স্পোর্টস ডেস্ক :
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর হচ্ছে সাউথ এশিয়ান গেমস (এসএ গেমস)। অনেকেই আবার অভিহিত করে থাকেন ‘দ্য অলিম্পিক গেমস অব সাউথ এশিয়া’। এ নিয়ে ত্রয়োদশবারের মতো নেপালের তিন স্থানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এসএ গেমস। এই ক্রীড়া আসরের প্রথম আসরটিরও আয়োজক ছিল এই নেপালই, ১৯৮৪ সালে। তখন থেকে সর্বশেষ ২০১৬ আসর পর্যন্ত মোট ১২ আসর খেলে বাংলাদেশ জিতেছিল ৬৭ স্বর্ণ। বিদেশের মাটিতে এক আসরে (১৯৯৫, মাদ্রাজ) সর্বোচ্চ ৭ স্বর্ণ জিতেছিল। আর দেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশি জিতেছিল ১৮ স্বর্ণ (২০১০ সালে, ঢাকায়)। নিজেদের এই দুটি রেকর্ডই এবারের আসরে ভেঙ্গে দিয়েছে লাল-সবুজের ক্রীড়াবিদরা। সোমবার পুরুষ টি২০ ক্রিকেটের ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে স্বর্ণপদক জেতে বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশের স্বর্ণপদকের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯। যা এসএ গেমসের ইতিহাসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। টপকে যায় ২০১০ সালের প্রাপ্তিকে।
আগেরদিন আরচারির একদিনে ৬ স্বর্ণ জয় করেছিল বাংলাদেশ। এতে ভেঙ্গে যায় এসএ গেমসের এক আসরে বাংলাদেশ দলের একদিনে সবচেয়ে বেশি ৫ স্বর্ণ জয়ের রেকর্ড। ২০১০ আসরে একদিনে ৫ স্বর্ণ জিতেছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ। এর ৪টি এসেছিল কারাতে ও ১টি এসেছিল তায়কোয়ান্দো থেকে। আরচারির ৬ স্বর্ণ আবার ভেঙ্গে দেয় এক ডিসিপ্লিনে সর্বোচ্চ ৪ স্বর্ণ (২০১০ সালে কারাতে থেকে) প্রাপ্তির কীর্তিকেও।
সোমবার বাংলাদেশের সাফল্যের ভান্ডারে জমা পড়ে আরও চার-চারটি সোনার পদক। সবই আসে পোখরায় অনুষ্ঠিত তীর-ধনুকের খেলা আরচারি থেকে। নারী ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোমা বিশ্বাস ফাইনালে ১৪২-১৩৪ পয়েন্টে শ্রীলঙ্কার অনুরাধা করুনারতেœকে হারিয়ে জিতেন স্বর্ণ। কম্পাউন্ড পুরুষ ব্যক্তিগত ইভেন্টে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে স্বর্ণ জিতেন বাংলাদেশের সোহেল রানা। ভুটানের তানদিন দর্জিকে ১৩৭-১৩৬ পয়েন্টে হারিয়ে স্বর্ণ জয় করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছেলে সোহেল। রিকার্ভ পুরুষ একক ইভেন্টের ফাইনালে বাংলাদেশের রোমান সানা ৭-১ সেট পয়েন্টে ভুটানের টি-শারিং কিনলেকে এবং রিকার্ভ মহিলা একক ইভেন্টের ফাইনালে বাংলাদেশের ইতি খাতুন ৭-৩ সেট পয়েন্টে ভুটানের সোাম দিমাকে হারিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। এছাড়া কম্পাউন্ড পুরুষ একক ইভেন্টে বাংলাদেশের অসীম কুমার দাস ১৪৫-১৩৫ স্কোরে শ্রীলঙ্কার কুমারাকে হারিয়ে তা¤্রপদক জেতেন।
মজার ব্যাপারÑ খেলারই কথা ছিল না সোমার। দলে ছিলেন স্ট্যান্ডবাই হিসেবে। কিন্তু কোচ তাকে খেলার সুযোগ করে দিলে বাজিমাত করেন সোমা। স্বর্ণ সাফল্যের পরপরই আবেগে ভেঙ্গে পড়েন মাগুরার এই তীরন্দাজ।
এসএ গেমস আরচারিতে খেলার জন্য ১ ডিসেম্বর নেপালে যাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ দলের। কিন্তু সোমার ডিগ্রী পরীক্ষার কারণে ফ্লাইট দু’দিন পিছিয়ে দেয় ফেডারেশন। ফলে দ্বিগুণ চাপে পড়ে যান সোমা। সেই চাপ সামলে অবেশেষে দেশকে এন দেন সোনালি সাফল্য। মজার ব্যাপার- ঘরোয়া আসরে স্বর্ণ পদক না জিতলেও আন্তর্জাতিক আসরেই প্রথম স্বর্ণ জিতলেন তিনি।
