কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা পরিস্থিতিতে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত প্রায় বন্ধের উপক্রম। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার খাত আপাতত বন্ধ। কল সেন্টারের কাজ কমেছে ৩৫ শতাংশ। ই-কমার্স সীমিত হয়ে পড়েছে ঢাকার মধ্যে। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়েও কোনও সুখবর নেই। কেবল জরুরি সেবা হিসেবে চালু আছে টেলিযোগাযোগ খাত। মোবাইলের ভয়েস ও ইন্টারনেট সেবা চালু এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু থাকলেও কেবল মোবাইল ইন্টারনেটেই কিছুটা প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবহার কমেছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেশ যে সংকটকাল অতিক্রম করছে তা এই খাতকে একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে উত্তরণের জন্য এ খাতে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা
প্রয়োজন। সরকার যদি এই খাতে দুই হাজার কোটি টাকা অনুদান বা প্রণোদনা দিয়ে সহায়তা করে, তাহলে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। একই সঙ্গে কয়েকটি সংগঠন সরকারের কাছে দুই শতাংশ সরল সুদে জামানতবিহীন দীর্ঘমেয়াদি ঋণও চেয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতে অনুদান না পেলে দেশের মোট সফটওয়্যার কোম্পানির অর্ধেক বন্ধ হয়ে যাবে, বন্ধ হয়ে যাবে অনেক হার্ডওয়্যার কোম্পানিও (মোবাইল ফোনসহ)। যারা টিকে থাকবে তারা প্রচুর কর্মী ছাঁটাই করবে। যারা চাকরিতে থাকবে তাদের বেতন বকেয়া পড়বে, বেকারত্বের সংখ্যা বাড়বে। দক্ষকর্মীর সংকট তৈরি হবে। ব্যবসায়িক ঠিকানার ভাড়া বাকি পড়বে, অনেক স্থানীয় আইএসপি (পাড়ামহল্লার ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান) বন্ধ হয়ে যাবে, কলসেন্টারের কাজ কমবে। সার্বিকভাবে এই শিল্পে অন্ধকার নেমে আসবে। তবে ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে কেবল টেলিযোগাযোগ খাতে।
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) সভাপতি মো. শাহিদ উল মুনীর বলেন, প্রতিমাসে দেশে হার্ডওয়্যার পণ্য (মোবাইলফোনসহ) বিক্রি হয় প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার। সরকারের
ছুটি ঘোষণার পর থেকে এই বিক্রি বন্ধ। করোনা ভাইরাসের কারণে দেশ ক্রমেই বড় ধরনের সংকটের দিকে যাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেওয়ায় দেশে পণ্য আমদানি কমে যায়। ফলে বেশ একটা সময় ধরে দেশে প্রযুক্তি পণ্যর সরবরাহ কম ছিল।
তিনি আরও জানান, তাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মী সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। করোনা সংকট আরও দুই মাস চললে তারল্য সংকট দেখা দেবে। কোম্পানিগুলো
এটা দূর করতে গেলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ীরা নিজেরা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে না। নিজেরা কাটিয়ে উঠতে গেলে কর্মী ছাঁটাই করতে হবে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিসর ছোট করতে হবে।
মো. শাহিদ উল মুনীর আরও বলেন, এই খাতকে আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে চাইলে সরকারের অনুদান ছাড়া সম্ভব নয়। এজন্য আমরা সরকারের কাছে ৬৮০ কোটি টাকা সহযোগিতা চেয়েছি। এই টাকা না পেলে আমরা ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবো না। এছাড়া সব তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠন সম্মিলিতভাবে আমরা সরকারের কাছে প্রায় দুই হাজার কোটি (এক হাজার ৯৩০ কোটি) টাকা অনুদান চেয়েছি।
এদিকে দেশের সফটওয়্যার ও সেবা পণ্য নির্মাতাদের সংগঠন বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সার্বিক চিত্র আসলে খারাপ। আমাদের বেশিরভাগ কোম্পানি যারা সফটওয়্যার রফতানি করতো তাদের ৮০ শতাংশ অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে বা তারা বিল পাচ্ছে না। আর যারা স্থানীয় কোম্পানি যেমন তৈরি পোশাক শিল্প, ব্যাংক, বীমা খাতের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করতো, তারা নতুন সফটওয়্যার নিচ্ছে না। এমনকি
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে যে সার্ভিস চার্জ পেতো সেটাও পাচ্ছে না। এভাবে আরও দুই মাস চললে বেসিসের অর্ধেক সদস্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বেশিরভাগ কোম্পানি ছোট।
তিনি আরও বলেন, আমরা এরই মধ্যে সরকারের কাছে ৬৬০ কোটি টাকা চেয়েছি। এই টাকা সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের আগামী ৬ মাসের বেতনের একটা অংশ এবং অফিস ভাড়ার একটা অংশ হিসেবে। এছাড়া আমরা সরকারের কাছে দুই শতাংশ হারে সরল সুদে জামানতবিহীন ঋণ চেয়েছি। যার প্রথম এক বছর থাকবে গ্রেস পিরিয়ড
হিসেবে। এটা পেলে আমরা সব ধরনের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবো।
এদিকে দেশের কল সেন্টারগুলোর ব্যবসাও ৩৫-৪০ শতাংশ চলে গেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবে আরও দুই মাস চললে ৭০-৮০ ভাগ ব্যবসাও চলে যাবে, দেশের বহু কলসেন্টার বন্ধ হয়ে যাবে। এখনও যারা টিকে আছে তারাও কীভাবে টিকে থাকবে সেটা বলা কঠিন বলে মন্তব্য করেন কলসেন্টার ও আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ‘বাক্য’র সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ হোসেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনই ব্যবসায়িক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো খুললে বোঝা যাবে কোন প্রতিষ্ঠান কলসেন্টারের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে, দৈনিক কলের পরিমাণ ঠিক রাখবে কিনা, সেসবের ওপর বিষয়টি নির্ভর করে।
তিনি উল্লেখ করেন, এখন আমাদের ফোকাস পয়েন্ট ঠিক করতে হবে। কারণ আমাদের বিশাল কর্মীবাহিনী রয়েছে, তারা যাতে ছাঁটাই না হয়, প্রতিষ্ঠান যেন টিকে থাকে, সে বিষয়টা মাথায় রাখতে হচ্ছে।
করোনাং ব্যবসার ক্ষতির বিষয়ে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, দেশের ই-কমার্স খাত আট হাজার কোটি টাকার। করোনা ভাইরাসের এই সংকটে প্রতি মাসে এই খাতে ক্ষতি হচ্ছে ৬৬৬ কোটি টাকার বেশি। এই অবস্থা যদি তিন মাস ধরে চলে তাহলে এই খাতের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবি দেশে ইন্টারনেট সেবা সচল রাখতে ৬১০ কোটি টাকা অনুদান চেয়েছে। অন্যদিকে মোবাইলফোন উৎপাদক ও আমদানিকারকদের সংগঠন বিএমপিআইএ জানিয়েছে দেশের ৯টি মোবাইল তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এছাড়া স্টার্টআপদের বাঁচাতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইক্যুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ভিসিপিয়াব) ভিসিপিয়াব’র সদস্য ও পোর্টফোলিও কোম্পানিগুলো রক্ষায় ৬টি প্রস্তাব দিয়েছে সরকারকে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন সংগঠন সরকারের কাছে ২২০০ থেকে ২৩০০ কোটি টাকা অনুদান চেয়েছে। আমার মনে হয় না অনুদানের বিষয়ে কিছু হবে, কারণ এটা সার্বিক অবস্থার সঙ্গে যুক্তিযুক্ত নয়। তবে অর্থমন্ত্রী যদি অনুদান দেয়, তাহলে আমি স্বাগত জানাবো। মন্ত্রী আরও বলেন, ২০১২ সাল থেকে আমি বারবার বলে আসছি, যে পদ্ধতিতে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প ডেভেলপ করছে, তাতে আমরা আসলে কানাগলির দিকে যাচ্ছি। কেউ গা করেনি। এখন সবাই সংকটে পড়ে গেছে।
তিনি সফটওয়্যার খাতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এ খাতে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলো অ্যাকাউন্টিং টাইপের সফটওয়্যার তৈরি করে। ব্যাংকিং সফটওয়্যার তৈরির সংখ্যা কম। এই খাতটা আউটসোর্সিং খাতের দিকে নজর
দিয়েছে তাও আবার কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। অনেক চেষ্টার পরে সফটওয়্যার রফতানিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম, কিন্তু দেখা যাবে দুই একটি কোম্পানি ছাড়া কেউ তা নিতে পারেনি। আর হার্ডওয়্যার হলো তো দোকানদারি।
তিনি প্রশ্ন করেন, এই সংগঠনগুলো যে অনুদান চায়, রাষ্ট্র এদের কাছ থেকে কী পাবে। বরং সংগঠনগুলো এই সংকটকালে সরকারের বিভিন্ন ট্যাক্স, ভ্যাটের বিষয়ে কতটা ছাড় পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে আবেদন করতে পারতো। এটা যৌক্তিক ছিল। মন্ত্রী বিশেষভাবে উল্লেখ করেন আইএসপিগুলোর কথা। তিনি বলেন, এ সময়ে আইএসপিগুলো ভালো করেছে। ব্যান্ডউইথে ছাড় দেওয়া এবং সরকারের বিভিন্ন চার্জের (বিলের ক্ষেত্রে) বেলায় দেরি করানো যায় কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো দেখবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি।