উচ্চ আদালতের বেশিরভাগ রায়ই ইংরেজীতে মুজিববর্ষ থেকে সব রায় বাংলায় লেখার আহ্বান

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বাংলায় রায় দেয়ার জন্য আদালতের বিচারপতিদের প্রতি জোর আহ্বান জানানো সত্ত্বেও উচ্চ আদালতের বেশিরভাগ বিচারপতি ইংরেজীতেই রায় লিখছেন। পাশাপাশি আইন কমিশনও বাংলায় রায় দেয়ার জন্য একটি সুপারিশ পাঠায়। দীর্ঘ নয় বছরেও ওই সুপারিশও আলোর মুখ দেখেনি। নিম্ন আদালতগুলোয় বিচার কাজে বাংলার ব্যবহার বাড়লেও উচ্চ আদালতে এখনও অবহেলিত। এদিকে সুপ্রীমকোর্টের আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে প্রথা ও রীতিনীতির কথা বলে সব কাজকর্ম চলছে ইংরেজীতেই। সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতিরা রায়, আদেশ বা নির্দেশ দিচ্ছেন বেশিরভাগই ইংরেজীতে। আইনজীবীরাও তাদের শুনানি করেন (বক্তব্য) ইংরেজীতেই। ফলে পবিত্র বাংলা ভাষা হচ্ছে উপেক্ষিত। আইন বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, মুজিববর্ষ থেকে আমাদের উচ্চ আদালতসহ সব পর্যায়ে মাতৃভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে বাঙালী জাতি নিজস্ব স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হবে। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু একদিনে হবে না। অনেকেই বাংলায় রায় দিচ্ছেন। আস্তে আস্তে এর প্রচলন চালু হবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি লাভ করেছে, অথচ মহান ভাষা এই দেশেরই উচ্চ আদালতে উপেক্ষিত। অথচ জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, স্পেন, চীন, নেদারল্যান্ডসসহ উন্নত বিশ্বে বিচারপ্রার্থীদের শুনানি ও রায় বোঝার জন্য উচ্চ আদালতে দাফতরিক কাজসহ আদালতের রায় ও আদেশ চলে তাদের নিজস্ব ভাষায়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদটি জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলনের নির্দেশ দিয়েছে। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে লোকবলের অভাব টাইপের অসুবিধা বহুল প্রচারিত ফ্রন্টে কম্পোজ না করা, যে কারণে সহজেই ফ্রন্ট পরিবর্তন করা যায় না। টাইপিং ডিভাইস সফটওয়্যার চেঞ্জ না করা, বাংলায় রায় লেখার মানসিকতার অভাব, বাংলা লেখাটা কঠিন, বিও বাংলায় ডিকটেশন দ্রুত না লিখতে পারা এবং আইনজীবীদের শুনানি ও বিভিন্ন আবেদন বাংলায় না লেখাই এর অন্যতম কারণ। ’১৫ সাল পর্যন্ত কজলিস্টগুলো বাংলাতেই হতো। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ’১৫ সালের পর ইংরেজীতে এটা চালু করেন। রাষ্ট্রের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সচিবালয়সহ শাসন বিভাগের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলিত আছে, জাতীয় সংসদের অধিবেশনসহ সব কার্যক্রম সম্পূর্ণ বাংলা ভাষাতেই চলছে অথচ উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নেই। উচ্চ আদালতে ইংরেজীতে বিচার পরিচালনা হচ্ছে।
এদিকে বাংলা ভাষায় রায় লেখা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার অভিপ্রায় পূরণের লক্ষ্যে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলায় রায় দেয়ার জন্য উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়ে আসছেন। তিনি এও বলেন, ইংরেজীতে লেখা রায় বিচার প্রার্থীরা বুঝতে পারেন না। তারা রায়ের বক্তব্য বোঝার জন্য আইনজীবীদের শরণাপন্ন হলে কেবল অর্থ ব্যয় নয়, প্রতিনিয়তই তারা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। গত ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সুপ্রীমকোর্ট আয়োজিত ‘শান্তি ও উন্নয়নের জন্য ন্যায়বিচার’ শীর্ষক দিনব্যাপী জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন ’১৯-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারপতিদের মামলার রায় ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলায় লেখার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমাদের মামলার রায় লেখা হয় শুধু ইংরেজী ভাষায়, অনেক সময় আমাদের সাধারণ মানুষ যারা হয়ত ইংরেজী ভাল বোঝেও না, তারা কিন্তু ধোঁকায় পড়ে যায়। তারা সঠিক জানতে পারে না যে রায়টা কী! এ জন্য ইংরেজীতে লেখা হোক, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় থাকা উচিত। এর আগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ’১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে বাংলায় রায় লেখার ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, এরই মধ্যে উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় লেখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটা অব্যাহত থাকবে। তা সত্ত্বেও বাংলায় রায় দেয়ার বিষয়টি খুব কম সংখ্যক বিচারপতিই দিচ্ছেন।
সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে প্রধান বিচারপতিসহ সাতজন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৯৭ বিচারপতি রয়েছেন। সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন সূত্রে জানায়, কিছু বিচারপতি বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে আছেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি শেখ জাকির হোসেন, বিচারপতি আবুজাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি আশরাফুল কামাল, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আতোয়ার রহমান। এ ছাড়া আর কোন বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় বা আদেশ লেখেন না। ভাষার মাস আসতে অনেকেই বাংলায় রায় লেখার চেষ্টা করেন। বিচারপতি শেখ জাকির হোসেন ’১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তখন থেকেই তিনি বাংলায় রায় লিখছেন। ইতোমধ্যে তিনি প্রায় ১২ হাজারেরও বেশি আদেশ ও রায় প্রদান করেছেন। তিনিই বাংলায় সর্বাধিক আদেশ ও রায় লিখেছেন। এর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ কিছু বিচারপতি বাংলা ভাষায় বেশ কিছু রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু সেই অর্থে তাদের অনুসরণ করেননি অন্য বিচারপতিরা। ১৯৮৯ সালের দিকে উচ্চ আদালতে সর্বপ্রথম বাংলায় রায় দেন বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী। সাবেক প্রধান বিচারপতি (বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান) এ বি এম খায়রুল হকও বাংলায় রায় দেন। তিনি ২০০৭ সাল থেকে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় দুই শ’ রায় বাংলা ভাষায় দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এদিকে বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় সম্প্রতি ৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। বিচারপতি শওকত হোসেন, বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের বিচারপতিরা ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় ভিন্ন পর্যবেক্ষণে রায় লিখেছেন। বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকীর বাংলায় লেখা রায়কে পূর্ণ সমর্থন করেছেন। পিলখানা হত্যা মামলায় বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকীর মাতৃভাষায় লেখা ১৬ হাজার পাঁচ শ’ বায়ান্ন পাতার রায়ে ২৭ লাখ ৯০ হাজার ৪৬৮ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, গিনেস বুক অব রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত সর্ববৃহৎ রায় থেকে পিলখানা হত্যা মামলার রায়টি বহুগুণে বড়। ধারণা করা যায়, অচিরেই পিলখানা হত্যা মামলার রায়টি গিনেস বুক অব রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেন, উচ্চ আদালতে বাংলা চালু একদিনে হবে না। অনেকেই বাংলায় রায় দিচ্ছেন। আস্তে আস্তে এই প্রচলন চালু হবে। উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় অবশ্যই দেয়া দরকার। আইনগুলোও বাংলায় করা উচিত। বেশির ভাগ আইন ব্রিটিশ আমলের। সে সমস্ত নজির বিএলডি, ডিএলআর এগুলো ইংরেজীতে রয়েছে। বাংলা হওয়া উচিত। সংসদে আইনগুলো বাংলা করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। বাংলায় আইন থাকলে বিচারপতিগণও রায় বাংলায় দিতে সুবিধা হবে। সচরাচর যে সমস্ত আইন আছে সেগুলো বাংলায় ব্যবহার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের আইনজীবী তালিকাভুক্তি লিখিত পরীক্ষার ড্রাফট বাংলায় হওয়া উচিত। আমি মনে করি আস্তে আস্তে সকল ক্ষেত্রেই বাংলার ব্যবহার জোরদার হবে।
ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিনউদ্দিন বলেন, মুজিববর্ষ থেকে আমাদের উচ্চ আদালতসহ সব পর্যায়ে মাতৃভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে বাঙালি জাতি নিজস্ব স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হবে। কয়েক বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ লিখছেন। এটি খুবই ইতিবাচক। ভবিষ্যতে তাদের পাশাপাশি আরও অনেক বিচারপতি বাংলায় লিখবেন। তবে ইংরেজীতে রায় ও আদেশ লেখারও প্রয়োজন রয়েছে। বহির্বিশ্বের বিচারাঙ্গনে আমাদের রায় যাতে ব্যবহৃত হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। কোনভাবেই যেন আমরা পিছিয়ে না থাকি। উচ্চ আদালতে রায় বাংলায় হলে ভুক্তভোগীরা সহজেই জানতে পারবেন। আমাদের কাছে ছুটে আসতে হবে না। বিচারপ্রার্থীরা অভিযোগের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতে আইনজীবীরা বিচার প্রার্থনা করেন। বিচারপতিগণ যে রায় দেন তা বোঝার শক্তি সেও সাধারণ বিচারপ্রার্থীর প্রায় ক্ষেত্রেই থাকে না। এ রায় বোঝার জন্য তাকে কোন আইনজীবী বা অন্য কারও কাছে যেতে হয়। এছাড়া হাইকোর্ট দায়রা আদালতের প্রদত্ত রায়ের পর্যালোচনায় যখন মৃত্যুদ- নিশ্চিত করেন, তখন ক্ষতিগ্রস্তরা লাভবান পক্ষ আসামি বা বাদী যেই হোন, তিনি ইংরেজীর কারণে প্রকাশিত রায় বুঝতে পারেন না, জানতে পারেন না কী কারণে ও কিসের ভিত্তিতে তার দ-াদেশ বহাল থাকল বা খালাস হলো। নাগরিক হিসেবে অবশ্যই মামলার ফল জানা ও বোঝার অধিকার সবার রয়েছে। রায়টি বাংলাতে হলে জনগণ সহজে বুঝতে পারবে। রায়টি বাংলায় দিলে জনগণ ঘরে বসেই সহজেই অনলাইনের মাধ্যমে রায়টি দেখতে পারবে।
’১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আইন কমিশন বিচার কাজে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ’৮৭ এর প্রয়োগ বিষয়ে একটি সুপারিশ করেন। নয় বছর আগে তার ওই সুপারিশ আজও আলোর মুখ দেখেনি।