এবারের আসরে সোহেলই প্রথম আরচার, যিনি স্বর্ণ জয়ের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। সোহেলের পর তিনটি স্বর্ণ জেতেন রোমান সানা ও ইতি খাতুন। তবে তার আগে ১৯৮৫ সাফ গেমসে সাঁতার ডিসিপ্লিনে ঢাকায় পাঁচটি স্বর্ণ জিতেছিলেন মোশাররফ হোসেন। শৈশবে খুব ভাল ফুটবল খেলতেন সোহেল। স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন। পরে হয়ে যান আরচার। খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। এরপর তরতর করে সামনের দিকে এগিয়ে চলা।
এই আসরে তিনটা স্বর্ণ নেই কোন বাংলাদেশী নারী এ্যাথলেটের। এ বিষয়টা ইতি আগের দিন রাতে শুনেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন বিষয়টা শুনে অবাক হয়েছিলাম। তখন থেকে আগ্রহটা আরও বেড়ে যায়। যেন রেকর্ডটা করতে পারি, এই চেষ্টাই ছিল। আমার পরবর্তী লক্ষ্য এশিয়ার মধ্যে ভাল একটা রেজাল্ট করা। আর অলিম্পিকে খেলার স্বপ্নও বুকে লালন করে রেখেছি। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছে।
আরচারিতে বাংলাদেশ প্রথম অংশ নেয় ২০০৬ আসরে। সেবার তারা জিতেছিল ২ ব্রোঞ্জ। ২০১০ আসরে জিতেছিল ২ রৌপ্য ও ২ ব্রোঞ্জ। ২০১৬ আসরে অর্জন ছিল ৩ রৌপ্য ও ৩ ব্রোঞ্জ। এবার প্রথম স্বর্ণ তো এসেছেই, বরং একে একে যোগ হয়েছে আরও ৯ স্বর্ণ। ১০ ইভেন্টের প্রতিটিতেই স্বর্ণজয়ের অনন্য কীর্তি গড়েছে লাল-সবুজের আরচাররা।
অবশ্য আরচারিতে এবার ভারত অংশ নেয়নি। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের এই অর্জনকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। কারণ এবার বাংলাদেশের সঙ্গে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে শ্রীলঙ্কা। এই আরচারিতেই বাংলাদেশের রোমান সানা আগামী ২০২০ অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। এসএ গেমসে তীরবাজির এই খেলার উদ্ভাসিত সাফল্যে বাংলাদেশে খেলাটির প্রচার, প্রসার, জনপ্রিয়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা আরও অনেকগুণ বেড়ে যাবে বলে ক্রীড়ামোদীরা মনে করছেন।
কৃতিপুরে ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সোমবার এসএ গেমস টি২০ ক্রিকেটের ফাইনালে ১১ বল বাকি থাকতেই ৭ উইকেটে বাংলাদেশ অনায়াসেই হারায় শ্রীলঙ্কাকে। ফলে স্বর্ণ পদক জেতে লাল-সবুজ বাহিনী। এর ফলে তারা শিরোপা অক্ষুণœ রাখল। ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আসরে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত হওয়া এই ইভেন্টে বাংলাদেশ সেবার ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে ৩ উইকেটে হারিয়ে স্বর্ণ জিতেছিল। পরের আসরে (২০১৬) এই খেলাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সোমবার ফাইনালে লঙ্কানদের হারিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার পাশাপাশি (লীগ ম্যাচে লঙ্কানদের কাছে ৯ উইকেটে হেরেছিল লাল-সবুজরা) স্বর্ণপদকও অক্ষুণœ রাখতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ। তবে ‘চাঁদের কলঙ্ক’-এর মতোই বাংলাদেশ দলের একটা আক্ষেপ থাকবে, স্বর্ণ জিতলেও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি তারা। যেমনটা হয়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল।
এদিকে ১৩ বছর পর শূটিংয়ে স্বর্ণবিহীন সমাপ্তি ঘটেছে বাংলাদেশের। শেষদিনে ১০ মিটার এয়ার পিস্তল মিক্সড ইভেন্টে শাকিল আহমেদ ও আরদিনা ফেরদৌস আঁখির ব্রোঞ্জ পদক জেতেন। এই আসরে অর্জন ৬ রৌপ্য ও ৪ ব্রোঞ্জ পদক প্রাপ্তি বাংলাদেশ শূটারদের।
২০০৬ কলম্বো আসরে কোন স্বর্ণ জেতেননি বাংলাদেশী শূটাররা। ১৯৯৩ ঢাকা আসরে শূটাররা সর্বোচ্চ ৭ স্বর্ণ জিতেছিলেন। অথচ এবার শূটাররা পুনরাবৃত্তি করেছেন ২০০৬ আসরের, ১টি স্বর্ণও জেতেননি তারা।