তালিকাটি আরো অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। শেষ পর্যন্ত তা শুরু হয়েছে। আর সে কারণেই স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর হলেও রাজাকারের তালিকা প্রকাশকে স্বাগত জানাতে হবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য এ দেশে বেশ কিছু বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। তৈরি করা হয়েছিল শান্তি কমিটি, পিস কমিটি নামে পরিচিতি ছিল সংগঠনটির। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া চলমান। সেখানে ব্যক্তির বিচার হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত সংগঠনের বিচার হয়নি। দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয়েছে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তাকারী সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সদস্যদের তালিকা ছিল না। একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধীদের সামনের কাতারে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর এখন সমাজের আনাচকানাচে ঘাপটি মেরে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ওঠে। বিজয় দিবসের আগের দিন সরকারের হাতে থাকা নথির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একাত্তরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর বেতনভোগী ১০ হাজার ৭৮৯ জন স্বাধীনতাবিরোধীর প্রথম তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এবারই প্রথম একটি তালিকা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা হবে বলেও জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রকাশিত প্রথম তালিকাটি নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। তালিকায় এমন কিছু নাম যুক্ত হয়েছে, যাঁরা একাত্তরে ছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। এসেছে শহীদ পরিবারের সদস্যদের নামও। আবার কোনো কোনো এলাকার চিহ্নিত রাজাকার বা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া মানুষটির নাম এই তালিকায় আসেনি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, আংশিক যে তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে, সেটা কি নির্ভুলভাবে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না? নাকি ইচ্ছা করেই কেউ ভেতর থেকে সাবোটাজ করেছে? তা না হলে এই তালিকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক গোলাম আরিফ টিপুসহ রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পাঁচজনের নাম আসে কী করে! বরিশালের গেজেটভুক্ত ও ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর নামও তো স্থান পেয়েছে রাজাকারের তালিকায়। সরকারের এ রকম একটি ভালো উদ্যোগ এভাবে বিতর্কিত করা হলো কেন? একটি নির্ভুল তালিকা প্রকাশ করা তো অসম্ভব ছিল না।
একাত্তরের ঘাতক-দালালদের তালিকা তৈরির জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে পলাতক ঘাতক-দালালদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য যে গেজেট হয়েছিল, সেই গেজেট এবং সে সময় যাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল সেই তালিকাই যথেষ্ট। বিচারের আওতায় আসা প্রায় ৩৭ হাজার ঘাতক-দালালের নাম ওই সময়ের গেজেটে আছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেই গেজেটটি সংরক্ষিত আছে। ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল। কাজেই তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে একটি নির্ভুল তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব।