বৃদ্ধাশ্রম

13

জাহিদ আজিম

সূর্যটা বেশ আগেই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে
এখন আসলে আলোহীন এক পড়ন্ত বিকেল,
বহু দূর পথ হেঁটে এসে দেহটা ক্লান্ত খুবই, তারও বেশি ক্লান্ত মনে
সুনসান এই পুরীতে বসে জীবনের হিসেব মেলানোর চেষ্টা অঢেল।

কোনো ত্রুটি নেই, একের পর এক সাজানো গোছানো সব কিছু
হঠাৎ করেই যেনো সব কিছু একেবারে এলোমেলো লাগছে,
শেষে এসে হিসেব মেলানো যাচ্ছে না কেনো কিছুতেই?
কোনো উত্তর নেই। হিসাবের খাতায় তাকিয়ে দৃষ্টি শুধু ঝাপসা হয়ে আসছে।

সব কিছু থাকার পরও হঠাৎ করেই কেন আবার
সব কিছুই এমন করে একেবারে নাই হয়ে যায়?
শেষ বিকেলের এই পথ টুকু চলতে কিছুই সাথে নেই
হঠাৎ করেই জীবনটা কেন এতোটা অসহায়?

শেষ বয়সের এই শিশুটি কি করে একা একা পথ চলে?
একটু ভালোবাসা দিয়ে, ভরসা হয়ে, অবলম্বন হয়ে,
সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে অথবা করুণা করেও কি পাশে থাকা যায় না?
মন-মনুষ্যত্ব, মানবতা আর বিবেক সব বুঝি পৃথিবী থেকে গেছে হারিয়ে।

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রাতের ঘুম দুরে ঠেলে, সব ভালোবাসা নিংড়ে
যত্নে যত্নে যাদেরকে গড়া হলো বেশ পরিপূর্ণ করেই,
তাদের কাছে কি একটু আশ্রয়, এক বিন্দু ভালোবাসা প্রত্যাশা করা যায় না?
ভালোবাসার কথা থাক, বিনিময় বলতেও কি কিছু পৃথিবীতে নেই?

প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবার পর এখন অবশিষ্ট যা আছে
তা যেন অচল অপ্রয়োজনীয় বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়,
এই আবর্জনা দিয়ে কি হবে ? এতো শুধুই এক জজ্ঞাল
এমন জীর্ণ বস্তুতে চাকচিক্যময় ঘরের সৌন্দর্যও যে নষ্ট হয় !

তাই তো দুহাতে দুরে ঠেলা, এমন করে ছুড়ে ফেলা
কোনো সম্পর্কই যেন নেই , না রক্তের না হৃদয়েরো ,
বহুদিনের বহু প্রয়োজনে ব্যবহার হওয়া এই বস্তুর সাথে
এক সূতা মায়ার সম্পর্কও যেন গড়ে উঠেনি কারো।

ভিক্ষুকের মতো ঘুরে ঘুরে অবশেষে এই ঠিকানা খুঁজে পাওয়া
অচেনা এই পুরীটাই এখন সবচেয়ে আপন, দুমুঠো ভাত আর একটু আশ্রয়ের জন্য,
একাকী সময় গুলো এখানে নীরবে নিভৃতেই কেটে যায়
পাষাণ প্রাচীর পেরিয়ে কেউ কোনো খবর নিতে আসে না, সবই লাগে শূন্য।

দূর অতীতে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই বুকটা খুব হাহাকার করে উঠে
ঐ প্রিয় মুখ গুলো যে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো এবুকেই,
আজও বুকে জড়াতে মন চায়, চোখ ভিজে আসে অজান্তেই
কিন্তু কেউ তো নেই দেখার, মুছে দেবার, অশ্রুটুকু তাই শুকায় চোখের কোণাতেই।

এমন করে, এতোটা দুরে যারা ছুঁড়ে ফেলে গেলো অবহেলায়
ওদের বেলাতেও যদি কখনো এমন নির্বাসন ঘটে ,
সব কিছু থাকার পরও নিঃস্ব সেজে থাকার যন্ত্রণাটা কেমন?
বোবা কান্না যে কতোটা কষ্টের হয় সেদিন ওঁরা বুঝবে বটে ।

বেলা তো শেষ, ঐ যে আলোটাও প্রায় নিভু নিভু করছে
ঘন কালো অসীম আধার চারপাশ এখনি হয় তো ঢেকে দিবে,
জীবনের হিসেব মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা ক্ষান্ত দিয়ে, এই অচল অবহেলিত বস্তুটি
বায়ুহীন গভীর নির্জনতার মাঝে চিরতরেই হারিয়ে যাবে।