কাজিরবাজার ডেস্ক :
উচ্চ আদালতসহ সারাদেশের আদালতগুলোতে মামলা জট নিরসনে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি অন্যতম। আদালতের বাইরে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতি ব্যবহার করে আদালতে বিচারাধীন মামলার জট কমিয়ে আনা সম্ভব। মামলা বা বিরোধ নিষ্পত্তির এ অনানুষ্ঠানিক বা উপানুষ্ঠানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেক দেশই সুফল পেয়েছে। বর্তমানে দেশে উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতগুলোতে প্রায় ৩৬ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে তিন মাসে এডিআর পদ্ধতিতে মোট ৬০ হাজার ৬১৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা রয়েছে ২ হাজার ১০টি। এ সংখ্যাটি আইনজীবীগণ ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। আইনজীবীগণের অভিমত মামলা জট কমাতে হলে অবশ্যই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) উপর আরও জোর দিতে হবে। এতে করে অনেকেই শুরুতেই মামলা করা থেকে রেহাই পাবেন। ফলে বাদী-বিবাদী উভয়েই উপকৃত হবেন।
দেশের ৬৪টি জেলায় এডিআর পদ্ধতিতে মোট ৬০ হাজার ৬১৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে সময় চেয়ে বেশি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ঢাকা জেলায়। সেখানে ৬ হাজার ৯৩৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আর সবচেয়ে কম নিষ্পত্তি হয়েছে লালমনিরহাট জেলায়। সেখানে নিষ্পত্তি হয়েছে ১টি মামলা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় ২৬০৪টি, রাজশাহীতে ৯৮৩, খুলনায় ১৩৮২, বরিশালে ১২২৯, সিলেট ১১৪৭ রংপুর জেলায় ১২৩৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য জেলায় প্রচুর মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। কোন কোন দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে ১৫-২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগে। এসব মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু কিছু আইনজীবী ও বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এসব মামলা জিইয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করেন। মানুষ মরে যায় অথচ দেওয়ানি মামলা চলে কয়েক পুরুষ ধরে। এ ব্যবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন। বিচার প্রার্থীরা বিচারের আশায় লাখ লাখ টাকা খরচ করেন, কিন্তু তারপরও কাক্সিক্ষত বিচার তারা পাননা। দিনের পর দিন সময় প্রার্থনার নামে সুপরিকল্পিতভাব ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত করা হয়। যদিও আমাদের দেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বাধ্যতামূলক নয়। এটি আদালতের বা পক্ষদের একটি ইচ্ছাধীন বিষয়। উন্নত দেশগুলোতে অনেক মামলার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে থাকে বিকল্প পদ্ধতিতে। কোন কোন দেশ মামলার সংখ্যা ৩/৪ মাসে আশানুরূপভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর জোর দেয়া হলে মামলার সংখ্যা বাড়ত না। পাশাপাশি এক জনের সঙ্গে আরেক জনের শত্রুতা, অর্থ ও সময়ের অপচয় হতে রেহাই পাওয়া যেত।
৫ নবেম্বর একটি অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধান বিচারপতি জাকি বিন আজমি বলেছেন, শুনানি মুলতবি না হলে বাংলাদেশেও মামলা জট কমবে। তিনি বলেন, মামলা জট কমাতে হলে মামলার শুনানি মুলতবি করা যাবে না। কারণ পরের দিনের কার্যতালিকায় আরও মামলা যোগ হয়। দিনের মামলা দিনে শুনানি করতে হবে। একটি মামলার বিচার নিষ্পত্তি করার পরই কেবল আরেকটি মামলা ধরতে হবে। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে মালয়েশিয়ায় মামলা জট কমেছে। বাংলাদেশেও পদ্ধতিটি অনুসরণ করা হলে মামলা জট কমবে। জাকি বিন আজমি বর্তমানে দুবাই আন্তর্জাতিক আর্থিক আদালতের প্রধান বিচারপতি পদে রয়েছেন। ওই দিন সুপ্রীমকোর্ট বার মিলনায়তনে মালয়েশিয়ার বিচার ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা নিয়ে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবীদের সঙ্গে ‘মিট দ্য বার’ অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী।
এদিকে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, আগের তুলনায় মামলা জট কমতে শুরু করেছে। আমাদের নজর দিতে হবে নতুন যে মামলা হচ্ছে তার চেয়ে যাতে বেশি করে নিষ্পত্তি হয়। সে দিকেই বেশি নজর দিতে হবে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতির আশ্রয় নিলে মামলার জট অনেকাংশে কমে যাবে। সূত্র মতে কোন কোন দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে ১৫-২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগে। এসব মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেন না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু কিছু আইনজীবী ও বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এসব মামলা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেন। মানুষ মরে যায়, অথচ দেওয়ানি মামলা চলে কয়েক পুরুষ ধরে। এ ব্যবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন। তিনি আরও বলেন, আগের চেয়ে যাতে বেশি করে মামলা নিষ্পত্তি হয় সেদিকেই বেশি নজর দিতে হবে। ট্রাফিক ভায়োলেন্স মামলাগুলো সিএমএম কোর্টে দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। আমরা কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতির আশ্রয় নিলে যেমন শত্রুতা কমবে অন্যদিকে সময় ও অর্থও বাঁচবে। মামলার ভারে ন্যুব্জ উচ্চ ও নিম্ন আদালত। এসব আদালতে ক্রমাগত মামলা জট বাড়ছেই। সংশ্লিষ্ট আইনও সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সে সুফল আমরা এখনও ভোগ করতে পারিনি। আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লেগে যায়। অনেক মামলাতেই বিচার যখন পাওয়া যায়, ন্যায়বিচারের তখন আর কোন প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। তাই, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির দিকে আমাদের বেশি নজর দিতে হবে। তবে, এক্ষেত্রে আইনজীবী ও বিচারকের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত বিচারককে এসব মামলায় সমঝোতাকারীর ভূমিকা পালন করতে হয়। বিচারকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আইনজীবীদের সহযোগিতা ছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব না। মামলার ভারে জর্জরিত আদালতের কার্যতালিকায় প্রতিদিনই জমা হচ্ছে আরও নতুন নতুন মামলা। প্রতিদিনই বেড়ে চলছে মামলার সংখ্যা। আমাদের আনুষ্ঠানিক আদালত বা বিচার ব্যবস্থার পক্ষে সময়মতো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে বিচার সম্পন্ন করা দুরূহ।