কাজিরবাজার ডেস্ক :
আওয়ামী লীগের দৃষ্টিনন্দন-সুশৃঙ্খল ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে দেশকে সমৃদ্ধির সোপানে নিতে এবং দেশকে দারিদ্র্য শূন্য করার আগামী দিনের রোডম্যাপ ঘোষণার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরে দেশের মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে তাঁর দৃঢ় সংকল্পের কথা জাতির সামনে তুলে ধরলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোটসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি-অর্থপাচার, গ্রেনেড-বোমা হামলা এবং অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে পুড়িয়ে মানুষ হত্যাকারীদের সম্পর্কে সর্বদা দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে দেশকে ভালবেসে রাজনীতি করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় দেশের মানুষের সহযোগিতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র এক দশকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আর শত ষড়যন্ত্র ও বারবার আঘাত আসা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। ভাষার অধিকার, স্বাধীনতাসহ দেশের যত অর্জন এবং দেশের মানুষ যা কিছু পেয়েছে তা আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়, আওয়ামী লীগই এদেশের মানুষকে কিছু দিতে পেরেছে। বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। জাতির জনক যে আদর্শ আওয়ামী লীগ গড়ে তুলেছেন, সেই আদর্শ ধারণ করে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলবই।
আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে গত ৭০ বছরে নানা প্রচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর আঘাত এসেছে বারবার। জাতির পিতাকেও কতবার হয়রানি করা হয়েছে, মিথ্যা মামলা হয়েছে, ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তারপরও তিনি সততার সঙ্গে এগিয়ে গিয়েছিলেন বলেই বাঙালী একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছে। ইয়াহিয়া, আইয়ুব খান, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া, যে যখন ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংস করতে বারবার আঘাত হেনেছে, নানা ষড়যন্ত্র করেছে। এতে আওয়ামী লীগের সাময়িক কিছু ক্ষতি করতে পারলেও জাতির পিতার হাতে গড়া এই সংগঠনকে কেউ ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। বরং সকল আঘাত ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আওয়ামী লীগ এখন দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সংগঠন।
শুক্রবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দু’দিনব্যাপী দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনের প্রথম দিন উদ্বোধনী বক্তব্যে দলটির ৩৮ বছর ধরে সভাপতির দায়িত্বপালনকারী প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে শেষ প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সম্মেলন আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন। আজ শনিবার দ্বিতীয় অধিবেশনেই নির্বাচন করা হবে আওয়ামী লীগের আগামী তিন বছরের নতুন নেতৃত্ব।
দলীয় নেতাকর্মীদের রাজনীতির মাহাত্ম্য তুলে ধরতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।’ এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় বাস্তবতা। যে কোন রাজনৈতিক নেতার জীবনে নীতি-আদর্শ সব থেকে বড় আর সেই আদর্শের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা। যিনি প্রস্তুত থাকতে পারেন, ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তিনি সফল হতে পারেন। দেশকে কিছু দিতে পারেন, জাতিকে কিছু দিতে পারেন।
জাতীয় সঙ্গিতের তালে তালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্ণিল সাজে সজ্জিত ও কানায় কানায় পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পদ¥ার বুকে পাল তোলা নৌকার আদলে তৈরি করা ১০২ ফুট দীর্ঘ ও ৪০ ফুট প্রশস্ত বিশাল দৃষ্টিনন্দন মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩টা ৫ মিনিটে এসে যখন উপস্থিত হন, তখনই পাল্টে যায় সম্মেলনের দৃশ্যপট। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। মঞ্চে উঠেই বিশাল মঞ্চের দু’পাশে হেঁটে হেঁটে হাতনেড়ে কাউন্সিলর, ডেলিগেটস, আমন্ত্রিত অতিথিদের শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঘন কুয়াশা এবং কনকনে শীত উপেক্ষা করেই বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে সকাল ১১টা থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল প্যান্ডেলে আসতে থাকেন কাউন্সিলর, ডেলিগেটর, আমন্ত্রিত অতিথি ও সারাদেশ থেকে আসা নেতাকর্মীরা। দুপুর দুইটার মধ্যেই কানায় কানায় ভরে ওঠে প্রায় ৩০ হাজার লোকের ধারণক্ষমতার সুবিশাল প্যান্ডেল। প্রধানমন্ত্রী আসার পরও অনেক কাউন্সিলর, ডেলিগেটর ও বিভিন্ন পেশার আমন্ত্রিত অতিথিদের লাইনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে প্যান্ডেলে প্রবেশ করতে দেখা যায়। প্যান্ডেলে জায়গার সঙ্কুলান না থাকায় প্যান্ডেলের বাইরে মাইকের সামনে দাঁড়িয়েই হাজার হাজার নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনের সুশৃঙ্খল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করতে দেখা যায়।
