কাজিরবাজার ডেস্ক :
আস্থা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছয় নির্দেশের পরদিন দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উত্থান ঘটেছে, যা গত ৭ বছরের মধ্যে একদিনের ব্যবধানে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। শুধু সূচকের রেকর্ড গড়িয়েই থামেনি রবিবারের শেয়ারবাজার, ৯৭ শতাংশ কোম্পানির দর বৃদ্ধির দিনে বিনিয়োগকারীরা একদিনে ফিরে পেয়েছেন ১৫ হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন।
বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে নির্দেশনা দেয়ার পরদিন ডিএসইএক্স বেড়েছে ২৩২ পয়েন্ট। ৫ শতাংশ সূচকের দর বৃদ্ধির দিনে এগারোটি কোম্পানির বিক্রেতাশূন্য অবস্থায় লেনদেন হয়েছে।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ডিএসইতে ডিএসইএক্স সূচকটি ’১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ৪ হাজার ৫৬ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। রবিবার একদিনে বিগত ৭ বছরের মধ্যে সূচকটির সর্বোচ্চ উত্থান হয়েছে। এর আগে সূচকটির একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান হয়েছিল ১৫৫ পয়েন্ট, ’১৫ সালের ১০ মে’তে।
এক বছর ধরে শেয়ারবাজার মন্দাবস্থায় ছিল। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্কে শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বৃহস্পতিবারে উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, দেন কয়েকটি নির্দেশনা। যা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করে। এছাড়া রবিবার বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্বনর ড. ফজলে কবিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে সহজ সুদে ১০ হাজার কোটি টাকা প্রদান বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন গবর্নর। প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আশ্বাস দেন তিনি।
বিভিন্ন পদক্ষেপের সঙ্গে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালকদের শেয়ার ক্রয়ের ঘোষণা, গ্রামীণফোনের সিইও পদে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ইয়াসির আজমানকে নিয়োগ এবং তারল্য সঙ্কট নিরসনে সরকারী ৪ ব্যাংকের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত শেয়ারবাজারে ইতিবাচক ভূমিকা এনে দেয়। এসব খবরে রবিবার ডিএসইএক্স সূচকটির রেকর্ড উত্থান হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে যে ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আশা করা যায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ছাড়াও অন্য ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য বলা হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা কিছুটা ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। সরকার চায় শেয়ারবাজার ভাল হোক, এমন ধারণা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ফিরে আসবে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ এ হাফিজ বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপেই পুঁজিবাজারে দরের উর্ধগতির কারণ। তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে পুঁজিবাজার নিয়ে ইতিবাচক খবর আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজার নিয়ে ভাল কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পুঁজিবাজার নিয়ে আলোচনার খবর এসেছে। মানুষের আস্থা বেড়েছে। মানুষ মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বিষয়টি দেখছেন, এবার হয়ত বাজার ঠিক হবে। যেসব কথা বলা হয়েছে তা সত্যি সত্যি করা গেলে বাজার আসলেই ভাল হবে।
ডিএসই ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারে শেয়ারের দর অনেক কমে গিয়েছিল। এই অবস্থায় দুটি সুখবর এসেছে। একটি হচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক, আরেকটি হচ্ছে সরকারী ব্যাংকগুলোও শেয়ার কিনবে। ফলে আস্থা ফিরে এসেছে। আর মানুষের আতঙ্কিত হয়ে বিক্রির সিদ্ধান্ত বন্ধ হয়েছে। এজন্যই সূচক বেড়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন, সরকার শেয়ারবাজার ভাল করতে আন্তরিক। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এছাড়া বড় ধরনের ধসের কারণে ভাল ভাল কোম্পানির শেয়ার দাম অনেক কমে গেছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়বেÑ এটাই স্বাভাবিক।
তারা বলছেন, এখন যেহেতু শেয়ারবাজার পতন কাটিয়ে উঠছে তাই বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে। হুজুগে বা গুজবে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। বিনিয়োগকারীদের কোনভাবেই প্যানিক সেল (হুজুগে বিক্রি) করা যাবে না। আবার গুজবে পড়ে অতিরিক্ত লাভের আশায় দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করাও ঠিক হবে না। বিনিয়োগকারীদের ভাল কোম্পানি বাছাই করে মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে।
রবিবারে ডিএসইর প্রধান সূচক ২৩২ পয়েন্ট বৃদ্ধির পাশাপাশি ডিএসইর অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ৫৭, ডিএসই-৩০ সূচক ৮১ এবং নতুন চালু হওয়া সিডিএসইটি সূচক ৪৭ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯৯৮, ১৪৮৭ ও ৮৯২ পয়েন্টে।
ডিএসইতে টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৪১১ কোটি ৩৬ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট, যা আগের দিন থেকে ১৪৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বেশি। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ২৬৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকার।
ডিএসইতে ৩৫৬ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিন শ’ ছেচল্লিশটির বা ৯৭ শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে। দর কমেছে ছয়টির বা ২ শতাংশের এবং চারটি বা ১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর অপরিবর্তিত রয়েছে।
রবিবারে দরবৃদ্ধির দাপটে দর হারানো কোম্পানির সংখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। দিনটিতে দর হারানোর তালিকায় শুধু দশটি কোম্পানি রয়েছে। এর বাইরে আর কোন কোম্পানি খুঁজে পাওয়া যায়নি। সূচকের ইতিহাসের দিনে দর কমা এই কোম্পানিগুলো হচ্ছে-এসএস স্টীল, ইবিএল এনআরবি মিউচুয়াল ফান্ড, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক, জুটস স্পিনার্স, এলআর গ্লোবাল মিউচুয়াল ফান্ড, প্রগেসিভ লাইফ, এবিবি১ম মিউচুয়াল ফান্ড, অলটেক্স বিডি সার্ভিস ও নাভানা সিএনজি।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক শতাংশের ওপর দাম বেড়ছে তিন শ’ একটির। দুই শ’ আশিটির দাম বেড়েছে ২ শতাংশের ওপরে। ৪ শতাংশের ওপরে দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে ১৮০। ৫ শতাংশের ওপরে দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে ১৩০টি। একশ’টির ওপরে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে ৬ শতাংশের ওপরে।
এমন দাম বাড়িয়েও অনেক বিনিয়োগকারী কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনতে পারছে না। যাদের কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার আছে তারা বিক্রি করতে চাচ্ছেন না। অথচ কিছুদিন আগেই এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ৮-৯ শতাংশ দাম কমিয়েও বিক্রি করা যাচ্ছিল না। এতে ভয়াবহ ধস নামে শেয়ারবাজারে। ফলে ৫-১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন ঘটে। এ সময়ে লেনদেন হওয়া ৮ কার্যদিবসের মধ্যে ৭ কার্যদিবসেই বড় পতন হয়। এতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ৪২৩ পয়েন্ট কমে যায়।
টাকার অঙ্কে ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে স্কয়ার ফার্মার শেয়ার। এদিন কোম্পানিটির ১৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। লেনদেনে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা সিঙ্গারের ১৭ কোটি ১৭ লাখ টাকার এবং ১৩ কোটি ২২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে উঠে আসে লাফার্জ হোলসিম। ডিএসইর সার্বিক লেনদেনে উঠে আসা অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনা পাওয়ার, এসএস স্টীল, গ্রামীণফোন, এডিএন টেলিকম, এনসিসি ব্যাংক, রিং শাইন ও ব্যাংক এশিয়া।