স্পোর্টস ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইডেন গার্ডেন্সে ঢোকেন টস হওয়ার পরপরই। তিনি ঢুকতেই সে কি উত্তেজনা! যেন নিজ দেশের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে, ভালবাসার মানুষটিকে দেখতে পেয়েছেন ভারতীয় দর্শকরা। স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। তাদের ভালবাসায় সিক্ত হলেন শেখ হাসিনা, ভাসলেন উষ্ণ অভ্যর্থনায়।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সময় একটায় স্টেডিয়ামে ঢোকেন। কিছুক্ষণ পরই দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ দুই দলের ক্রিকেটারদের কাছে যান। শুরুতে ভারত ক্রিকেটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। শেখ হাসিনাকে বিরাট কোহলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলী। এ সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকর উপস্থিত ছিলেন। কোহলির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর কোহলি এক এক করে সব ক্রিকেটারের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে পরিচয় করিয়ে দেন। শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে হাত মেলান। ভারত ক্রিকেটারদের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের সঙ্গে এক এক করে কথা বলেন তিনি।
ক্রিকেটের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে তৈরি হলো আরেক নতুন ইতিহাস। উপমহাদেশের প্রথম গোলাপি বল টেস্টের আয়োজক হিসেবে। এই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হলো বাংলাদেশের নামও।
পিঙ্ক বা গোলাপি বলের সঙ্গে রং মিলিয়ে ইডেনের সবুজ মাঠ আর তার আশপাশটাও এখন গোলাপিময়। কলকাতার আয়োজক সবাই পরেছেন গোলাপি জামা, খেলার ব্রেকটাইমে চারটে বড় ফ্লাডলাইটস্ট্যান্ডে জ্বলল গোলাপি আলো। স্টেডিয়ামে সম্ভবত আগেই মুড়ে দেয়া হয়েছে গোলাপিতে, গঙ্গায় চলেছে গোলাপি নৌকা, মাসকট দুটোর রং গোলাপি আর নীল।
ইডেন টেস্টে গোলাপি বলে খেলতে প্রথমে বাংলাদেশ রাজি ছিল না। ভারত-বাংলাদেশকে গোলাপি বলে খেলতে রাজি করানোর পুরো কৃতিত্ব বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলী। তিনিই দুদলকে গোলাপি বলে খেলতে রাজি করিয়েছেন।
ইডেনের এই ম্যাচ উপভোগ করতে বাংলাদেশ থেকেও ছুটে গেছেন হাজারো দর্শক। কলকাতায় রাস্তায় এখন বাংলাদেশ জাতীয় দলের টি শার্ট পরা লোকদের দেখা মিলছে। এক বাংলাদেশী ভক্ত ক্রীড়াপ্রেমী নূরবক্স একতারা হাতে কলকাতার রাস্তা মাতিয়ে রেখেছেন। নূরবক্স বলেন, আমি গত ১৫ বছর ধরে বিনা পয়সায় বিদেশে অনেক খেলা দেখেছি। শ্রীলঙ্কা গেছেন, ভারতেও এসেছেন তিনি দিল্লী রাজকোট নাগপুর ইন্দোর ভারতের এসব জায়গায় বাংলাদেশের পক্ষে খেলা দেখেছি। এসেছি ইডেনেও।
২০০০ সালে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট খেলা বাংলাদেশ ক্রিকেটাররাও উপস্থিত থাকেন স্টেডিয়ামে। শুধু আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও আল শাহরিয়ার রোকন উপস্থিত থাকতে পারেননি। তারা দেশে নেই। এছাড়া আকরাম খান, হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদ পাইলটসহ সবাই উপস্থিত থাকেন। শেখ হাসিনা তাদের সঙ্গেও এক এক করে কথা বলেন।
এরপর তিনি চলে যান ইডেনের রীতি অনুযায়ী ঘণ্টা বাজিয়ে ম্যাচ শুরু করার সিগন্যাল দিতে। শেখ হাসিনা আর মমতা ব্যানার্জী ঘণ্টা বাজাবেন। তাদের ঘণ্টা বাজানোর পরপরই শুরু হবে ইডেন টেস্ট। তা আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল। ঘণ্টা বাজানোর আগে অনেকটা সময় যায়। তখন সবার নজর শেখ হাসিনা ও মমতার দিকে থাকে। ঘণ্টা বাজানোর আগে দুই দলের ক্রিকেটাররা জাতীয় সঙ্গীতের জন্য আবার মাঠে উপস্থিত হন। জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও মমতা ব্যানার্জী ঘণ্টা বাজাতেই খেলা শুরু হয়। তাদের দুইজনের হাতের ছোঁয়াতেই শুরু হয় ঐতিহাসিক ইডেন টেস্ট।
খেলাও শুরু হয়। শেখ হাসিনা ও মমতা ব্যানার্জী এবং উপস্থিত সবাই খেলা উপভোগ করতে থাকেন। এ টেস্টকে ঘিরে অনেকদিন ধরেই মহাউত্তেজনা বিরাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত টেস্ট শুরু হয়েছে। উপমহাদেশে প্রথমবার দিবারাত্রির টেস্ট হয়েছে। প্রথমবার এসজির গোলাপি বলে খেলাও শুরু হয়েছে। তবে এই আয়োজনের অনেক কিছুই শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন হয়েছে। খেলা শুরু হওয়ার আগে সময়স্বল্পতা এবং নিরাপত্তার জন্য অনুমতির অভাবে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্ণিল এই আয়োজনে মাঝ আকাশে বিমান থেকে ঝাঁপ দিয়ে প্যারাস্যুটে ইডেন গার্ডেন্সে নেমে আসার কথা ছিল ভারতীয় সেনাকর্মীদের। এসে ভারত-বাংলাদেশ দুই দলের অধিনায়কের হাতে টেস্ট ম্যাচের গোলাপি বলও তুলে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তা হয়নি। শুরুতে দর্শকদের বিনোদনের জন্যও অনেক আয়োজন ছিল। সেগুলোও হয়নি।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে এবং ভারত ও বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটারদের নিয়ে যে আয়োজনগুলো তা ঠিকই হয়েছে। প্রথম সেশনের পর যেমন বিশেষ ‘টক শো’ আয়োজন করার সিদ্ধান্ত ছিল, যেখানে সৌরভ গাঙ্গুলী, ভিভিএস লক্ষণ, হরভজন সিং, রাহুল দ্রাবিড় ও অনীল কুম্বলের অংশ নেয়ার কথা ছিল। তা হয়েছে। তবে গাঙ্গুলী ব্যস্ততার জন্য সময় দিতে পারেননি। দ্রাবিড় ছিলেন না। তবে শচীন টেন্ডুলকর যোগ দেন। বাকিরা ঠিকই থাকেন। টেন্ডুলকর তো শুরুটাই করেন এভাবে, ‘কেমন আছ কলকাতা, ভাল আছ?’ সবাই চিৎকারে ফেটে পড়েন। যখন এমনটি হয় তখন ৫০ পদের খাবারের যে আয়োজন ছিল তা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর খাবারের তালিকায় রাজকীয় ব্যবস্থা ছিল। ৫০ পদের খাবারে গঙ্গার ইলিশ, পাবদা সর্ষে, ভেটকি পাতুড়ি, ডাব চিংড়ি, ফুলকপির রোস্ট, ছানার ডাল এবং প্রথামাফিক সবধরনের জনপ্রিয় পদ ছিল। ভাত, রুটি, পোলাও, পায়েস, চাটনির মতো পদ, মুরগি ও খাসির হরেক রকম পদও ছিল।
দিনের দ্বিতীয় সেশনের পর সঙ্গীত আয়োজন হয়। সঙ্গীত হওয়ার পাশাপাশি ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক কপিল দেব, টেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, কুম্বলেরা গাড়িতে চড়ে ইডেন গার্ডেন্স প্রদক্ষিণ করেন। সেখানে থাকেন ভারতের সাবেক নারী ক্রিকেটার ঝুলন গোস্বামীও। এমনকি ভারতের সাবেক অনেক টেস্ট অধিনায়কও উপস্থিত থাকেন। যেমন থাকেন আজহারউদ্দিনও। টেস্টের প্রথমদিন শেষ হওয়ার পর ২০০ নৃত্যশিল্পী নাচেন। সেই সঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী রুনা লায়লা। তা উপভোগ করেন শেখ হাসিনা। রাতেই তিনি ঢাকায় ফিরেন। কলকাতাবাসী এবং স্টেডিয়ামে আগত ৬০ হাজারের বেশি দর্শক শেখ হাসিনাকে যখনই দেখেছেন হাততালিতে অভিবাদন জানিয়েছেন। ভালবাসায় ভাসিয়েছেন।