কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, কোন নারী-শিশু যেন নির্যাতনের শিকার না হয়। বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে যাতে শিশু ও নারীরা সুরক্ষিত থাকে। কেবল আমাদের দেশে নয়, আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও দেখেছি যে, শিশু ও নারীদের ওপর নির্যাতন মানসিক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। তাই এ বিষয়ে নারী-পুরুষ প্রত্যেককেই সচেতন থাকতে হবে, যাতে কোন শিশু ও নারী নির্যাতিত না হয়।
‘বেগম রোকেয়া দিবস’ উপলক্ষে সোমবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রোকেয়া পদক-২০১৯ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মূলত পুরুষরাই নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। তাই তাদের চিন্তা করা উচিত যে, তাদেরও মেয়ে শিশু রয়েছে এবং তাদের সন্তান যদি অন্য কারো দ্বারা নির্যাতিত হয় তাহলে তারা কী করবে। সে কারণেই এ ব্যাপারে সচেতনতা খুবই জরুরী।
নারী পুনর্জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৩৯তম জন্ম ও ৮৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার সারাদেশে বেগম রোকেয়া দিবস পালিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নারী ও সামাজিক উন্নয়নে তাদের অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিতে পাঁচজন নারীকে রোকেয়া পদক-২০১৯ প্রদান করেন। পদকপ্রাপ্তরা হলেন- বেগম সেলিনা খালেক, অধ্যক্ষ শামসুন নাহার, ড. নূরুন নাহার ফয়জুন্নেছা (মরণোত্তর), পাপড়ি বসু এবং বেগম আখতার জাহান।
শিশু ও নারী নির্যাতন রোধে সরকারের বিভিন্ন আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের নির্যাতন বন্ধে আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, এজন্য সচেতনতা আবশ্যক। আমরা আইন করেছি। কিন্তু আইন করলেই সবকিছু হয়ে যায় না। এজন্য শিশু ও নারী নির্যাতন বন্ধে সচেতনতাও প্রয়োজন। তিনি বলেন, শিশু ও নারী সমাজের কল্যাণে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, যৌতুক প্রতিরোধ আইন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন এবং নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও জাতীয় শিশু উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আইন প্রণয়নের ফলে সাধারণ মানুষ ও মেয়েদের মাঝে সচেতনতা গড়ে উঠছে। তাঁর সরকার নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করছে। বেগম রোকেয়া চেয়েছিলেন একজন নারী যে কোন রাষ্ট্রের প্রধান হবেন এবং তিনি পুরুষ ও পরিবার ও সমাজের সঙ্গে তালমিলিয়ে এগিয়ে যাবেন এবং সমান অধিকার ভোগ করবেন। তিনি বলেন, আমরা অন্তত এটা বাস্তবায়ন করেছি এবং আমাদের নারী সমাজ এখন বিজয়ীনীর বেশে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এগিয়ে চলছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ নারী উন্নয়নে বেগম রোকেয়ার সারথী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে- একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অগ্রগতি আমাদের ধরে রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনসংখ্যার অর্ধেককে বাদ দিয়ে দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়। পুরুষ-নারীর সম্মিলিত প্রয়াসে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেশকে আরও এগিয়ে নিতে তাঁর সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষায় নারীদের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেয়েরা এখন পরীক্ষায় ছেলেদের তুলনায় ভাল করছে। কারণ তারা (মেয়েরা) তাদের লেখাপড়ায় মনোযোগী।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, মেয়েদের মাঝে সৃষ্ট আত্মবিশ্বাস এবং তাদের অভিভাবকরা তাদের আরও লেখাপড়ায় উৎসাহ জোগাচ্ছে। এটা সমাজের বিবর্তন ও পরিবর্তনের জন্য হয়েছে। এটা দেশের জন্য একটা খুব ভাল দিক। তিনি বলেন, ক্রীড়াঙ্গনেও মেয়েরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। এ প্রসঙ্গে তিনি নেপালে সাউথ এশিয়ান গেমসে ক্রিকেট ও ভারোত্তলনে মেয়েদের স্বর্ণপদক জয়ের কথা উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। আমরা সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা নারী সমাজের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের অবস্থান সুনিশ্চিত করতে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর সরকার নারী সমাজের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ যেমন অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি লাভ করে একটা অবস্থান নিয়েছে, ঠিক নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর সমতা সেগুলোর ক্ষেত্রেও কিন্তু আজকে বিশ্ব বাংলাদেশকে তার একটা অবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে এবং এটা অব্যাহত রাখতে হবে। আমি সারাদেশে একশ’টা অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি। সেখানে মেয়ে উদ্যোক্তারা বিশেষ সুবিধা পাবেন, সেটাও আমরা নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। সর্বক্ষেত্রে মেয়েরা কাজ করুক সেটাই আমরা চাই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশ নারীদের পুনর্বাসনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্য জাতির পিতা পুনর্বাসন বোর্ড তৈরি করে দেন, আলাদা বাজেট দেন এবং তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সেই মেয়েদের চিকিৎসার জন্য সুইজারল্যান্ড থেকে নার্স, জার্মানি এবং ইংল্যান্ড থেকে ডাক্তার নিয়ে আসেন। তাদের চিকিৎসা করানো হয়।
বাবার সঙ্গে মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের কথাও স্মরণ করে তিনি বলেন, অনেক পরিবার তাদের (নির্যাতিত নারীদের) নিয়ে যায়, অনেক পরিবার তাদের নেয় না। তাদেরকে একসঙ্গে করে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন আমার মা, নিজে থেকে অনেক এ ধরনের নির্যাতিত মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তিনি সব সময় এই ধরনের মেয়েদের কথা চিন্তা করতেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গেলে নারী-পুুরুষের অধিকার শুধু সুরক্ষিত না, কাজ করার সুযোগ দিলেই একটি সমাজ কিন্তু গড়ে উঠবে। কারণ যেখানে একটা সমাজের অর্ধেকরই নারী। কাজেই একটা অঙ্গ যদি সেখানে উন্নত না হয়, শুধু একটা দিক দিয়ে তো একটা সমাজ গড়ে উঠতে পারে না। কাজেই সেদিকে লক্ষ্য রেখেই জাতির পিতা যে কাজগুলো করে গিয়েছিলেন, যে নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন আমরা কিন্তু সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আজকে এগিয়ে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বেগম রোকেয়া নারীদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছি। নারীরা একদিন লেখাপড়া শিখে জজ-ব্যারিস্টার হবে, বেগম রোকেয়ার সেই স্বপ্ন এখন বাস্তব। শুধু জজ-ব্যারিস্টার নয়, এখন সব জায়গাতেই নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। বেগম রোকেয়ার আদর্শ ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা। মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার স্বাগত বক্তৃতা এবং রোকেয়া পদক বিতরণ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। রোকেয়া পদক গ্রহণকারীদের পক্ষে বেগম সেলিনা খালেক পদক গ্রহণের অনুভূতি প্রকাশ করেন। মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যগণ, নারী নেতৃবৃন্দ এবং উচ্চ পদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন গণপূর্ত অধিদফতরের মাধ্যমে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের আধুনিকায়নের কাজ উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম উপস্থিত ছিলেন।
নয়াদিল্লীতে অগ্নিকা-ে ৪৩ জনের প্রাণহানিতে শোক প্রধানমন্ত্রীর
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার এক শোকবার্তায় গতকাল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে এক ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ৪৩ জনের প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী এ দুর্ঘটনাকে মর্মান্তিক হিসেবে অভিহত করে নিহতদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা জানিয়েছেন। তিনি বিপর্যয়কবলিত পরিবারগুলোকে ধৈর্যের সঙ্গে এই দৈবদুর্বিপাক মোকাবেলা করা এবং আহতদের আশু রোগমুক্তির মাধ্যমে তাদের দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা জানান।
শেখ হাসিনা দুর্ঘটনায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর উদ্ধার ও পুনর্বাসনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ায় ভারতীয় নেতৃত্বকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা এ কথা পুনর্ব্যক্ত করেন যে, এ ধরনের হƒদয়বিদারক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সব সময় ভারতের সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতায় প্রস্তুত। উল্লেখ্য, রবিবার সকালে নয়াদিল্লীর আনাজী মন্দির এলাকায় একটি হাতব্যাগ তৈরির কারখানায় আগুন লেগে কমপক্ষে ৪৩ জন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন।