেস ক্লাসের টিকিট আগে বিক্রি হতো ৩ লাখ টাকায় এখন সেটা ৫ থেকে ৬ লাখেও মিলছে না। এ রকম তুঘলকি কান্ড ঘটছে শুধু কাতার এয়ারের মাঠে একা বলে। বেবিচক যদি অন্যান্য এয়ারলাইন্সকেও ওপেন করে দিত তাহলে কিছুতেই কাতার এ সুযোগ পেত না। বেবিচকের উচিত যারা যারা আবেদন করেছে সবাইকে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে অনুমোদন দিয়ে দেয়া। এছাড়া ভোগান্তি শেষ হবে না।
ভোগান্তির শিকার মারুফ নামের অপর এক জার্মান প্রবাসী বলেন-আমি সকাল ৭টা থেকে এসে কার্যালয়ের বাইরে অবস্থান করছি। তারা টিকিট দেয়নি। তাদের সবকয়টি ফোন নম্বরে ফোন দিলে কেউ ধরেনি। হঠাৎ অফিসের ভেতর থেকে একজন এসে বললেন ১৭ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত সব ফ্লাইটের সিটের বুকিং শেষ। এরপরের টিকিটের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া পরবর্তীতে জানিয়ে দেয়া হবে। সেলিম হাসান নামে জার্মানি প্রবাসী বলেন, গত ৫ দিন ধরে তাদের সবকয়টি নম্বরে ফোন দিয়েছি, কেউ রিসিভ করেনি। আমার ছুটি শেষ হয়ে গেছে জুনের ১ তারিখ। এখন জার্মানি ফিরতে না পারলে চাকরি থাকবে না। দেশে থেকেও সরকারের কোন প্রণোদনা পেলাম না। এসে দেখি টিকিট নেই। জাহাঙ্গীর আলম নামে আরেক প্রবাসী বলেন, আমি ইতালির রোম থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরি। আগামী ২২ জুন আমার রিটার্ন টিকিট। তবে গতকাল কাতার এয়ারওয়েজের অফিসে গেলে তারা জানায়, আমার ওই রিটার্ন টিকিট দিয়ে আমি ফিরতে পারব না। রোমে যেতে হলে আমাকে নতুন করে টিকিট কাটতে হবে। সে দেশে গিয়ে আগের রিটার্ন টিকিটের জন্য রিফান্ড আবেদন করতে হবে। তার মতো এমন আরও অনেকেই ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরেছেন।
এসব অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে কাতার এয়ারওয়েজের হটলাইন নম্বর থেকেও কেউ কথা বলেনি। কাতার এয়ারওয়েজের বাংলাদেশের জেনারেল সেলস এজেন্ট গ্ল্যালাক্সি হলিডেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদকে ফোন করা হলেও তিনি কথা বলেননি।
জানা গেছে, কাতার এয়ারওয়েজের আবেদনের ভিত্তিতে তাদের বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয় বেবিচক। ১৬ জুন থেকে সপ্তাহে ৩টি ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় কাতার এয়ারওয়েজ। ঢাকায় কাতার এয়ার বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর মডেলের উড়োজাহাজ ব্যবহার করছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা কেবল ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২৭৫ জন যাত্রী বহন করতে পারবে। এক্ষেত্রে সপ্তাহে বড় ৭/৮ শত প্রবাসী দেশ ছাড়তে পারবেন। কিন্তু বিপরীতে বর্তমানে দশে প্রায় ৪০ হাজার প্রবাসী নিজ নিজ বিদেশের গন্তব্যে ফেরার অপেক্ষায় আছেন। এছাড়া নতুন ভিসা হাতে নিয়ে বেশ কিছু আমেরিকান বসে আছেন। আবদুল কাইয়ুম নামের একজন নতুন ভিসাধারী বলেন, আমার পরিবারের চারজনকে আমেরিকার ভিসা দেয়া হয়েছে। চলতি মাসের ২৯ তারিখ ভিসার মেয়াদ শেষ। এখন আমি কি করি? কাতার এয়ারের টিকিট কাটতে গিয়ে আগামী মাসের তৃতীয় সপ্তাহের আগে পর্যন্ত কোন টিকেট পাচ্ছি না। অন্য কোন এয়ারলাইন্সও আমাদের সামনে খোলা নেই।
এসব অভিযোগ জানতে চাইলে বেবিচক সদস্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী জিয়াউল কবির বলেন, আমরা শুনেছি এ জাতীয় কিছু অভিযোগ। কিন্তু লিখিতভাবে কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জমা দিচ্ছে না। তারপরও এগুলো খতিয়ে দেখা হবে। তবে কোভিড মহামারী সময়ে বিশ্বব্যাপীই আকাশপথের ব্যয় বাড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এয়ারলাইন্সগুলো তো তাদের তিনমাসের লস পোষানোর সুযোগটা প্রথমেই লুফে নিতে চাইবে। নতুন স্বাস্থ্য বিধি বা দূরত্ব বিধি অনুযায়ী এমন কিছু কৌশল নিতে হয়েছে, তাতে ফ্লাইটের ব্যয় বাড়বেই। ইকোনমি ক্লাসে শতকরা ২৫ ভাগ সিট খালি রাখতে হবে। বিজনেস ক্লাসেও সেটা ছিল। আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সেটা বিবেচনায় নিয়ে অবশ্য বিজনেস ক্লাসের খালি রাখার প্রভিশন বাতিল করেছি। যাতে অন্তত মানুষ কিছুটা স্বস্তি পায়। কভিড মহামারীতে এখন কাতার এয়েজ ফ্লাইট শুরু করেছে বাংলাদেশ থেকে। দুনিয়াব্যাপীই এভাবে সীমিত আকারে ফ্লাইট চলাচল শুরু হচ্ছে। তবে আমার জানা মতে, তারা আগের বিক্রি করার টিকেটেরই যাত্রী নিচ্ছে। নতুন করে তাদের টিকিট বিক্রির সুযোগই নেই। ইকোনমি ক্লাসের কোন সিট নেই আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত। বিজনেস ক্লাসের কিছু সিট দেখা যায় আছে। সেজন্যই কিছুটা দাম বেশি নেয়ার কৌশল তাদের থাকবেই। কিন্তু ১ লাখ টাকার টিকিট যদি ৩/৪ লাখ টাকা নেয় তাহলে সেটা অবশ্যই অযৌক্তিক। এটা পারে না। এমন হলে আমরা তাদের অবশ্যই জানতে চাইব। তবে আগের কাটা টিকিটের কোন যাত্রী যদি নো শো দেখায় সেই টিকিট হয়তো চড়া দামে কিছু বিক্রি করে থাকতে পারে। এ ছাড়া আর নতুন করে টিকিট বিক্রির কোন সুযোগ নেই।
কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন তো শুধু ঢাকা থেকে কাতার একাই ইউরোপ আমেরিকা ও অন্যান্য গন্তব্যের যাত্রী নিচ্ছে। সেজন্য তাদের এখানে বেশিই চাপটা পড়ছে। আমরা আশাবাদী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কেননা ঢাকা থেকে আরও কয়েকটি বিদেশী এয়ারলাইন্স ফ্লাইট অপারেট করার জন্য অনুমতি চেয়েছে। ইতোমধ্যে এমিরেটস, এয়ার এ্যারাবিয়া, ফ্লাই দুবাই এবং তুরস্কের তার্কিশ এয়ারলাইন্স আবেদন করেছে। চিঠিতে তারা বাংলাদেশ থেকে যাত্রী নিয়ে স্ব স্ব দেশে ফ্লাইট চালাতে দেয়ার অনুমতি চেয়েছে। চার এয়ারলাইন্সের মধ্যে তার্কিশ এয়ারলাইন্স ১ জুলাই থেকে এবং বাকিরা অনুমতি পেলেই ফ্লাইট চালু করবে বলে আগ্রহ দেখিয়েছে। এয়ার এ্যারাবিয়া ঢাকা থেকে সরাসরি শারজাহ; ফ্লাই দুবাই ও এমিরেটস দুবাইয়ে এবং তার্কিশ এয়ারওয়েজ তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে ফ্লাইট পরিচালনা করে। তুরস্ক ছাড়া অন্য রুটগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও ফ্লাইট পরিচালনা করে। তবে আমরা স্ব স্ব দেশের সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা তাদের বলেছি, যদি তাদের ফ্লাইট আমাদের দেশে আসে এবং তাহলে আমাদের দেশের এয়ারলাইন্সকেও সেদেশে ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে। আশা করছি তারা এই অনুমতি দেবে। তেমনটি হলে পরিস্থিতি আর এমন থাকবে না।