কাজিরবাজার ডেস্ক :
ডাকসু ভবনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতাদের বিরুদ্ধে ভিপি নূরের মামলার পর এবার নূর ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে বহিরাগতদের নিয়ে হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের করা হয়েছে। নূরকে প্রধান আসামি করে শাহবাগ থানায় ২৯ জনের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থী ডি এম সাব্বির হোসেন। মামলায় অজ্ঞাত আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলাটি শাহবাগ থানাকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ডাকসুতে হামলায় আহত ভিপি নূরসহ আহত সবাই শঙ্কামুক্ত। এদিকে ঢাবির মধুর ক্যান্টিনের সামনে বৃহস্পতিবার ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। তবে সেটা পুরোপুরি বিস্ফোরিত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থী ডি এম সাব্বির হোসেন বাদী হয়ে ভিপি নূর ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়েরর পর বিকেলেই মামলার এজাহারটি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে আসে। এরপর ঢাকা মহানগর হাকিম ধীমান চন্দ্র ম-ল এজাহারটি গ্রহণ করে শাহবাগ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আরিফুর রহমানকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।
মামলায় ডাকসু ভিপি নূর ছাড়া বাকি আসামিরা হলেন- সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক ফারুক হাসান, মুহাম্মদ রাশেদ খান, মশিউর রহমান, আবু হানিফ, এ পি এম সুহেল, আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, আমিনুল ইসলাম, তুহিন ফারাবী (চাটার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ), মেহেদী হাসান, সালেহ উদ্দিন সিফাত (জসীম উদ্দিন হল), নাজমুল হাসান, আয়াতুল্লাহ বেহেশতী, রবিউল হোসেন, আরিফুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, আরিফুর রহমান, বিন ইয়ামিন মোল্লা (এ এফ রহমান হল), তরিকুল ইসলাম (এ এফ রহমান হল), আব্দুল্লাহ হিল বাকী (মুহসীন হল), আকরাম হোসেন (এ এফ রহমান হল), আসিফ খান (বিজয় একাত্তর হল), সানাউল্লাহ হক (জিয়া হল), আতাউল্লাহ (শহীদুল্লাহ হল), শাকিল মিয়া (মুহসীন হল), হাসানুল বান্না (বিজয় একাত্তর হল), রবীরুল ইসলাম, রাজ, আরিফুল ইসলামসহ আরও অজ্ঞাতনামা ১৫-২০ জন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ২২ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে ঢাবি রাজু ভাস্কর্য এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের মামুন-বুলবুল গ্রুপের ৩৫-৪০ জন নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে টেলিনরের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি বরাবর উকিল নোটিস প্রদানের প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচী ছিল। সাড়ে ১২টায় বিক্ষোভ কর্মসূচী শেষ করে মামুন-বুলবুলের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিনের উদ্দেশে রওনা হন।
ওই সময় বাদীসহ ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনসহ আরও ৩০-৩৫ জন স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে মধুর ক্যান্টিনের সামনে ১২টা ৪০ মিনিটের পৌঁছায়। সেখানে ডাকসু ভবনের সামনে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মী ও ডাকসুর ভিপি নূরসহ তার অনুসারী ৪০-৪৫ জন নেতাকর্মীর মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। একপর্যায়ে নূর কেন উস্কানিমূলক ও সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিচ্ছেন সনজিত-সাদ্দাম তা জানার জন্য নূরের কাছে যান।
এজাহারে বলা হয়, বহিরাগতদের নিয়ে নূরসহ অন্যান্য নেতাকর্মী তাদের দু’জনের উদ্দেশে ফের উস্কানিমূলক সেøাগান দেয় এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে মারধর করতে উদ্যত হয়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে তারা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় আসামি নূরসহ ২৯ জন এবং অজ্ঞাতনামা ১৫-২০ জন তাদের হত্যার উদ্দেশে লাঠিসোটা ও দেশীয় ধারাল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আঘাত করে এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।
পুলিশ জানিয়েছে, মামলার বাদী ডি এম সাব্বির হোসেনের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায়। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ভিপি নূরসহ ২৯ জন ২২ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার সময় লাঠি ও দেশীয় ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলামসহ ৮ জন গুরুতর জখম হন। এ সময় তাদের মানিব্যাগ, মোবাইল ও হাতঘড়ি ছিনিয়ে নেয় আসামিরা।
১৫ থেকে ২০ জন লাঠি ও দেশীয় ধারাল অস্ত্র ব্যবহার করে। এ সময় গুরুতর আহত অবস্থায় অনেককে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। মামলা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আলম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের পক্ষ থেকে মামলা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত করা হয়নি। মামলাটি করেছেন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থী ডিএম সাব্বির। তার এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
এর আগে ঘটনার পর পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের আট নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। তিনজনকে গ্রেফতারও করা হয়। তবে ২৪ ডিসেম্বর ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনসহ ৩৭ ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতাকে আসামি করে মামলার আবেদন করেন নূর। শাহবাগ থানায় সংগঠনের সঙ্গী ডাকসুর সমাজ সেবা সম্পাদক আখতার হোসেনের মাধ্যমে নূর এই আবেদন করেন। ওই মামলার ঘটনায় দু’দিন ধরেই অসন্তোষ ছিল ঢাবিতে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ডাকসুর নেতারাও।
ডাকসু ভবনে হামলায় আহত সবাই শঙ্কামুক্ত : ডাকসু ভবনে হামলায় আহত ভিপি নূরসহ আহত সবাই শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ একে এম নাসির উদ্দিন। বৃহস্পতিবার দুপুরে আহতদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নাসির উদ্দিন এ কথা জানান। পরিচালক বলেন, চিকিৎসাধীন আটজনের মধ্যে কারোরই এমন কোন পজিশন নেই, যাকে আমরা বিপদজনক বলব। ভিপি নূরের কথা বলতে গিয়ে পরিচালক বলেন, নূরের সবকিছু মোটামুটি ভাল আছে। এখন নতুন করে একটি সমস্যার কথা বলছে, তার এলভোতে ব্যথা। আমরা তার এক্স-রে করতে দিয়েছি, রিপোর্ট জেনে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে রিলিজ দেয়া হবে।
নাসির উদ্দিন আরও বলেন, সোহেলকে আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছিলাম। তার মাথায় আঘাতের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। অপারেশনের আগের দিন তার সিটি স্ক্যান করা হয়েছিল। তাতে আমরা কিছু ফাইন্ডিং পাই। যখন মনে হলো তার অপারেশন করা দরকার, তখনই আমরা তার অপারেশন করি। তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। তাকে আইসিইউ থেকে এইচডিইউতে রাখা হবে। শনিবার তাকে আমরা কেবিনে দেব।
ঢামেক পরিচালক বলেন, ফারাবীর বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোন ফাইন্ডিং ছিল না। তিনি বলেছিলেন মাঝে মাঝে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তার রেস্টের দরকার ছিল, তিনি এখনও রেস্টের মধ্যে আছেন। তাকে আমরা এইচডিইউতে রেখেছি। আমাদের মেডিক্যাল এক্সপার্টরা তাকে দেখছেন। শনিবার তাকে ওয়ার্ডে নিয়ে আসব।
নাসির উদ্দিন বলেন, আমিনুলের কিছু সমস্যা আমরা লক্ষ করেছি। তার মাথায়ও ইনজুরি ছিল। এছাড়া কিডনিতে কিছু ফাইন্ডিং পেয়েছি। তার কিডনিতে ইনফেকশন আছে। তাকে কিডনি বিভাগের অধীনে চিকিৎসা দেয়া হবে। এখন মাথার তেমন কোন সমস্যা নেই। তাকে আমরা রিলিজ দেব। এক সপ্তাহ পর ফলোআপে আসবেন তিনি।
নূরের নিরাপত্তা চেয়ে আইনী নোটিশ : ডাকসু ভিপি নূরুল হকের দ্রুত পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনী নোটিস পাঠিয়েছেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী মোঃ মনিরুজ্জামান। বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টর বরাবর এই নোটিস পাঠিয়েছেন বলে জানান তিনি। নোটিস পাওয়ার সাতদিনের মধ্যে নূরের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় বিবাদীদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করা হবে বলে জানান তিনি।
মধুর ক্যান্টিনের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ : ডাকসু ভবনে হামলার ইস্যুতে চলমান অস্থিরতার মধ্যেই বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে এ বিস্ফোরণ ঘটে। তবে এতে কেউ আহত হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মধুর ক্যান্টিনের পশ্চিম পাশের দরজার সামনে হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। পরে সেখানে গিয়ে একটি ককটেল অর্ধ বিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তবে কে বা কারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বোর্ড গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তাদের খবরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এসে এটি নিয়ে যায়।
প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলান রব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, বিগত কয়েকদিন ধরে একটা গোষ্ঠী ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। এই ঘটনাটিও আগের ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। ইতোমধ্যে গঠিত তদন্ত কমিটি এই বিষয়টি বিবেচনায় আনবে বলে আমার বিশ্বাস। আমরা ঘটনাটা জানতে পেরে পুলিশকে খবর দেই। পরে পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এসে ককটেল নিষ্ক্রিয় করে।