এবারের সম্মেলনের মূল সেøাগান ছিল ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণে গড়তে সোনার দেশ/এগিয়ে চলেছি দুর্বার, আমরাই তো বাংলাদেশ’। কঠোর নিরাপত্তার চাঁদরে ঢাকা ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনস্থলে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হয়েই সোজা গিয়ে দাঁড়ান মঞ্চের সামনে ডানদিকে জাতীয় পতাকার স্ট্যান্ডের পাশে। কাছেই আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকার স্ট্যান্ড, সেটির পাশে দাঁড়িয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আগে থেকেই ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজ নিজ জেলার নামাঙ্কিত পতাকা স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে যান।
ঠিক মঞ্চের সামনে ততক্ষণে স্থান করে নিয়েছেন লাল-সবুজে সজ্জিত দেশের খ্যাতনামা নারী-পুরুষ শিল্পীরা। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…..’ জাতীয় সঙ্গিতের তালে তালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় পতাকা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এরপরই প্রধানমন্ত্রীসহ জেলার নেতারা রঙিন বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়ানোর পর আনুষ্ঠানিকভাবে দু’দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১০২ ফুট দৈর্ঘ্যরে ও ৪০ ফুট প্রস্থের সম্মেলনের মূল ডিজিটাল মঞ্চটি এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যা দূর থেকে দেখতে মনে হবে যেন পদ্মার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে বিশাল এক নৌকা। মূলমঞ্চের সামনে আরেকটি মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। আর ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪০ ফুট প্রস্থ এবং ২৮ ফুট উচ্চতার প্যান্ডেল নির্মিত করা হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর আদলে। যার মধ্যে পুরো পদ্মা সেতুসহ দুই পাশের চর, টোলপ্লাজা, উন্মুক্ত আকাশ ও কাশবনের উপস্থিতি ফুটিয়ে তোলা হয়। এছাড়া সম্মেলনের মাঠজুড়ে ব্যানার ও ফেস্টুনে সরকারের বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প এবং উন্নয়নের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। সম্মেলনস্থলে ২৮টি এলইডি পর্দায় দেখানো হয় সম্মেলনের পুরো অনুষ্ঠান।
এরপর দেশী-বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথি ও কাউন্সিলর-ডেলিগেটদের সামনে সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা হয় বিশেষ দ্যোতনা। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল এবং সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের তত্ত্বাবধানে খ্যাতনামা শিল্পীরা সম্মেলক কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপনা জাগানো ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম- শেখ মুজিবুর, মুজিবর’, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীস্টান, বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালী, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’- গানগুলো পরিবেশন করেন।
এরপর দেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী শিবলী সাদিক ও শামীম আরা নীপার নেতৃত্বে ‘আমরা জন্মেছি বাংলায়’ শীর্ষক গীতি নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। নৃত্যের তালে তালে পেছনের ডিজিটাল ব্যানারে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, রক্তাক্ত-শোকাবহ ১৫ আগস্ট এবং বর্তমান সরকারের আমলে সারাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার চিত্রগুলো সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর সব ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় জাতীয় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা। প্রথমেই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। শোক প্রস্তাবের পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৫ আগস্টের সকল শহীদ এবং পরবর্তী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।
এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন অভ্যর্থনা উপ-পরিষদের সভাপতি ও ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট উপস্থাপন করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এরপরই সভাপতির ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সম্মেলনের পুরো অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমীন। সন্ধ্যার পর সম্মেলন মঞ্চে অসীম কুমার উকিলের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে শেষে সম্মেলন আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মাঠে নির্মিত মঞ্চে সকাল সাড়ে ১০টায় দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনেই আগামী তিন বছরের জন্য নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে আগত প্রায় ৫০ হাজার নেতাকর্মী ও আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করা হয়। আমন্ত্রিত বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার সদস্যদের পুরো সম্মেলন অনুষ্ঠান ‘ইংরেজীতে’ শোনার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।