হিমালয় কন্যা নেপালে করোনায় প্রথম মৃত্যু, ভারতে একদিনেই আক্রান্ত ৫২৪২ জন ॥ মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে লাতিন আমেরিকা

19

কাজিরবাজার ডেস্ক  :
প্রায় কয়েক মাস ধরে বিশ্বজুড়ে বিপর্যয় চালিয়ে যাওয়া করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে হিমালয় কন্যা নেপালে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, একটি জেলা থেকে রাজধানী কাঠমান্ডু আনার পথে ২৯ বছর বয়সী এক নারীর মৃত্যু হয়েছে করোনা সংক্রমণে। আর প্রতিবেশী দেশ ভারতে একদিনে সর্বাধিক ৫২৪২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। অন্যদিকে করোনায় আক্রান্তের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকার রাশিয়ায় ২৪ ঘণ্টায় আট হাজার ৯২৬ জনের করোনা শনাক্ত করা হয়। এছাড়া করোনার মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে এখন লাতিন আমেরিকা। সেখানকার দেশ ব্রাজিলে পাঁচ শ’র বেশি মানুষ মারা গেছেন।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা সম্পর্কে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৪৮ লাখ ২৫ হাজার ৯০২ জনে দাঁড়িয়েছে। মারা গেছেন তিন লাখ ১৭ হাজার ১০১ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৩২ জন। এদিকে করোনার বিস্তার ঠেকাতে গত ২৪ মার্চ থেকে টানা লকডাউন আছে নেপাল। নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি দুই প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সীমান্ত বন্ধ রেখেছে হিমালয়ের দেশটি। বলা হচ্ছে, এসব পদক্ষেপ কঠোরভাবে নিশ্চিত করায় চীন-ভারতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লেও নেপাল প্রায় সফল করোনা মোকাবেলায়। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নেপালে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৯১ জন। এর মধ্যে প্রথম মৃত্যু হয়েছে শনিবার।
ভারতে একদিনে সর্বাধিক শনাক্ত : গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে পাঁচ হাজার ২৪২ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা একদিনে সর্বাধিক। এতে দেশটিতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে হলো ৯৬ হাজার ১৬৯ এবং তাদের মধ্যে মারা গেছেন তিন হাজার ২৯ জন। চতুর্থ দফায় লকডাউনের মেয়াদ সোমবার থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বাড়ানোর সরকারী ঘোষণার দিনেই সংক্রমণ এক লাফে অনেকটা বাড়ল। তবে অঞ্চলভেদে সংক্রমণের হারের ওপর ভিত্তি করে বিধিনিষেধ শিথিলের ক্ষমতা রয়েছে রাজ্যগুলোর।
রাশিয়ায় আক্রান্ত কমেছে : রাশিয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় আট হাজার ৯২৬ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। নতুন করে মারা গেছে আরও ৯১ জন। এ নিয়ে দেশটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো দুই হাজার ৭২২ জনে। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ায় মোট দুই লাখ ৮১ হাজার ৭৫২ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে।
ব্রাজিলে বাড়ছে করোনা রোগী : করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় হাসপাতালগুলোতে জরুরী শয্যার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্রাজিলের বৃহত্তম শহর সাও পাওলোর মেয়র ব্রুনো কোভাস। তিনি বলেছেন, শহরের হাসপাতালগুলোর ধারণ ক্ষমতার ৯০ শতাংশ পূরণ হয়ে গেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সেখানে কোন জায়গা থাকবে না। লকডাউন অবজ্ঞাকারীদের বিরুদ্ধে মানুষের জীবন নিয়ে খেলার অভিযোগ করেছেন সাও পাওলোর ওই মেয়র। ব্রাজিলে করোনায় সবচেয়ে মারাত্মক প্রকোপ শুরু হয়েছে দেশটির বৃহত্তম এই শহরে। সেখানে প্রায় তিন হাজার মানুষের প্রাণ কেড়েছে করোনা।
যুক্তরাষ্ট্রে আরও ১৩৯৪ মৃত্যু : যুক্তরাষ্ট্রে মহামারী করোনার সংক্রমণ কমছেই না। প্রতিদিনই সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে। স্থানীয় সময় রবিবার যুক্তরাষ্ট্রেও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) জানিয়েছে, আরও প্রায় ১৪শ’ মানুষের মৃত্যু ছাড়াও নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ৩২ হাজার রোগী। সিডিসির হিসাব অনুযায়ী, নতুন শনাক্ত ৩১ হাজার ৯৬৭ জনসহ মোট কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এখন ১৫ লাখ ২৮ হাজার ১৭৯ জন। কোভিড-১৯ পজিটিভ ৯০ হাজার ৯৮৮ জন মানুষ মারা গেছেন।
দোকান-বার খুলে দিয়েছে ইতালি : অবশেষে ইতালিতে দোকান-পাট, সেলুন ও রেস্টুরেন্ট খুলে দেয়া হয়েছে। ১০ সপ্তাহের লকডাউন শেষে সোমবার থেকে দেশটি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরেছে। এখন লোকজন চাইলেই আবারও রেস্টুরেন্টে বসে কফিতে চুমুক দিতে পারবেন। বিভিন্ন চার্চেও লোকজনের প্রবেশে অনুমতি দেয়া হয়েছে। রোমের সেন্ট্রাল পিয়াজা ডেল পোপোলোতে অবস্থিত ক্যাফে ক্যানোভার কর্মচারী ভ্যালেন্তিনো ক্যাসানোভা বলেন, আমি প্রায় আড়াই মাস ধরে কাজ করতে পারছি না। আজকের দিনটা খুব সুন্দর, খুবই আনন্দের। ইতালিতে দুই লাখ ২৫ হাজার ৪৩৫ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৩১ হাজার ৯০৮ জন।
চার্চ খুলল ভ্যাটিকানে : ভ্যাটিকান সিটিতে দুই মাসের বেশি সময় পর চার্চ খুলে দেয়া হয়েছে। সোমবার থেকে দেশটিতে দর্শনার্থীদের জন্য সেইন্ট পিটার্স বেসিলিকা চার্চ আবারও খুলে দেয়া হয়েছে। করোনার বিস্তার রোধ করতে প্রায় দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ওই চার্চটি বন্ধ ছিল। সোমবার চার্চের সামনে দর্শনার্থীদের লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যদিও চার্চে প্রবেশের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হচ্ছে। একজন থেকে অপরজনকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হচ্ছে। চার্চে প্রবেশের ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব অবশ্যই মেনে চলতে বলা হয়েছে। প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা মাপা এবং মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। লোকজন এসব বিধি-নিষেধ সঠিকভাবে পালন করছে কিনা তা তদারকি করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। করোনার কারণে গত ১০ মার্চ থেকে ভ্যাটিকান সিটির চার্চটি বন্ধ ছিল। ফলে সেখানে লোকজনের প্রবেশ নিষেধ ছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকায় একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত : দক্ষিণ আফ্রিকাতেও প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। সেখানে একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড হয়েছে। দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, একদিনেই নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ১৬০ জন। দেশটিতে এটাই একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড। করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই পশ্চিমাঞ্চলীয় কেপ প্রদেশের। ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ১৫ হাজার ৫১৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৬৪ জন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন সাত হাজার ছয়জন। বর্তমানে করোনার এ্যাক্টিভ কেস আট হাজার ২৪৫। এখনও আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন ১১৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ১৬০ জন এবং তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। একদিন আগের হিসাব অনুযায়ী, নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮৩১ এবং মারা গেছেন ১৪ জন।
সৌদিতে আরও ২৭৩৬ শনাক্ত : মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও দুই হাজার ৭৩৬ জন করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছেন। এ নিয়ে দেশটিতে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৫৪ হাজার ৭৫২ জনে। সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও দশজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৩১২ জন। গত একদিনে সুস্থ হয়েছেন দুই হাজার ৫৬ জন। মোট সুস্থের সংখ্যা ২৫ হাজার ৭২২।
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে মক্কা মুকাররমে ৫৫৭ জন, রাজধানী রিয়াদে ৪৮৮ জন, মদিনা মুনাওয়ারায় ৩৯২ জন, বন্দর নগরী জেদ্দায় ৩৫৭ জন, দাম্মামে ২৮৬ জন, আল হুফুফে ১৪৯ জন, আল জুবাইলে ১৪৯ জন, তায়েপে ৮১ জন, আল খোবারে ৫১ জন, ক্বাতিপে ২৪ জন, তাবুকে ১৮ জন, জাহারানে ১৫ জন।
করোনায় নতুন মৃত্যুপুরী লাতিন আমেরিকা : যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকার পর করোনার সংক্রমণ এখন লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ব্রাজিল, মেক্সিকো ও পেরুর মতো দেশগুলোতে সংক্রমণ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। করোনার বিস্তার ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে পুরো লাতিন অঞ্চল। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যায় ইতালি ও স্পেনকে ছাড়িয়ে গেছে ব্রাজিল। দেশটিতে এখন মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ৩৩ হাজার ১৪২ জন; যা গোটা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ। নতুন করে আক্রান্ত হিসাবে শনাক্ত হয়েছে আরও ১৪ হাজার ৯১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী। শুধু আক্রান্ত নয় মৃত্যুতেও ব্রাজিলের অবস্থা বিপর্যস্ত। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ব্রাজিলে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৮১৬ জনের মৃত্যুর পর করোনায় মোট প্রাণহানির সংখ্যা এখন ১৫ হাজার ৬৩৩। যা ওই অঞ্চলে সর্বোচ্চ। ব্রাজিলে করোনায় আক্রান্ত হিসাবে শনাক্তের তুলনায় দেশটিতে করোনা পরীক্ষার হার অনেক কম। সরকারী অনিচ্ছার কারণেই কোভিড-১৯ পরীক্ষা কম হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ব্যাপকহারে পরীক্ষা করা যায় তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেকটা বাড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগেই সতর্ক করে বলেছিল, করোনা প্রাদুর্ভাবের পরবর্তী ‘হটস্পট’ হবে ব্রাজিল। সংস্থাটির সেই সতর্কতা এখন সত্যি হতে চলেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকার পর লাতিন অঞ্চলের এই দেশটি নতুন মৃত্যুপুরী হয়ে উঠছে। লাতিন আমেরিকার অপর দেশ মেক্সিকোতে গত বৃহস্পতিবার একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়। শুক্রবার সেই রেকর্ড ভেঙ্গে আবারও সর্বোচ্চ শনাক্ত হওয়ার পর দেশটিতে এখন মোট আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৪৯ হাজার ২১৯ জন। লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ পেরুতে ৮৮ হাজার ৫৪১ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে প্রতিদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩১ জন নিয়ে দেশটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা এখন দুই হাজার ৫২৩ জন। চিলিতে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ৪২ হাজার মানুষ। আক্রান্তের তুলনায় দেশটিতে কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটা কম। এখন পর্যন্ত ৪২১ জন মারা গেছে। প্রায় আরও দুই হাজার জন করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন।